পাঠকের প্রত্যাশা ও লেখকের সীমাবদ্ধতা
শ্যামল কুমার সরকার
লেখক-পাঠক সম্পর্ক অনেকটাই দেয়া-নেয়ার। ভাবের আদান প্রদানের। কখনোবা দাবির। এ দাবি উভয়মুখী। লেখকরা মনে করেন লেখাটি পড়ে পাঠকদের এমন প্রতিক্রি য়াহওয়া উচিত। আবার পাঠকরা ভাবেন সমাজের এ বিষয়টি নিয়ে লেখকদের এখনি লেখা উচিত। এতে চলমান সমস্যাটির নিরসন হবে। আসলে কি তাই? লেখকরা কি সমস্যা দূর করতে পারেন? পাঠকদের অনেকেই ভাবেন, হ্যাঁ লেখকরা অবশ্যই তা পারেন। আর এমন বিশ্বাস হতেই কেউ কেউ সামাজিক বা ব্যক্তিক সমস্যা লেখকদের দৃষ্টি গোচর করে এর সমাধান কামনা করেন। যা অনেক সময় একজন লেখককে ভীষন যাতনার মধ্যে ফেলে দেয়। এমনি ঘটনা নিয়েই আজকের লেখা।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়মিত শারীরিক ও মোবাইল, ফেসবুকের মাধ্যমে মানসিকভাবে যৌন হয়রানি করে আসছেন। এমনকি বাইরের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের সাথেও তিনি একই কাজ করছেন। কাউকেএসব বললে তিনি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করাবেন। এ চিন্তায় ও সামাজিক ভয়ে নির্যাতিত মেয়েরা কাউকেই তাদের কষ্টের কথা বলতে পারছে না। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখার জন্য তাঁরা আমাকে আকুলভাবে অনুরোধ করেছে। আমি লিখলে নাকি ওরা যন্ত্রনা হতে মুক্তি পাবে।
কথাগুলো বারবার পড়ে মনটা বিষাদে ভরে যায়। শুধু মনে হয় এ-ও কী সম্ভব ? এ কেমন প্রতিষ্ঠান প্রধান? রক্ষক কি ভক্ষক হতে পারেন ? আবার এমনও মনে হয়েছে এসব বানোয়াট নয়তো? মনে এসেছে এমন ঘটনা দেশে প্রায়ই হচ্ছেও তো। ভুক্তভোগীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ নেই। বারবার কল্পনায় ওদের অসহায় মুখ দেখেছি। ওদের আতংক দেখেছি। ওদের বিশ্বাস আমি দু-লাইন লিখলেই ওদের সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তিনি মানুষ হয়ে যাবেন। ওদের আর নিপীড়ন করবেন না। ওরা বেঁচে যাবে। মানে আইন-আদালতের ভয়ে তিনি চুপসে যাবেন-নিজেকে শুধরে নেবেন। আবার ভেবেছি তিনি নিজেও ষড়যন্ত্রের শিকার হতে পারেন। স্বার্থে আঘাত লাগায় কোন গোষ্ঠী এসব করাতে পারেন। আবার তাঁর সাফল্যে ঈর্ষা পরায়ন হয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানও এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। যাই হোকনা কেন পত্র প্রেরকদের এটাই বলবো যে,এভাবে নিজেদের রক্ষা করা খুব সহজ হবেনা। তিনি তোমাদের দুর্বল ভাববেন, বোকা ভাববেন। কাজেই তোমাদের তাঁর সামনা-সামনি দাঁড়াতে হবে। তোমাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি/স্থানীয় থানা/স্থানীয় আদালতে গিয়ে সমস্যার সমাধান চাইতে হবে। সে মানুষটিকে সবার সামনে হাজির করতে হবে তবেইনা এসব মুখোশধারীরা জঙ্গলে পালাবে। তারপরেও তোমাদের সাধুবাদ জানাই তোমাদের গৃহিত পদক্ষেপের জন্য। কারণ, বাংলাদেশের সব মেয়েরা এ প্রতিবাদ টুকু করার যোগ্যতা রাখেনা। তোমাদেরও বুঝতে হবে লেখকরা কিন্তু আদালতের বিচারক নন। রায় দেয়ার এখতিয়ার তাঁদের নেই। লেখকদের কিছুবিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। লেখকদের কাজ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা। জনমত সৃষ্টি করা। অপরাধী হিসেবে চিহিৃত করে শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র আদালতেরই। কাজেই উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণসহ তোমাদেরকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তোমরা জেনে খুশি হবে যে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ সম্প্রতি মন্ত্রীসভা সংশোধন করেছে (১২ অক্টোবর ২০২০)। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদ্যোগেই এটি হয়েছে। যৌন নিপীড়কদের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে বাড়িয়ে মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। এটি কার্যকরী হয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। দানবদের হাত হতে রেহাই পেতে আইনের পাশাপাশি যৌন নিপীড়ন বিরোধী সামাজিক আন্দোলনও অব্যাহত রাখতে হবে। হায়েনাদের আর বাড়তে দেয়া যাবেনা। ওগুলিকে থামাতেই হবে। ভয় নেই। তোমরা কেন ভয় পাবে? লোক-লজ্জার ভয়? ভয় তো পাবে অন্যায়কারী। মাত্রএকবার সাহস করে তোমরা রুখে দাড়াও। দেখবে পালানোর পথও পাবেনা তাঁরা। মনে রেখো, ফাইনাল পরীক্ষায় তোমাদের ফেল করানোর ক্ষমতা বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানেরই নেই। তোমাদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তোমাদেরই তার দায় নিতে হবে। এটিও ভেবে দেখো। কোন সম্মানি ব্যক্তির সম্মান হানির জন্য মানহানির মামলাসহ ফৌজদারি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কতিপয় ধারা তোমাদের মোকাবেলা করতে হবে। কোনভাবেই যেন তোমরা কারো দাবার গুটিতে পরিণত না হও। সে দিকে খেয়াল রেখো। তোমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, আইন আদালতের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রমাণযোগ্য সত্যই সত্য। আর সব মিথ্যা। যদি সাহস করতে না পারো তাহলে কৌশলে নিজেদের রক্ষা করে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে যাও। প্রাকৃতিক বিচারের উপর ভরসা রাখো। সে বিচারের হাত হতে কারোরই রেহাই নেই। অহেতুক নিজেকে ঝামেলায় ফেলোনা। জানিনা এখন তোমরা কেমন আছো। করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলো। ভালো থেকো তোমরা। বিদায় ২০২০। নতুন বছরটি তোমাদের ভালো কাটুক। সবার সুন্দর কাটুক।
শ্যামল কুমার সরকার : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, মানিকগঞ্জ জেলা শাখা।