পরিবার পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণে গণমাধ্যমের ভূমিকা
পারভেজ বাবুল
অপরিকল্পিত পরিবার এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে। সেসব কারণে জনসংখ্যা সীমিত রাখতে, পরিকল্পিত পরিবার গড়তে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রাসমূহ Sustaibale Development Goals (SGDs) অর্জন করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়।
পরিবার পরিকল্পনা গোটা বিশে^ মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে পরিকল্পিত পরিবারের বিকল্প নেই। ধর্মীয় বিধানের সঙ্গেও পরিকল্পিত পরিবার গঠনের কোনো বিরোধ নেই। পরিকল্পিত পরিবার গঠন যেকোনো মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। একটি দম্পতি সন্তান গ্রহণ ও বিরতিকালীন সময় সম্পর্কে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এটি মানবাধিকারের অন্তর্ভূক্ত। পরিকল্পিত পরিবার গঠনে পরিবার পরিকল্পনাসেবা নারী-পুরুষ উভয়কে গ্রহণ করতে হবে। বিষয়টা শুধু নারীর নয়, পুরুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।
তবে হাওর-বাঁওড়, পাহাড় ও দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা প্রয়োজন। জাতীয়ভাবে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সচেতনতা সৃষ্টিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও কাজে লাগাতে হবে। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। দিতে হবে প্রাপ্য সম্মান। সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নিজেরা সচেতন না হলে সমাজ কখনো পরিশুদ্ধ হবে না।
পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রত্যাশা অনুযায়ী উন্নতি হয়নি। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে নারীর ক্ষমতায়নে জোর দেওয়া দরকার। সেকারণে নারী পুরুষ উভয়কেই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। এ বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
দেশে মিডওয়াইফের সংখ্যা বাড়ছে। আগামী বছরগুলোতে মিডওয়াইফের মাধ্যমেও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতনতা ও সেবার পরিধি বাড়াতে হবে। যেসব অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি, সেসব অঞ্চলে বেশি কাজ করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন-সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
সাধারণভাবে পরিবার পরিকল্পনা বলতে কেবল জন্মনিয়ন্ত্রণকে বোঝায়। কিন্তু ব্যাপক অর্থে পরিবারের সার্বিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাকে পরিবার পরিকল্পনা বলা হয়। অনেক নারী তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন না। কখন সন্তানধারণ করবেন এবং কয়টি সন্তান গ্রহণ করবেন, সেসব ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। বরং সেসব ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষের মতামতের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিষয়টি নারীর জন্য ক্ষতিকর।
কিশোরীদের মাঝে ৩১ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। ১৫ বছরের একটি বিবাহিত মেয়ের পরিকল্পিত জীবন সম্পর্কে ধারণা থাকে না। ৩০ শতাংশ কিশোরী ১৯ বছর যেতে না যেতেই দুই থেকে তিনটি সন্তান জন্ম দিচ্ছে। একটি জাতীয় সাফল্যের অন্তরায়। অনাকাক্সিক্ষত সন্তানধারণ রোধ করা বাংলাদেশের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সে জন্য পরিবার পরিকল্পনাসেবা সহজলভ্য করতে হবে এবং যথাযথ তথ্য সরবরাহ করতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা সব ধরনের উন্নয়নের ভিত্তি। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সব কটি লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণা ও অন্যান্য পরিসংখ্যানের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রভাবিত করে। পরিবার পরিকল্পনা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ।
সামাজিক জীবনের নানা সমস্য মোকাবেলায় গণমাধ্যম সহযোগি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। গণমাধ্যম বিশেষ করে রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ভূমিকার কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি, পশু পালন, কৃষি উপকরণ ব্যবহার, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ, শিশু পরিচর্যা, পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসহ নানা বিষয়ে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে যোগাযোগবিদ ড্যানিয়ের লার্নার গণমাধ্যমকে সমাজ পরিতর্বনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, গণমাধ্যম মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করে, মানুষকে সমৃদ্ধ জীবনের ছবি দেখায় ও গতানুগতিক জীবনের বদ্ধ পরিধি থেকে মুক্ত করে ঐশ^র্যময় আধুনিক জীবনের দিকে অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধ করে। লার্নার মনে করেন, উন্নয়নে গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যম তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে মানসিক গতিশীলতা বাড়ায়। তাই গণমাধ্যমকে বলা হয় “ম্যাজিক মাল্টিপ্লায়ার” এবং ‘‘মবিলিটি মাল্টিপ্লায়ার” সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণমাধ্যম Watch dog হিসেবে আমাদের চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে।
জনসংখ্যার আধিক্য, বাল্য বিবাহ, মাদকাসক্ততাসহ নানা সমস্যা সামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা, নীতি নির্ধারকদের সামনে সমস্যা তুলে ধরা ও সমস্যা সমাধানের পথ বাতলে দেওয়া এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তুলতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্য প্রচারে রেডিও ও টেলিভিশন গুরুত্বপূর্ণ দুটি গণমাধ্যম। গবেষণায় দেখা যায় ৪২.১ শতাংশ লোক রেডিও থেকে এবং ১৭.২ শতাংশ টিভি থেকে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক তথ্য পায়।
গণমাধ্যমের জন্যেই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার তথ্য পান মানুষ পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমের কারণেই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার তথ্য সাধারণ মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে যায়।
তবে গণমাধ্যমের ভূমিকা বাড়াতে কমিউনিট রেডিওসহ পত্র পত্রিকা ও টেলিভিশনের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। সেসব উদ্যোগের ফলে গণমাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে প্রচার প্রচারণা বাড়বে।
পারভেজ বাবুল: কবি, সাংবাদিক, কথাশিল্পী। E-mail: parvezbabul@gmail.com
কড়চা/ পি বি