করোনা এবং দারিদ্র্য/ রুহুল ইসলাম টিপু

ছবি : সংগৃহীত

করোনা এবং দারিদ্র্য

রুহুল ইসলাম টিপু

আমার বাসার নিকট একটি ঘুপছি ঘরে আহসান ভাই সকালে হাতে বানানো রুটি বিক্রি করেন। বিকেলে পেয়াজুঁ, চপ, ছোলা, ঝাল-মিষ্টি পিঠা এসবের সাথে মুড়ি। চা-বিস্কুটও রয়েছে। যাতায়াতের পথে কথা হয়। আহসান ভাইয়ের স্ত্রী রুটি এবং খাদ্যসামগ্রী বানাতে সাহায্য করেন। এক মেয়ে জিনাত পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। দুই ছেলে, একজন জিনাতের থেকে কিছুটা বড় হোন্ডা গ্যারেজে কাজ করে। আর একজন জিনাতের থেকে ছোট। গতবছর একদিন আহসান ভাই জানালেন জিনাতকে একটি কাজ দিয়েছেন বিমান বন্দরে। অনুমান করি ওয়াশ রুম বা ফ্লোর পরিস্কারের কাজ হতে পারে। আহসান ভাই নিজেও মাঝে মাঝে রাত জেগে বিমান বন্দরের নতুন তৃতীয় টার্মিনালের বর্ধিতাংশ উন্নয়ন কাজের পাহারাদার ছিলেন। এ কাজ পেতে তার এক ঘনিষ্ট ব্যক্তি তাকে সাহায্য করেছেন। এতে বাড়তি কিছু আয় হয়। করোনাকালীন সময়ে তার দোকান আংশিক বন্ধ। খুলে আবার বন্ধ, এরকম। খুললেও লোকজন নেই। কিছুই আর বিক্রি হয় না। সেসময় আহসান ভাই বলেছিলেন তিনি পেরে উঠছেন না। বছরের শেষের দিকে তাকে আর দেখতে পাইনি। তার স্ত্রী বিকেলে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করতেন। এরপর একদম দোকান বন্ধ। বেশ কিছুদিন পর একজনকে এদের সম্পর্কে জিজ্ঞেসের উত্তরে আমি আকাশ হতে পড়ি। তিনি বললেন, আহসান এবং তার পরিবার পালিয়ে গিয়েছেন। আমি বিস্তারিত আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি। শুধু আহসান ভাই এবং তার পরিবার ভালো থাকবেন, এটিই আমার কামনা। পরিবারটির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি। আহসান ভাই এবং তার পরিবারের এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া বা শহর ছেড়ে দেওয়া আজ বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। অজস্র এরকম ঘটনার একটি মাত্র। এটি করোনা’র প্রথম ঢেউ এর ফসল।

করোনা সম্পর্কে বিশ্ব জানে ২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম এ ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ক্রমে তা সারা বিশশ্ব ছড়িয়ে পড়ে। ৮ মার্চ ২০২০-এ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ সনাক্তের কথা জানানো হয়। গতবছর ১৮ মার্চ আমাদের দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যুর খবর আসে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় জীবন এবং জীবিকার সংগ্রাম। বাঁচা-মরার প্রাণপণ লড়াই। আমাদের রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা। ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার শিকার আমরা। ঘূর্ণিঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন, বন্যা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এরূপ নানাবিধ জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় ভরপুর বাংলাদেশ। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হয়ে উঠে পৃথিবীর উন্নয়নের রোল মডেল।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনার টীকা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ১৩ মাসের বৈশ্বিক করোনার চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে বিশাল এক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। গত বছর আমরা দেখেছি নিস্তব্ধ দেশ, হাসপাতাল, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, খাবারের জন্য লাইন, সাহায্য, অসহায়ত্ব, লকডাউন, কর্মহীন মানুষ, বেকারত্ব, মাস্ক, মৃত্যু, সৎকারসহ অজস্র শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। বছরের শেষ দিকে পুনরায় আমরা জেগে উঠার প্রাণান্তর প্রচেষ্টায় প্রায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। মার্চ ২০২১ এর শেষ এবং এপ্রিল ২০২১-এ এসে পুনরায় দেখতে পাই আরো গভীর অন্ধকার; করোনায় মৃত্যুহার বৃদ্ধি, হাসপাতালে রোগী ভর্তিতে ভোগান্তি ও সীমাবদ্ধতা। করোনার রোগী ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে যেকোন একটি হাসপাতালে সব ব্যবস্থা পাওয়া খুবই কঠিন। সীট এবং চিকিৎসা-ব্যবস্থাপনারও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। চিকিৎসার অভাবে আপন জনের কোলের উপর ঢলে পড়ছে প্রাণ। শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই অনুভব করতে পারেন এ দুঃখ-কষ্ট ও শোক-তাপের ক্ষত। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটাছুটির করুণ আর্তনাদ। আমিও সম্প্রতি বাবা হারানো মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত দেশে মোট শনাক্ত ৭ লক্ষ ২৭ হাজার ৭ শত ৮০; মোট মৃত্যু ১০ হাজার ৫ শত ৮৮। করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় বাংলাদেশ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ও নীতিমালা গ্রহণ করে এগুচ্ছো, নাগরিক হিসেবে এতে আমার বিশ্বাসের কোন ঘাটতি নেই। এ লক্ষ্যেই সরকার ঘোষিত বর্তমান লকডাউন চলবে ২৮ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত।

আমরা বাংলাদেশের নাগরিকবৃন্দ বড় আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বছর ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য চিরতরে নির্মূল হবে। ২০১৯ এর পরিসংখ্যান নির্মূলের খুব কাছাকাছি ছিলাম এমনটি নয়। তবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে প্রায় নির্মূলের পথে এগুচ্ছি, এটাও বাংলাদেশের অন্যতম অর্জনের একটি মাইলফলক।

মানুষের আয় দিনে ১৬১ টাকা ৪১ পয়সা (১ দশমিক ৯০ ডলার) বা তারও কম, বিশ্ব ব্যাংকের দেওয়া সংজ্ঞায় এই আয়ের মানুষদেরই বলা হয় চরম দরিদ্র। আর যাদের আয় দিনে ৪৬৭ টাকা ২৪ পয়সা (৫ দশমিক ৫০ ডলার) তাদের বলা হয় বেশি দরিদ্র। এ তথ্যটি গ্রহণ করেছি ১৩ জুন ২০২০ দৈনিক ইত্তেফাক হতে; আনন্দবাজার পত্রিকার সূত্রে সংবাদটি প্রকাশিত। একই সংবাদে আরো জানা যায়, গবেষকরা জানিয়েছেন, এই চরম দারিদ্র্যের মাত্রায় আগামী দিনে বিশ্বে দারিদ্র্যে চরম সীমায় পৌঁছে যাবে বিশ্বের অন্তত: ১১২ কোটি মানুষ। আর বেশি দারিদ্র্যের মাত্রায় এই পৃথিবীতে গরিব হয়ে পড়বে অন্তত: ৩৭১ কোটি মানুষ। যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। সংবাদ প্রকাশের তারিখ দেখেই বলা যাচ্ছে, এটি করোনার শুধুমাত্র প্রথম ঢেউকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। নি:সন্দেহে পৃথিবী করোনা এবং দারিদ্র্য নিয়ে আজ বড়ই চিন্তিত ও আতঙ্কিত।

এ অবস্থায় আজ প্রথম আলোর খবরের বরাতে জানা যায় বাংলাদেশে নতুন দরিদ্র মানুষ এখন ২ কোটি ৪৫ লাখ। এটি বেসরকারি সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (বিআইজিডি) এর এক জরিপ চিত্রের তথ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। করোনার পূর্বে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ২১ শতাংশ। পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপে আসা ২ কোটি ৪৫ লাখ নতুন দারিদ্র্য এই হিসাবের বাইরে।

দারিদ্র্য এবং করোনা এখন একটি জটিল সমীকরণ। দেশের নাগরিকদের ভরসার আশ্রয়স্থল হচ্ছে সরকার। এ মুহূর্ত পর্যন্ত জানা যাচ্ছে ৩৫ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে এককালীন এবং ক্ষতিগ্রস্ত এক লাখ কৃষককে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় রমজান উপলক্ষে দরিদ্রদের ৫ শত টাকা করে দিতে প্রতি ইউনিয়নে আড়াই লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে।

গত বছর করোনার প্রথম ঢেউ এর সময় সরকারি সাহায্য-সহযোগিতা এবং একইসাথে বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগের সহায়তার ফলশ্রুতিতে দারিদ্র্যের লাগাম নিয়ন্ত্রিত রাখা সম্ভব হয়েছিল। প্রথম আলো’র সংবাদের আশংকাজনক ক্ষেত্রটি হচ্ছে যাঁরা নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন, তাঁরা সরকারের কোনো নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নেই। তাঁদের বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন কর্মসূচি নিতে হবে। এটি দেশবাসি সকলের প্রত্যাশা। আশা জাগানিয়ার বিষয় হচ্ছে, বুধবার (২১.০৪.২০২১) ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গরিবদের গরিব থেকে বের করে নিয়ে আসা। যাঁরা অতিরিক্ত গরিব আছেন, তাঁরা গরিব হবেন এবং যাঁরা গরিব আছেন তাঁদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসব। সেভাবেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ আগামী ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট দরিদ্রবান্ধব হবে আমাদের প্রত্যাশা।

জরিপ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, গ্রামের তুলনায় শহরে নতুন দরিদ্র তৈরি হয়েছে বেশি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান জানান, শুধু আয় কমেনি কৃষকের। কারণ কৃষি ভালো করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঠিক করা নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো দেশে অন্তত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে রোগী শনাক্তের হার এখনো ১৫ শতাংশের বেশি। আমাদের কামনা, বাসনা, প্রার্থনা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে। ইতোমধ্যে দেশবাসির মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাস্ক, নিরাপদ দূরত্ব এবং হাত ধোয়ার কাজ ভুল করলেই সর্বনাশ। এটি দেশের নাগরিকদের অবস্থা ও অবস্থানের উপর বিবেচ্য বিষয় নয়। আগামী অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের সকলকে মাস্ক, নিরাপদ দূরত্ব এবং হাত ধোয়া চালিয়ে যেতেই হবে। আমরা প্রত্যেকে ব্যক্তি হিসেবে নিজের জন্য, সকল মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য এ অঙ্গীকার অব্যাহত রাখবো। ভুল করা যাবে না। এটি প্রতিকারের মন্ত্র।

করোনার শিক্ষায় বার বার উঠে এসেছে গ্রাম এবং কৃষি। আগামী দিনে বাংলাদেশে গ্রামীন অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রামভিত্তিক উন্নয়নই হবে আমাদের মুক্তি। সমবায়, কৃষি, উৎপাদন, বিপণন, সংরক্ষণ যাবতীয় কর্মকান্ডের সম্মিলিন ঘটাবে গ্রাম। বর্তমান অভিজ্ঞতায় পরিবহন খাত, দোকানশ্রমিক, অভ্যন্তরীণ বাজারমূখী বিভিন্ন কারখানা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অনেকের আয় আজ পুরোপুরি বন্ধ। আমার আহসান ভাই নিশ্চয় পরিবার নিয়ে পালিয়ে গ্রামেই গিয়েছেন। সরকারের নিকট আমাদের আবেদন বাংলাদেশের সকল গ্রামকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার সর্বাত্মক কর্মসূচি এখনই গ্রহণ করুন। আমরা বাংলাদেশকে শক্তিশালী ও উন্নত করবো। এটিই হোক সকলের অঙ্গীকার।

কড়চা/ আর ই টি

Facebook Comments Box
ভাগ