কল্পনা চাকমার নিরুদ্দেশ যাত্রা ও কিছু কথা/ শ্যামল কুমার সরকার

ছবি সংগৃহীত

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা (১৯৩১.২৮ বর্গ কি: মি) বাঘাইছড়ির (রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার) এক নিভৃত গ্রাম নিউ লাল্যাঘোনা’য় জন্মেছিলেন। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মালেও তিনি জীবনের আলোতে আলোকিত করেছিলেন নিজেকে। তাইতো ভিন্ন কিছু ভাবতে শিখেছিলেন- অন্যকে বুঝতে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্বপ্ন ফেরি করতেন। অল্প সময়েই হয়ে উঠেছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এক পর্যায়ে তিনি নিপীড়িত ও বঞ্চিত পাহাড়ি জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। কল্পনা চাকমার এ উত্তরন-ই সম্ভবত হয়েছিল তার জন্য বড় কাল। আকাশে ডানা মেলা এক প্রানবন্ত রঙ্গিন প্রজাপতি হঠাৎ একেবারেই বিলীন হয়ে গেলেন। রাতের আকাশে জ¦লতে থাকা জোনাকী হঠাৎই লাপাত্তা হয়ে গেলেন। সে রাতে ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার। ১১ জুন ১৯৯৬। পরের দিন মানে ১২ জুন ছিল সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমনি অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্য কল্পনা চাকমাকে আপহরণ করে বলে তার পরিবারের সদস্যরা শুরু হতেই অভিযোগ করে আসছেন। কল্পনার অপহরণ (?) মামলার বাদী ছিলেন তাঁর বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা। কল্পনার ঘটনাটি সে সময় দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ রাতে লাল্যাঘোনা গ্রামে সাতজন পাহাড়িদের বাড়িতে দুস্কৃতকারীরা আগুন লাগিয়ে দেয়। সে ঘটনার প্রতিবাদে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কল্পনা চাকমা। সে ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তার সাথে কল্পনার তর্কাতর্কি হয়েছিল। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা ছিল অনেকটাই যেন অসম্ভব। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে উধাও হয়ে গেলেন কল্পনা। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্কুল ছাত্র রুপন চাকমা (১৫) নিহত হন এবং অপর তিন ছাত্র মনতোষ চাকমা, সমর বিজয় চাকমা এবং সুকেশ চাকমা নিখোঁজ হন (দৈনিক সংবাদ, ৭ জুলাই, ১৯৯৬)। নিখোঁজ কল্পনাকে দ্রুত উদ্ধারের জন্য দেশে ব্যাপক হৈচৈ লেগে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিকভাবেও বিষয়টি সাড়া ফেলেছিল (ভোরের কাগজ, ২২ জুলাই, ১৯৯৬)। কল্পনার নিরুদ্দেশ হওয়ার এক মাস পরে সরকার বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতেৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। এছাড়া চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশন কল্পনা চাকমার সন্ধানদাতাকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে রাঙ্গামাটিসহ অন্যান্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে লিফলেট বিতরণ করে। এতে কোনো ফল হয়নি। এছাড়াও ‘‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’’ ডঃ কলিমুল্লাহার নেতেৃত্বে একটি তদন্ত দল কল্পনার অনুসন্ধানে পাঠান। হেলিকপ্টারে যাওয়া এ তদন্ত দল ঢাকায় ফিরে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন (৮ আগষ্ট, ১৯৯৬) করে জানান, ‘‘কল্পনা ভারতের গন্ডাছড়া গ্রামে বাস করছেন এবং মায়ের সাথে কল্পনার ইতোমধ্যে দু’বার যোগাযোগও হয়েছে’’। কিন্তু কল্পনার মা বাঁধুনী চাকমা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন (ভোরের কাগজ, ১৯ আগস্ট ১৯৯৬) করে মানবাধিকার কমিশনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং মেয়েকে দ্রুত ফেরত চান।

২০১৪ সালে কল্পনার নিরুদ্দেশ মামলাটি রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপারের অধীনে ছিল। কল্পনার ভাইদের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য বাঘাইছড়ি থানাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ সুপার। সেটির বর্তমান অবস্থা জানা নেই। হয়তো তদন্ত চলছে। আর এভাবেই চলছে ২৪ বছর। মানে দুই যুগ। এর একটি সুরাহা হওয়া উচিত। স্বজনদের শেষ পরিণতি সবাই জানতে চান। এটি মানবপ্রবৃত্তি। নিজের সাক্ষাৎ কিছু অভিজ্ঞতা বলে লেখাটি শেষ করবো।

ছবি সংগৃহীত

পেশাগত কাজে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির (২রা ডিসেম্বর, ১৯৯৭) কয়েক মাস পরেই আমি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় কল্পনা চাকমার জন্মভূমি বাঘাইছড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় পাঁচ বছর কাটিয়েছি। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মাঝে ও শ্রেণীকক্ষের বাইরে আমার পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে বহুবার অশ্রুসিক্ত নয়নে ওদের প্রিয় কল্পনার কথা জানিয়েছে। পাহাড়ি অভিভাবকরাও আমাকে কল্পনা চাকমার ব্যাপারে জানিয়েছেন। কল্পনা চাকমার গ্রামে গিয়েছি। একই ব্যাপারে আমাকে জানিয়েছেন বাঙ্গালি শিক্ষার্থী-অভিভাবকরাও। আমি যুক্তি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি। যেহেতু আমি আদালতের কোনো বিচারক নই তাই এ ব্যাপারে রায় দেওয়ার কোনো এখতিয়ারও আমার নেই। তবে দেশের একজন নাগরিক হিসেবে, একজন শিক্ষক ও লেখক হিসেবে আমি মনেপ্রাণে চাই কল্পনা চাকমার বিষয়ে দেশের জনগণ সত্যিটিই জানুক। সত্য কখনোই একাধিক হয় না। কল্পনা চাকমা ভারতে থাকলে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হোক। আর তাঁর পরিবারের পক্ষ হতে আনীত অভিযোগ সত্য হলে দেশের আইনানুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

পার্বত্য অঞ্চলে কল্পনা চাকমার বিষয়টি ফিনিক্স পাখির মতোই। অন্য দশটি ঘটনার সাথে একে না মেলালেই ভালো হবে। কারণ, দেশের দশ ভাষাভাষীর এগারো আদিবাসী জাতি গোষ্ঠীর বাসভূমি দেশের এক দশমাংশ আয়তনের হিসাবটি একটু আলাদা বলেই সেখানে দীর্ঘদিন যুদ্ধ-বিগ্রহ চলেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ জন্য শেখ হাসিনা পেয়েছেন ইউনেস্কোর শান্তি পুরস্কার। দশ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা পেয়েছেন ‘‘মাদার অব হিউম্যানিটি’’ পুরস্কার। রাষ্ট্র চাইলে সবই করতে পারে। এর অনেক প্রমাণ আছে। সে ভরসাতেই বলি, বাংলাদেশ সরকার আর বিলম্ব না করে কল্পনা চাকমার নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্যটি অতি দ্রুত উদঘাটন করে দেশবাসীকে জানাবেন এবং অপরাধী যে-ই হোক তাঁর বা তাঁদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। এতে জাতিগত বিদ্বেষ ও জ¦লতে থাকা সন্দেহের দাবানলের পুরো অবসান না হলেও তা বহুলাংশেই কমে যাবে। আমি এখনো বিশ্বাস করি মানবতাবাদী প্রধানমন্ত্রী কল্পনা চাকমার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেবেন। আর বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি) কর্তৃক বাঘাইছড়ি সদরে (যার ডাকঘর মারিশ্যা) স্থাপিত বোর্ডে লেখা লাইনগুলো মনে মনে বলি-

‘‘চলো যাই মারিশ্যার পানে
শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানে,
রয়েছে পাহাড়ি-বাঙ্গালি জাতি
হয়ে সুখ-দুঃখের সাথি’’।

শ্যামল কুমার সরকারঃ সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ।

Facebook Comments Box
ভাগ