আমার দেখা প্রথম পুলিশ/ শ্যামল কুমার সরকার

১৯৭৭-৭৯ সময়কালের কথা। প্রাইমারীতে পড়ি। আমাদের নিভৃত গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট খালের পাশে নল-খাগড়া-লতা-পাতার ঝোঁপঝাঁড়ে পরিবেষ্টিত একটি ঝুঁপড়ি ঘর ছিল। ৪/৫ জন সন্তান-সন্ততি ও স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে ছিল গৃহকর্তার বাস। ভীষণ অভাবী তাঁরা। গৃহকত্রী চাচী আমাদের বাড়ি সহ পাড়ার অন্যান্য বাড়িগুলো হতে মাঝে মধ্যেই চাল তুলতেন নিছক দু’মুঠো ভাতের জন্য। মাকে চাল আর বাবাকে কিছু টাকাও দিতে দেখতাম। ওসব দেখে অত ছোট বয়সেও খুব খারাপ লাগতো। আমরা ধনী ছিলাম না। কিন্তু দু’বেলা নিশ্চিন্তে গরম ভাত খেতে পারতাম।

যাহোক, একদিন সকালে হঠাৎ হৈচৈ শুনে বাড়ি হতে ছুটে যাই। সবার পেছনে দৌড়াতে থাকি। যাত্রা শেষ হয় সেই জীর্ণ কুটিরের কাছে গিয়ে। বাড়িটির পাশেই ছিল গভীর খাদ, যেখানে মিশে গেছে কালীগঙ্গার দিকে ধাবিত হওয়া আমাদের ছোট্ট খালটি। ভিড় ঠেলে একটু কাছে যেতেই চমকে উঠি। দেখি পুলিশের পোশাক পরিহিত কয়েকজন সদস্য সেই অভাবী পরিবারের গৃহকর্তাকে দু’হাত পেছনে বেঁধে খালের কাঁদার মধ্যে চিৎ করে ফেলে নাকে গামছা দিয়ে গরম জল ঢালছে। লোকটি অর্তনাদ করছে, বাঁচানোর জন্য সবাইকে ডাকছে। তাঁর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে পুলিশরা হাসতে হাসতে তাঁর নাকের ভেতর বেশি করে গরম জল ঢালছে। সে নিষ্ঠুরতা সহ্য করতে না পেরে আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে মাকে সব বলি। মার কথায়ও আমার কান্না সহজে থামে না। স্পষ্ট মনে আছে সেদিন অনেক সময় হাউ-মাউ করে কেঁদেছিলাম। বার বার নির্যাতিত সে চাচার কথা মনে আসছিল। পরে জেনেছিলাম চাচা নাকি কোনো ছ্যাঁচড়া চুরির দায়ে অভিযুক্ত (?) ছিলেন। তিনি আজ আর বেঁচে নেই।

দুই
এ ঘটনাও একই সময়ের। আমাদের উত্তর পাড়ার একজন দাদা সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে ভারতে যাবেন চিরতরে। দাদা তাঁর শ্বশুর বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান সহ অবস্থান করছিলেন। আমাদের জোড়া বাড়ি সেটি। প্রচন্ড গরম। গ্রামে তখন বিদ্যুতের কথা চিন্তারও বাইরে। বারান্দায় পাটিতে শুয়ে আছি। মা তালের পাখায় বাতাস দিচ্ছে। তখন রাত দশটার মতো হবে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ক্লান্তিতে আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ টর্চের আলো আর বুটের ঠক ঠক শব্দে আমরা জেগে উঠি। বুঝতে পেরে মা দৌড়ে পাশের বাড়ি গিয়ে সংবাদটা দিতেই সে দাদা অন্ধকারে দৌড়ে পালাতে গিয়ে খেঁজুরের কাটার স্তুপে পড়ে যান। কাটাবিদ্ধ অবস্থাতেও তিনি পালিয়ে যান। ততক্ষণে মাকে উদ্দেশ্য করে পুলিশের গালিগালাজ শুরু হয়ে গেছে। মা যেন তাঁদের মুখের খাবার কেড়ে নিয়েছে। পরে পুলিশরা সবাইকে গালাগাল করে ও ধমকিয়ে চলে যায়। জেনেছিলাম পাড়ারই কে বা কারা দাদার দেশত্যাগের ব্যাপারে থানায় অভিযোগ (?) করেছিল।

তিন
ঘটনার সময়কাল ঐ। আমাদের লাগোয়া পাশের গ্রামের একজন গৃহবধু জামগাছে ফাঁস নিয়ে মারা গেলেন। পুলিশ এলে সারা গ্রাম মুহুর্তেই জনমানবহীন হয়ে যায়। বহুদিন ঝুলন্ত সে বধুকে স্বপ্নে দেখেছি। দেখেছি সে গ্রামের বাসিন্দাদের দশা। পুলিশের ভয়ে সবাই পালাচ্ছে!

দেশের পুলিশ বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা বলবেন, বাংলাদেশ পুলিশ কি শুধু এসবই করেছে? তারা কি ভালো কাজ করেনা? আমি বলবো, তারা আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি ভালো কাজ করছে। আমি এ-ও বলবো পুলিশ না থাকলে নাগরিকদের একদিনও শান্তিতে বাঁচার উপায় নেই। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সংকটে পুলিশের ভূমিকা তো আছেই। আমি জানি পুলিশে এখন উচ্চ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত অনেক জনবল রয়েছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশ পুলিশ গর্বের সাথে কাজ করছে। তবুও উল্লেখিত ঘটনাগুলো ভুলতে পারিনা। বিশেষ করে শৈশবে প্রথম দেখা খাকি পোশাকের পুলিশ এখনো আমার মনে রয়ে গেছে। পুলিশের সে গালিগুলো এখনো আমার কানে বাজে। বিভৎসতা দেখতে পাই। বাংলাদেশ পুলিশে সুনামের সাথে কর্মরত আমার নিজ বন্ধুদের কথা মনে করে পুরোনো সেসব বেদনার স্মৃতি ভুলে যেতে চাই। কিন্তুু কিছুতেই পারিনা। হয়তোবা আমার প্রজন্মের অনেকেরই এমন কষ্টের অতীত আছে। আমি আর সেসব মনে করতে চাই না। বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা যেন আমার মতন অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় না হয়। কারণ, দুর্বিষহ স্মৃতি মানুষকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়ায়। যা মোটেও কাম্য নয়।

শ্যামল কুমার সরকারঃ সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ।

Facebook Comments Box
ভাগ