যাত্রা উৎসব ও একজন মৃণাল কান্তি ঢালী
শ্যামল কুমার সরকার
জন্ম তার ১ জানুয়ারি ১৯৬৯। পিরোজপুর জেলার স্বরূপডাকী উপজেলায়। পিতা-মাখন লাল ঢালী (প্রয়াত), মাতা- প্রিয়বালা ঢালী (প্রয়াত)। ১৯৮৪ সালে তিনি বিজ্ঞান বিভাগ হতে প্রথম বিভাগে এস এস সি এবং ১৯৮৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগ হতে প্রথম বিভাগে এইচ এস সি পাস করেন। ১৯৯৬ সালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল হতে এমবি বি এস ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অপথালমোলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ২০০৮ সালে পেডিয়েট্টিক অপথালমোলজির উপর ভারত হতে ফেলোশীপ লাভ করেন। তিনি একজন স্বনামধন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সার্জন।
বলছিলাম ডাঃ মৃণাল কান্তি ঢালীর কথা। যিনি সহকারী অধ্যাপক (চক্ষু) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ময়নামতি মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লায়। এছাড়া তিনি ফেকো এন্ড আই হসপিটাল, কুমিল্লার প্রশিক্ষণ ফ্যাকাল্টির অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া ডাঃ মৃণাল ঢালী তার নিজ প্রতিষ্ঠান ‘অমি আই কেয়ার হাসপাতাল’, কুমিল্লা’র নির্বাহী পরিচালক। তিনি জীবন সদস্য- বিনমন।
এতো গেল একজন ডাঃ ঢালীর কথা। কিন্ত আমার আলোচনা ডাঃ ঢালীকে নিয়ে নয়। আমার কথাগুলো একজন গীতিকবি, সংগঠক, অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক কর্মী মৃণাল কান্তি ঢালীকে নিয়ে। ডাক্তারী পেশার ভালো উপার্জনে ঢালীবাবু খুব আরাম আয়াশই কাটাতে পারতেন তার জীবন। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। আর তেমনটি হলে হয়তোবা মৃণাল কান্তি ঢালী আজকের ঢালী হতেন না। যে ঢালী কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গন তথা গোটা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মহলেরও একটি আলোচিত নাম। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি স্বরপ ২০১৬ সালে ‘পদক্ষেপ বাংলাদেশ’ এর গীতিকবি ও সংগঠক হিসেবে বিশেষ সম্মাননা ও ভারতের ডায়মন্ড হারবার হতে ২০১৮ সালে ‘কুসুমের ফেরা সাহিত্য পরিষদ’ সম্মাননা পেয়েছেন। ইতোমধ্যে তার ছয়টি কথাকাব্য গ্রন্থ ‘কুয়াশা ভেদি রবির আলো’, ‘আঁধার রাতের জোনাকি’, ‘বৃষ্টিভেজা মেঠোপথ’, ‘স্মৃতির পাতায় চেতনার লেখা, ‘অবশেষে তুমি এলে বধুবেশে’ ও ‘স্বপ্নে জাগা চোরাবালুর পথ’ প্রকাশিত।
কাব্যচর্চার পাশাপাশি মিঃ ঢালী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেছেন। তিনি ‘সমাজ চেতনা মঞ্চ’ কুমিল্লা’র আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও যুক্ত আছেন সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), কুমিল্লা এবং টি আই বি কুমিল্লা’র সাথে। কালীপদ মেমোরিয়াল কালচারাল একাডেমি, কুমিল্লা’র তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি জীবন সদস্য- কুমিল্লা কালচারাল কমপ্লেক্স, সদস্য- নজরুল পরিষদ, কুমিল্লা এবং গীতিকার, বাংলাদেশ বেতার। রোটারিয়ান-পিএইচএফ-রোটারী ক্লাব অব কুমিল্লা। তিনি জীবন সদস্য-নবাব ফয়জুন্নেছা ফাউন্ডেশন, কুমিল্লা’র।
এ মহাজনের এত কীর্তির কথা আমার জানা হলো মাত্র ২০২০ এর জানুয়ারিতে। কালীপদ মেমোরিয়াল কালচারাল একাডেমি, কুমিল্লা আয়োজিত যাত্রা উৎসব-২০২০ (৩-৫ জানুয়ারি) এ আমন্ত্রিত একজন অতিথি হিসেবে কুমিল্লার বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তনে (টাউনহল) উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ‘আর্তের হুংস্কারে শয়তানের নাভিশ্বাস’ থিম বিশিষ্ট উক্ত আয়োজনের প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক ছিলেন কুমিল্ল-৬ আসনের জননন্দিত নেতা, মাননীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আ. ক. ম বাহাউদ্দিন বাহার। প্রধান অতিথির পাশাপাশি বসে কথা বলছিলাম তার সাথে আর দেখছিলাম সংসদ সদস্যের সাথে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের ছবি উঠানোর উচ্ছাসময় দৃশ্য। সত্যিই এমন দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে প্রধান অতিথিকে বলেছিলাম, আপনি তো দেখছি হিরো অমিতাভ বচ্চন। তিনি মুচকি হেসে মোবাইলে থাকা তার আগের ছবি (কুমিল্লার মেয়র থাকাকালে) দেখালেন। এমপি সাহেবের সে সময়ের পোশাক ও দেহের গড়ন একেবারেই যেন বলিউডের বচ্চন! কীভাবে আমার মনের কথা বাস্তবে মিলে গেল।
যাহোক, তিন দিন ব্যাপী যাত্রা উৎসবের পুরোটায় আমি থাকতে পারিনি। উদ্বোধনী সন্ধ্যা ও রাতের টাউন হল এখনও আমার মনে আচমকা চলে আসে। এখনো দেখতে পাই কান্দিরপাড়ের হোটেল সোনালীতে কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার, মনি হায়দার ও নজরুল গবেষক পীযূষ ভট্টাচার্য্যের সাথে আড্ডার কথা। সকালে হোটেলে একসাথে নাস্তার দৃশ্য। নজরুল গবেষক পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্য আমাকে জানিয়েছেন, একদল নাট্যকর্মীর টানা দেড় বছরের পরিশ্রম এবং মৃণাল কান্তি ঢালীর একক প্রচেষ্টার পনের লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয় সাধের যাত্রা উৎসব-২০২০।
উৎসব চলাকালে মৃণাল কান্তি ঢালী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন। তিনি বর্তমানে সুস্থ। আবার পেশা ও নেশার কাজ পুরোদমে করে চলেছেন। বিলুপ্তপ্রায় যাত্রাশিল্পকে বাঁচাতে নিজ উপার্জনের পনের লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করার সাহস থাকাটা চাট্টিখানি কথা নয়। এমন একজন আলোকিত মানুষকে চেনা ও জানার সুযোগ দান করায় গুনীজন পীযূষ কুমার ভট্টাচার্য্যের কাছে আজীবন ঋণী হয়ে গেলাম। আশা করি সংস্কৃতিমনা ও জনবান্ধব স্থানীয় এমপি আ. ক. ম বাহা উদ্দিন বাহার আগামীতেও মৃণাল কান্তি ঢালীর পাশে থাকবেন। পাশে থাকবেন কুমিল্লার সাংস্কৃতিক কর্মীরা। ঢালীদার সুযোগ্য সহধর্মিনী ও সাংস্কৃতিক কর্মী অনামিকা দেব সহ পরিবারের সবার দীর্ঘ জীবন ও সুস্থতা কামনা করি। শিল্প, সংস্কৃতি বেঁচে থাকুক। বেঁচে থাকুক প্রিয় দাদা, এর ধারক- বাহকরা। জয় হোক মৃণাল কান্তি ঢালী’র। টিকে থাকুক আমাদের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্প!
শ্যামল কুমার সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, ঝিটকা খাজা রহমত আলী কলেজ, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ।