দুর্নীতি দমন কেবল মুখের কথা নয/ আবুল ইসলাম শিকদার

যখনই কোন দুর্নীতিবাজ বা ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির খল নায়কের দুর্ভাগ্য আমাদের সাদা চোখের দৃষ্টিগোচর হয় তখন আমরাও কিছু সাদামাটা আশাবাদী ভাবনার স্রোতে ভাসতে থাকি। মনে করি এভাবেই প্রতি জেলায় উপজেলায় অর্থাৎ তৃণমূল পর্যন্ত যদি কিছু দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করা হয় তাহলেই দেশ হবে দুর্নীতি মুক্ত। অতঃপর রাজা রানীর গল্পের মতো আমরা স্ত্রী পুত্র কন্যাদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবো।

না সরলপ্রাণ আশাবাদী মহতী চিন্তার বন্ধুরা। বিষয়টি এমন সরল অঙ্কের মতো নয়। কারণ অনেক। অতটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের সময় এবং সুযোগ কোনটাই নেই।

সময় নেই, কারণ গিন্নি বাজারের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে দুপুরের চুলা জ্বালাবার তাগিদে। আর সুযোগ না থাকার কারণটি বলবো না, কারণ ওটা সবাই জানেন। তবু প্রসঙ্গটি যখন তুলেছি তখন সামান্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দায়িত্ব তো থেকেই যায়।

সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ” ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর” এই সতর্কবাণী লিখে যারা ধূমপান বন্ধের আন্দোলনের পুরোধা হতে চান তারা আমার এ লেখার সাথে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু কী হাস্যস্পদ প্রতারণা! সিগারেট কেনার পরেই না ক্রেতা দেখতে পারবেন এই সতর্কবাণী। কিন্তু এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, ক্রেতা এই সতর্কবাণী দেখামাত্রই সিগারেটের প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিবেন ডাস্টবিনে। কেননা ক্রেতা জেনেশুনেই এ বিষ ক্রয় করেছেন ফেলে দেবার জন্য নয়, দেহমন তৃপ্ত করার জন্য। আর সিগারেট কোম্পানিগুলো ভালো করেই জানে যে একবার হাতে ধরিয়ে দিতে পারলেই হয়। তারপর প্যাকেটের গায়ে হাজারবার লেখা থাকলেও নেশাখোর সেদিকে তাকাবে না।

আমি প্রথমেই একটি বিষয় স্পষ্ট করে করে বলতে চাই, আজকের আলোচনাটি কোন বিশেষ সরকার সম্পর্কিত নয়, তার চাইতে বৃহৎ পরিসরের। তবে একথা ঠিক যে বাস্তবে তা হয়তো কাউকে না কাউকে কমবেশি আহত করবেই। নইলে আর লেখার অবতারণা কেন। প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বিদ্যমান রেখে দুর্নীতির মূলোৎপাটন তো দূরের কথা তার কেশাগ্র স্পর্শ করাও অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। কেননা দেশের ক্ষমতা আবর্তন পদ্ধতিটিই বর্তমান সময়ে অনেকটাই দুর্নীতির দুষ্ট চক্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর এই পুঁজি প্রধান রাজনীতি কখনোই দুর্নীতিমুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে পারেনা। কেননা আমাদের দেশের নষ্ট পুঁজিবাদের বিকৃত বিকাশ ঘটে দুর্নীতিকে ভিত্তি করেই।

সাম্প্রতিক কালে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে যারা নমিনেশন পান তাদের অনেকেরই উত্থান ইতিহাস খুব বেশি জনসমাদৃত নয়। অনেক ক্ষেত্রেই জননায়কের পরিবর্তে জন নিপীড়ক, ধর্ষক, মাদক ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি চাঁদাবাজ, প্রতারক ইত্যাদি খলনায়কেরাই নমিনেশন পেয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোও বিদ্যমান অন্যান্য দল ও শক্তির মোকাবেলা করার জন্য এইসব দুর্নীতিবাজ পেশিশক্তি ধারীদের বেশি পছন্দ করে থাকে। কেননা এদের পেছনে আছে অসংখ্য তরুণ দাঙ্গাবাজ, লোভী, পদলেহনকারী ছোট বড় সন্ত্রাসী যারা সাম্প্রতিককালে রাজনীতির মাঠে সকলকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা শুধু রাজনীতি নয়, সমাজের সকল ক্ষেত্রকেই তারা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। গ্রাম্য বিচার-সালিশ থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী সব ধরনের তৎপরতায় এরা জনগণকে সব সময় ভীতি ও আতঙ্কের রাজত্বে বন্দী করে রাখে। এদের আয় উপার্জনের প্রধান উৎসই হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতির সাথে যোগসাজশ। দুর্নীতিবাজদের পদসোপানে যিনি বা যারা উপরে আছে তারাই অধিকহারে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। আর এই অনানুষ্ঠানিক দুর্নীতিবাজরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রীয় তথা আনুষ্ঠানিক দুর্নীতির সাথে অতি দ্রুত সম্পৃক্ত হয়ে লুন্ঠন করতে থাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। তখন ক্ষমতাসীনরাও এদের দোসরে পরিণত হয় এবং নিজেরা কিছুটা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে ধোয়া তুলসীপাতা সেজে এদের কাঁধে ভর করে নানাভাবে দুর্নীতির অর্থ পকেটস্থ করে থাকে। কিন্তু যখন কোন কারণে এদের মধ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দেয় তখনই কোন ভাগ্য বিড়ম্বিত দুর্নীতিবাজ জাতীয় বানরে পরিণত হয় এবং জাতি তখন সবকিছু ভুলে ওই বানরের নাচ দেখে বেশ কিছুকাল কাটিয়ে দেয়। এই সুযোগে অধিকতর মর্যাদাবান দুর্নীতিবাজরা হাত পা ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে মালা জপতে শুরু করেন।

ভালো মানুষ, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিত্ব এখন আর প্রতিনিধি হওয়ার মনোনয়ন দৌড়ে খুব বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন না। দু’চারজন হয়তো থাকেন, কিন্তু তারা দল এবং সরকারের মধ্যে কোনঠাসা এবং নিস্প্রভ হয়ে থাকেন। দল এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের তেমন কোন ভূমিকাই থাকেনা।

আবার রাজনীতিবিদদের হাতেও এখন আর রাজনীতি নেই। কেননা একজন রাজনীতিবিদ ধীরে ধীরে গড়ে ওঠেন জনতার মধ্য থেকে। তার যে ন্যূনতম দেশপ্রেম ও জনসংযোগ থাকে হালের দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদদের অনেকক্ষেত্রেই তা থাকেনা। ফলে একজন রাজনীতিবিদ যেটুকু জনদায় বোধে ভোগেন দুর্নীতি পরায়ণ চাঁদাবাজ ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ সেই ভাবে কোন দায় দায়িত্ব অনুভব করেন না। ফলে রাজনীতিবিদ যদি দুর্নীতিবাজও কিছুটা হন তবু তার প্রধান লক্ষ্য থাকে জনগণ। আর এইসব ধিকৃত ও বিকৃত পুঁজিপতিদের প্রধান লক্ষ্য থাকে ধন সম্পদ, শৌর্যবীর্য আরো বৃদ্ধি করা এবং তার জন্য প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতিকেই। এভাবেই দুর্নীতির দুষ্ট চক্র থেকে রাজনীতি কখনোই বেরিয়ে আসতে পারে না।

আমরা আগুনের জন্য ম্যাচের কাঠিকেই দায়ী করি, ম্যাচ তৈরির কারখানাকে নয়। কিন্তু কারখানা বন্ধ না হলে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ জ্বলনধর্মী ম্যাচ অনবরত তৈরি হতেই থাকবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যদি সন্ত্রাস-দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হয় এবং মাঝেমাঝে দুর্নীতি দমনের প্রহসনমূলক নাটকীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে তাতে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সেই টম এন্ড জেরি খেলায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে এবং দুচার মাসের জেল-জরিমানা তাদের কাছে এক সম্মানজনক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কেননা তাদের মুক্তির সময় জেলগেটে ফুলের তোড়ার কোন অভাব হয়না। জেল ফেরত এইসব তথাকথিত দেশ প্রেমিক তথা সমাজ সেবক নেতৃবৃন্দ আরো স্থায়ী প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়। এভাবেই সমাজ থেকে মহত্ব, জ্ঞান এবং উদারনীতি ক্রমশ নির্বাসিত হচ্ছে এবং সমাজ হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য।

দুচার জন ব্যক্তি দুর্নীতিবাজকে জেলখানায় ঢুকিয়ে কিংবা অন্য কোন সাধারণ টোটকা চিকিৎসায় সমাজ কখনোই দুর্নীতি মুক্ত হতে পারে না। সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক বিষবৃক্ষের মুলোৎপাটনের জন্য প্রয়োজন প্রবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার গণ চরিত্র না থাকলেও অসুবিধা নেই। যদি অল্পসংখ্যক প্রতিশ্রুতিশীল রাজনীতিবিদও এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন সেটিও সফলতার কিছুটা আলো দেখবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কেননা এখানে নীতি নির্ধারণ এবং তার যথার্থ প্রয়োগই হচ্ছে মূল বিষয়। এই নীতিনির্ধারণী এবং প্রয়োগকারী সংস্থার শীর্ষ পদের অবস্থানকারী ব্যাক্তিদের সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্ব সবচাইতে বেশি প্রয়োজন।

প্রসঙ্গক্রমে ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক দর্শনের একটি প্রসঙ্গ টেনে আজকের মত আলোচনা শেষ করতে চাই। ইবনে খালদুন শেষ পর্যন্ত অন্তত পাঁচজন লোকের সন্ধান করেছেন যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও থাকবেন দুর্নীতিমুক্ত, দেশ প্রেমিক এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান। যদি শেষ পর্যন্ত এই পাঁচজন সৎ মানুষও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মধ্যে দৃশ্যমান না থাকে তবে সেই রাষ্ট্রের পতন অনিবার্য বলে তিনি মনে করেছেন। আজ দেশের দুর্নীতির হাল অবস্থা দেখে যদি কোন ইবনে খালদুন ভক্ত সন্দেহ করেন যে আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সেই পাঁচজন ব্যক্তিই আছেন কিনা, তাহলে ওই সন্দেহকারীকে আমরা আক্রোশ বশত হাত-পা বেঁধে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করতে পারি কিন্তু তার সন্দেহের খোঁচাটার যৌক্তিক উত্তর কি আমরা দিতে পারি?

কড়চা/ এ আই এস

Facebook Comments Box
ভাগ