পারুলের দুরন্তপনা/ জান্নাত চাঁদনী

গল্পটি ষাটের দশকের দিকের। মফস্বলের একটা ভাড়া বাড়িতে পারুলের জন্ম। একুশটা রুম দিয়ে একটা বিশাল টিনশেড বাড়ি যেখানে একুশটি পরিবার বসবাস করে। মাঝখানে অনেক বড় উঠান। এই এক বাড়িতেই পারুলের বেড়ে ওঠা আর বিয়েও হয় এ বাড়ি থেকেই।

পারুলরা পাঁচ ভাইবোন ও বাবা-মা নিয়ে ওদের সংসার। বড় একভাই এরপর এক বোন তারপর পারুলের অবস্থান। আর পারুলের পরে ছোট দুই ভাই। পারুলের মা একজন গৃহিণী।

আর পারুলের বাবা একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। মুটামুটি ভালোই চলে যায় ওদের দিনকাল। পারুলের বাবা খাবারের বেলায় খুবই সৌখিন একজন মানুষ। বাজারের সেরা জিনিসটা উনি ছেলেমেয়েদের জন্য কিনে আনেন।

তবে খেতে বসে পারুলের মাকে তিনি বলেন মেয়েদের প্লেটে মাছের মাথা আর মাংসের বড় পিসটা তুলে দিতে। উনার বক্তব্য হচ্ছে, ছেলেরা বড় হয়ে রোজগার করে ভালো ভালোটা খেতে পারবে, কিন্তু মেয়েরা শ্বশুর বাড়ি যেয়ে খেতে পারবে না। অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন পারুলের বাবা। তিনি মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসতেন। আর পারুলকে যেন একটু বেশিই ভালোবাসতেন। পারুলের মায়ের আবার এত আহ্লাদ পছন্দ হতো না। তারপরও স্বামীর মুখের উপর তিনি কিছু বলতে পারতেন না।

পারুল ছিলো অত্যন্ত দুরন্ত। সারাক্ষণ সাথীদের সাথে খেলা আর ঘুরে বেড়ানোই ছিলো তার কাজ। মায়ের রাগারাগির জন্য মাঝেমাঝে সংসারের কিছু কাজ, ছোট ভাইদের দেখাশোনাও করতো। পড়াশোনা নিয়ে তখনকার সময় তেমন চাপ ছিলো না। স্কুলে যাতায়াত করতো। বাড়িতে পড়লে পড়লো, না পড়লে নাই।

পারুল ছিলো খুব জেদি টাইপের একটা মেয়ে। মায়ের সাথে রাগ করে মাঝেমাঝে দুই তিনদিন না খেয়ে থাকতো। ওর বাবা হাতে পায়ে ধরে তারপর খাওয়াতো। ওর জেদ কমানোর জন্য ওর বাবা যার কাছে যেটা শুনতো সেটাই করতো। তাবিজ-কবজ, গাছান্তো ঔষধ এমনকি একদিন গরুর গোবর দিয়েও পারুলকে গোসল করানো হয় শুধুমাত্র ওর রাগ কমানোর জন্য। কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

একদিন ওর একবছরের ছোটভাই হঠাৎ ওর কাছ থেকে নিচে পরে ব্যাথা পেয়ে যায়। ও তখন খুব ভয় পেয়ে লুকিয়ে যায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায় পারুলের কোন হদিস নেই। ওর মা পারুলের বাবাকে খবর দেয়। ওর বাবা এসে এলাকার যত পুকুর আছে জাল ফেলে খুঁজে, তারপর রিক্সা নিয়ে এলাকায় মাইক মেরে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির। কিন্তু পারুলের কোন দেখা নাই। ওর ছোটভাই সন্ধ্যার দিকে ঘুমালে শুইয়ে দিয়ে সিন্দুকের উপর থেকে ওর মা লেপ আনতে (তখন শীতকাল ছিলো) যায়। লেপ আনতে যেয়েতো ওর মা হতভম্ব। লেপের ভাঁজের ভেতর পারুল ঘুমিয়ে আছে। সকাল থেকে সারাদিন সে লেপের ভেতরেই ছিলো।

পারুলের বয়স তখন আট/নয় বছর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। পারুলের পরিবার নিয়ে ওর বাবা একটা গ্রামে আশ্রয় নিলো। ওখানেও পারুলের দুরন্তপনার কমতি ছিলো না। একদিন সে জলপাই গাছের উঁচু ডালে বসে জলপাই খাচ্ছিলো। এমন সময় পাকবাহিনী বিমান থেকে বোমা ছুড়ে দিলো নিচে। আর পরিবেশ ঠান্ডা হওয়ার পর পারুলের বাবা-মা পারুলকে গ্রামের খোলা এক টয়লেটের কূপে আবিষ্কার করলো। তারপর তাকে নদীর পানিতে ধুয়ে স্বরুপে ফিরিয়ে আনা হলো। এভাবেই চলছিলো পারুলের দুরন্তপনার দিনগুলো…

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। পারুলরা আবার তাদের শহরের সেই ভাড়া বাড়িতে এসে উঠলো। পারুলদের বাড়ির পাশেই রেললাইন ছিলো। রেললাইন এর পাশে বসে পারুল মাঝেমধ্যে খেলা করতো। একদিন সে রেললাইন এর পাশে বসে খেলা করছে এমন সময় একজন লোক এসে বললো, আমি তোমার বাবার বন্ধু চলো বাজার থেকে তোমাকে খেলনা কিনে দেই।

পারুল আসলে যতটা দুরন্ত ছিলো ঠিক ততটাই বোকা ও সহজসরল ছিলো। খুব সহজেই যে কাউকে বিশ্বাস করতো। তো সে সরল মনেই লোকটার সাথে যেতে লাগলো। এমন সময় দূর থেকে ওদের বাড়ির একুশ পরিবারের মধ্যে এক পরিবারের একজন চাচা খেয়াল করলো, পারুল কোন এক অচেনা মানুষের সাথে কোথায় যেন যাচ্ছে।

তাই সে একটু আড়াল হয়ে পারুলদের পিছু নিলো। কারণ ঐ চাচার পারুলের সাথে থাকা লোকটির ভাবভঙ্গি ভালো লাগছিলো না।
আসলে কথায় আছে না চোরের মন পুলিশ পুলিশ। সেটা তার হাবভাবে বুঝা যাচ্ছিলো। আর ঐ চাচা জানতো পারুল একটু জেদী হলেও সে আসলে বোকা টাইপের একটা মেয়ে। তাই ওর যেন কোন ক্ষতি না হয় তাই পিছু নেয়া। কারণ, পারুলদের বাড়ির সকলেই পারুলকে ভীষণ ভালোবাসতো।

অচেনা লোকটি পারুলকে কি বলে যেন বাজার পার হয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখন ঐ চাচা পারুলের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। আর ঐ লোকটা ভয় পেয়ে তারাতাড়ি ওখান থেকে কেঁটে পড়ে। পারুলের মা পারুলকে অনেক বুঝায়, বুঝে শুনে চলার জন্য। কে শুনে কার কথা। পারুলের দুরন্তপনা যেন কোন বুঝেই থামতে চায় না। পারুলের বায়নার কোন শেষ নেই।

বছর শেষে যখন ঈদ আসে তখন ঈদের মার্কেট করতে পারুলের বাবা অন্য কাউকে নিক আর না নিক পারুলকে সঙ্গে নিতেই হবে। কারণ, পারুলের পছন্দ মতো যদি জামা কিনে না দেওয়া হয় তবে বাড়িতে তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে। কারো আর শান্তি মতো ঈদ করা হবে না। আর পারুলের বাবা পারুলের ভালোবাসায় অন্ধ ছিলেন। কোন কারনণই পারুলের মনে কষ্ট দেয়া চলবে না। পারুলের বাবা যেহেতু ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই পুরো রমজান মাস ব্যবসা করে চাঁদ রাতে পারুলকে নিয়ে মার্কেটে যেতেন সবার জন্য জামাকাপড় কিনতে। পারুলের বড়বোন ছিলো পাপিয়া। দু’জনের জন্যই জামা কিনে আনা হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বাড়িতে আসার পর পারুলের নিজে পছন্দ করা জামাটা আর পছন্দ হতো না। তখন পাপিয়ারটা নিতে চাইতো। পাপিয়াও ছোটবোনকে এতটাই ভালোবাসতো ওর নিজের জামাটাও ছোটবোনকে দিয়ে দিতো। বড়বোনের যে মন খারাপ হতে পারে সেদিকে পারুলের কোন ভ্রক্ষেপই ছিলো না। ওর কাছে নিজের জেদটাই সবচেয়ে বড় ছিলো।

একবছরের ঈদে একটা বিপত্তি ঘটে গেলো। হঠাৎই ঈদের আগে পারুলের জলবসন্ত উঠে গেলো। আর তখনকার সময় কারো জলবসন্ত হলে সেই পরিবারকে একঘরে করে দেয়া হতো। কারণ খুব ছোঁয়াচে রোগ ছিলো এটা। তাই এর নাম শুনলেই মানুষ খুব ভয় পেতো। এতটাই ভয়াবহ ছিলো এই রোগ।

পারুলের পরিবারের ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে গেলো। ঈদের দিন পারুলের বাবা-মা পারুলকে ঘরে তালা দিয়ে রাখলো। আর পারুলের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস কম্পিত হলো। পারুলের সাথে ওর বাবা-মা, ভাইবোনও কান্না করলো। পরে অবশ্য পারুল সুস্থ হয়ে নতুন জামা পরে আনন্দ করেছিলো।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে পারুলের বোন পাপিয়ার বিয়ে হয়ে যায় ওদের পাশের এক জেলায়। পাপিয়ার স্বামীর বাড়িতে যেতে হলে পারুলদের ট্রেনে করে যেতে হয়। পাপিয়ার বিয়ের পর পারুলের খুব মন খারাপ থাকে বোনের জন্য। তাই মাঝে মাঝে পারুলের বাবা পারুলকে নিয়ে পাপিয়ার বাড়িতে ঘুরে আসেন। একদিন পারুল বেখেয়ালি হয়ে হাটছিলো, এমনসময় ওর মায়ের পছন্দের একটা বাটি ওর ধাক্কা লেগে ভেঙে যায়।

আর ওর মা এটা দেখে অনেক বকাঝকা শুরু করে। বকা খেয়ে পারুল রাগে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। আর ভাবতে থাকে আর কিছুতেই সে বাড়ি ফিরবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। সে সোজা স্টেশনে চলে যায়। আর তার বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে যায় এমন একটা ট্রেনে উঠে পড়ে। যেহেতু আগেও বাবার সাথে গিয়েছে, তাই ট্রেন চিনতেও অসুবিধা হয়না। কিন্তু সেতো সাথে টাকা নিয়ে আসেনি। ট্রেনের টিটি আসলো টিকেট চেক করতে। কিন্তু হায়! সেতো কোন টিকিটই করেনি।

তবে পারুলের ভাগ্য খুব ভালো ছিলো ওর পাশের সিটে বসা এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওর অবস্থা বুঝে ভাড়া দিয়ে দিলো। ও খুব সহজেই পাপিয়ার বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঐদিকে পারুলকে খুঁজে খুঁজে তার বাবা-মা দিশেহারা।

ব্যবসার জন্য ওরা নিজের স্হায়ী বাসস্থান ছেড়ে ভাড়া বাড়িতে থাকে। তাই কাছাকাছি কোন আত্মীয়স্বজন নেই। পারুলের বাবার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত সবার কাছেই খোঁজ নিলো, পারুল কোথাও নেই। তখনকার সময় এত অহরহ ফোনও ছিলো না। তাই বাধ্য হয়েই পারুলের বাবা পাপিয়ার বাড়ি ছুটলেন। পরে যা হবার তাই হলো, পারুলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসলেন।

পারুলের নানা দুরন্তপনার মধ্য দিয়েই পারুল তরুণী থেকে যুবতীতে পরিনত হলো। নানাদিক থেকে পারুলের বিয়ের কথা আসতে থাকলো। তখনকার সময় মেয়েদের বয়স ১৪/১৫ হলেই বিয়ে দেয়ার জন্য বাবা-মা প্রস্তুতি নিতে থাকতো। পারুলের ব্যাপারেও ব্যতিক্রম ঘটলো না। তবে পারুলের বাবা খুব চিন্তিত। তার মেয়ে যে জেদী, সে স্বামীর সংসার করতে পারবে তো! তাই পারুলের বাবা কম ভাইবোন, ছোট পরিবার এমন ছেলে খুঁজতে লাগলেন পারুলের বিয়ের জন্য।

একদিন পারুল তার সখীদের নিয়ে রেললাইন এর পাশে থাকা একটা পুকুরে হৈ-হুল্লোড় করে গোসল করছিলো। এমন সময় হঠাৎই তার চোখ আটকে যায় রেললাইন এর উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক লোকের উপর। লোকটির পরনে ছিলো আলখাল্লা ধরনের পোশাক। ঐ আমলের ডিভাইডার টাইপের প্যান্ট অনেকটা এ যুগের প্লাজোর মতো! সাথে ছিলো লম্বা চেকের শার্ট। মাথায় বড় বড় চুল। অনেক লম্বা। কাওয়ার ঢ্যাং বগার ঢ্যাং এর মতো করে হেঁটে যাচ্ছিলো। পারুলতো লোকটাকে দেখে হেসেই কুটিকুটি। লোকটাকে সখীদের দেখাচ্ছে আর হোহো করে হেসেই চলেছে। কিছুতেই যেন তার হাসি থামছে না।

ঠিক দু’দিন পর পারুলের বাড়িতে সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন লোক আসলো। আর পারুলের মা পারুলকে সাজিয়ে তাদের সামনে নিয়ে গেলেন। পারুল তখনো বুঝতে পারছে না তার জীবনে কি হতে চলেছে। তবে লোকগুলোর সামনে যেয়ে পারুল তব্দা মেরে গেলো। একজন বয়স্ক মহিলা আর সাথে কয়েকজন ছেলেমানুষ। সেই ছেলেমানুষদের মধ্যে দু’দিন আগে রেললাইনের উপর দেখা সেই আলখাল্লা লোকটিও আছে। ভাগ্যের লিলাখেলায় সেই লোকের সাথেই তার বিয়ে হয়ে গেলো!

Facebook Comments Box
ভাগ