ডা. অপূর্ব চৌধুরী
বছরে কত লোক মারা যায় গোটা পৃথিবীতে? ৬৫ মিলিয়নের মতো। বছরে কতগুলো মানুষের বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে? ঠিক তার ডাবল, ১৩০ মিলিয়নের মতো।
প্রতি মিনিটে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে ২৫০ টি শিশু। প্রতি মিনিটে কত জন মানুষ মারা যায়, জানেন? প্রায় ১২০ জন।
প্রতি ঘন্টায় মানুষ মারা যায় প্রায় সাড়ে সাত হাজার। প্রতিদিন গোটা পৃথিবীতে মরে যায় প্রায় পৌনে দুই লক্ষের মতো। তার মানে যে বাক্যটি পড়ছেন, যে শব্দটি পড়ছেন, সেটি পড়তে যদি এক সেকেন্ড লাগে, সেই এক সেকেন্ডে পৃথিবীতে ২ জন মানুষ মারা যাচ্ছে।
জন্মটা আবার ঠিক তার বিপরীত। প্রতি সেকেন্ডে জন্মে চারজনের বেশি। প্রতি সেকেন্ডে মরে যায় ২ জন। তার মানে, প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীতে মানুষ বেড়ে যায় ২ জন বেশি।
রাতের খাবার শেষে হেঁটে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কি করে যেন ঘুম ভেঙে গেলো। কেন ভেঙে গেলো জানি না। হঠাৎ মনে হলো, জন্মটা কত সহজ। কারণ, জন্মের সময়টি বুঝের আওতায় থাকে না। যা দেখি না, তার সহজ কঠিনের হিসেবে জানা থাকে না, কিন্তু মৃত্যুটি থাকে। মৃত্যুটি নিজ হাতে যেন দেখতে পাই, মৃত্যুর কাছাকাছিটা নিজেরাই দেখতে পাই। নিজেদের জন্ম নিজেরা দেখি না, কিন্তু মৃত্যুটি যেন দেখি। মৃত্যুর কাছাকাছি বসে থেকে নিজেদের দেখতে পাই।
উঠে চা বানালাম। হারবাল টি। সাথে ডার্ক চকলেট। অনেকসময় লেখা একটি ভালো ওষুধ। লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে যাই।
লিখতে বসলাম মৃত্যু নিয়ে।
প্রথম প্যারাটি লিখে ফোনের স্টপ ওয়াচ ধরে পরীক্ষা করে দেখলাম, উপরের প্যারাগ্রাফের শুরুর শব্দ ‘বছর’ থেকে শেষের শব্দ ‘২ জন’ পড়তে সময় লেগেছে ৪৮ সেকেন্ড। হিসেবে করলাম, ততক্ষণে ১৯২ জন শিশু পৃথিবীতে এসে গেছে, ৯৬ জন মানুষ পৃথিবীর কোথাও না কোথাও মরে গেছে। পাশে আরো নতুন ৯৬ জন মানুষ যুক্ত হয়েছে। অদ্ভুদ এক জীবন চক্র।
সংখ্যাগুলোর ভগ্নাংশ হিসাব না লিখে মোটা দাগের একটি পূর্ণ সংখ্যা লিখবো হিসাবগুলো সহজে বুঝতে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হার্টের সমস্যার কারণে। প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ। এরপরে সবচেয়ে বেশি মারা যায় ক্যান্সারে। সকল ধরনের ক্যান্সারে প্রতি বছর মারা যায় ১০ মিলিয়নের মতো। তৃতীয় মৃত্যুর কারণ ফুসফুসের সমস্যা। ফুসফুস রোগের কারণে বছরে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়।
চতুর্থ মৃত্যুর কারণটি খুব ইন্টারেস্টিং। অনেকে ভাবতেই পারবেন না। কারণ, হিসেবগুলো একজায়গায় না করলে এমন মজার জিনিসগুলো চোখে পড়ে না। চতুর্থ যে কারণে বছরে প্রায় তিন মিলিয়নের কাছাকাছি মানুষ মারা যায় তা হলো, Dementia. এটির মানে হলো, স্মৃতিভ্রংশ রোগ!
এর পরে পঞ্চম, ষষ্ট, সপ্তম এবং অষ্টমে আছে যথাক্রমে : পেটের সমস্যা, ডায়াবেটিস, লিভার এবং কিডনির রোগ। প্রতিটিতেই এক মিলিয়নের বেশি থেকে দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ মারা যায়।
নবম মৃত্যুর কারণ, সড়ক দুর্ঘটনা। রোড একসিডেন্টে বছরে মারা যায় ১.২ মিলিয়নের মতো। দশম, একাদশে আছে : যক্ষা রোগে ১ মিলিয়নের মতো এবং তার পরেই এইডস রোগে মারা যায় এক মিলিয়নের চেয়ে কম প্রতি বছরে।
বছরে ৮ লক্ষ মানুষ সুইসাইড করে পৃথিবীতে। সামাজিক বা কোনো কারণে বছরে ৬ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়। প্রথমটা Suicide, পরেরটাকে বলে Homicide.
বছরে তিন লক্ষ মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, কিন্তু না খেয়ে পুষ্টির অভাবে মারা যায় আড়াই লক্ষ মানুষ। যদিও পুষ্টির অভাবজনিত মৃত্যুর হিসেবটি একটু গড়বড় আছে হয়তো।
শুধু অত্যাধিক মদ খেয়ে মারা যায় দেড় লক্ষের উপরে। আবার ভুল কিংবা বেশি ওষুধ খেয়ে মারা যায় দেড় লক্ষের কম।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো না কোনো যুদ্ধ লেগেই আছে। এইসব যুদ্ধে বছরে মারা যায় প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে আগুন লেগে বছরে মারা যায় এক লক্ষের বেশি মানুষ।
আত্মহত্যা নয়, কিন্তু ভুল করে অথবা খাদ্যের বিষ ক্রিয়ায় বছরে সত্তর হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। গরম কালে গরমে পুড়ে এবং শীতকালে শীতে জমে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ প্রতিবছর মারা যায়।
দ্বিতীয় সবচেয়ে কম মানুষ মারা যায় কিসে জানেন? উত্তরটি বলার আগে একটা সূত্র দেই যে, বছরে কোন খবরটি সবচেয়ে বেশি জুড়ে থাকে কাগজে! উত্তর হলো, টেরোরিজম। ওর্য়াল্ড টেরোরিজম। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন টেরোরিস্ট সংগঠনের কথা, বিশেষত এই শতকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পশ্চিমের অযথা বিদ্বেষ এবং বিষেদগার ভরা নিউজ অত্যাধিক থাকে। পানিতে ডুবেও যত মানুষ মারা যায় পৃথিবীতে প্রতি বছর, টেরোরিস্টদের হাতে মারা যায় তার দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র। প্রতিবছর যে কোনো ধরনের টেরোরিজমের কারণে মাত্র পঁচিশ হাজার মানুষ মারা যায় সারা পৃথিবীতে। অথচ লিড খবরের এক চতুর্থাংশ এই পশ্চিমা মিডিয়ার তৈরী নিউজ হিসাবে থাকে টেরোরিস্টদের কর্মকান্ডের খবর!
সবচেয়ে কম মারা যায় কিসে? ভাবুন তো মনে মনে। জানি, মাথায় আসবে না। সবচেয়ে কম মানুষ মারা যায় প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা : ঝড়, ভূমিকম্প, সাইক্লোন কিংবা বন্যার কারণে! এসব কারণে মারা যায় মাত্র দশ হাজারের মতো বছরে।
পৃথিবীতে এখন মানুষ আছে আট বিলিয়নের কাছাকাছি।
বারো মাসে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা যায় ৬৫ মিলিয়ন। জুলাই মাসের আজকে পর্যন্ত ২১৬ টি দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন পাঁচ লক্ষের বেশি। হয়তো বাকি ছয় মাসে আরো পাঁচ লক্ষ মারা যেতে পারে। বারো মাসে করোনার কারণে মৃত্যু গিয়ে দাঁড়াবে দশ লক্ষ বা ১ মিলিয়ন।
৬৫ মিলিয়ন মৃত্যুকে স্বাভাবিক ধরে ১ মিলিয়ন মৃত্যুকে থামাতে ৮ বিলিয়ন মানুষের জীবন স্তব্দ হয়ে আছে।
সূত্রঃ
1. The Lancet : The Global Burden of Diseases Study
2. World in Data : Cause of Death by Hannah Ritchie & Max Roser
3. WHO – World Health Organization
4. Scientific American
অপূর্ব চৌধুরীঃ চিকিৎসক এবং লেখক। জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড। গ্রন্থ ৭। উল্লেখযোগ্য বই: অনুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত ।