আজ বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস। তার ভাষায়ই বলতে হয়, ” আমি কী বলে করিব নিবেদন।” শেষ পর্যন্ত ভেবেছিলাম, অন্তত ঘরোয়া পরিবেশে হলেও দিনটিতে তার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করবো। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি না হওয়ায় সেটি সম্ভব হলো না। নিশ্চয়ই আমরা পরে অনুষ্ঠানটি করবো। কিন্তু তিনিতো আমাদের নিত্য স্মরণীয়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সকল কাজে সকল অনুভূতিতে তিনি বিরাজমান। তিনি ভাষা দিয়েছেন আমাদের সুখ দুঃখের মুহূর্তের,ভাষা দিয়েছেন নির্মল আনন্দের, ভাষা দিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদের,ভাষা দিয়েছেন বিপদে সংকটে সান্ত্বনার,আশা ও ধৈর্যের ভাষা দিয়েছেন জীবনের চরম হতাশার মুহূর্তের।
মানবিকতা, উদারতা, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং বিশ্ব সৌভ্রাতৃত্বের অমর বাণী উচ্চারিত হয়েছে তার কন্ঠে। তার প্রতিভার বহুমাত্রিক প্রকাশ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাড়াবার অফুরন্ত শক্তি।
তার পরিচয় কেবল কাব্যে গানে নয়, তার হাতও ছিল কর্মীর হাত। তিনি তার জমিদারি এলাকায় উন্নত চাষাবাদের নিরন্তর গবেষণা ও অনুশীলন করেছেন। প্রজাদরদী এই কবি জমিদার দুই হাতে অর্থ খরচ করেছেন প্রজা কল্যাণে।
রবীন্দ্রনাথ কোন কল্পলোক বিহারী সন্ন্যাসী ছিলেন না। আমরা অনেকেই তাকে খুব ভুল বিবেচনা করি। তিনি জমিদার পুত্র ছিলেন। আমরা সাধারণেরা অনেকেই মনে করি তিনি আরাম-আয়েশে দিন কাটিয়েছেন আর অলীক কল্পনার কাব্য চর্চা করেছেন। চিন্তাটি যে কতটা ভ্রান্ত তা তার জীবনের প্রতিদিনের দিনপঞ্জী থেকে আমরা জেনে নিতে পারি। তার জীবন ছিল কর্মময় এক যোগীর জীবন,যার চিন্তা মাটি এবং আকাশ দুটোকেই স্পর্শ করেছে। তাইতো তিনি বলেছেন,
বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়
অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ মহানন্দময়।
পৃথিবীর অনেক বড় মানুষও এই দুটোর মধ্যে সমন্বয় করতে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সফলভাবে তার জীবন দিয়ে এটি সম্ভব করেছেন। তিনি লবন লঙ্কার সংসারও বিস্মৃত হননি,সমাজ সংসার,রাজনীতি,অর্থনীতি থেকে তিনি যেমন মুখ ফিরিয়ে রাখেননি,তেমনি পারিবারিক জীবনে তিনি পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলের খুঁটিনাটি বিষয়ে খোঁজখবর রাখতেন দশাননের মতই। আবার এই তিনিই রাতের গভীরে হারিয়ে যেতেন আধ্যাত্মবাদের কোন উর্ধলোকে, সেখান থেকে তিনি আমাদের মর্তের মানুষের জন্য নিয়ে আসতেন অনির্বচনীয় ভক্তি আর প্রার্থনার অমৃত বাণী। তার সেসব অমূল্য বাণী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার কাব্যে ও গানে,যেগুলো আমাদের অশান্ত মনকে প্রতিদিন সান্ত্বনায় তৃপ্ত করে রাখে।
মানুষ কেবল খেয়ে পড়ে জীবন ধারণ করে না, তার মননশীলতা, চিন্তাশক্তির পবিত্রতা,পরার্থে কাজ করার হৃদয় বৃত্তির জন্য চিত্তের প্রসারতাও প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তার সমস্ত সাহিত্যে এবং দৈনন্দিন পার্থিব কর্মে সে সাধনাই করে গেছেন আজীবন। এসব কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে গেছেন অনাদিকাল পর্যন্ত।
তাই তার মৃত্যুর এই উনআশি বছর পরেও আমরা শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে তাকে স্মরণ করছি। রবীন্দ্রনাথ তার চৌদ্দশ সাল কবিতায় বেদনা এবং আশঙ্কা প্রকাশ করে করেছেন,হয়তো পরবর্তী শতাব্দীতে এই পৃথিবীর মানুষ তাকে স্মরণ করবে না। শেষ অনুচ্ছেদে গিয়ে তিনি এক প্রকার ব্যাকুল অনুরোধের সুরে বলেছেন,”তবু তুমি একবার, খুলিয়া, দক্ষিণ দ্বার,বসি বাতায়নে,সুদূর দিগন্তে চাহি,কল্পনায় অবগাহি,ভেবে দেখো মনে একদিন শতবর্ষ আগে—–।
আজকে অন্তত এটুকু বলা যায়, কবির আশঙ্কা ষোল আনাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেননা তিনি তার জীবদ্দশায় মানুষের কাছে যতটা স্মরণীয়-বরণীয় ছিলেন,তার অন্তর্ধানে তা বিন্দু পরিমানও স্নান হয়নি। বরং জীবন ঘনিষ্ঠ তার বাণী ও আদর্শ আমাদেরকে আজকের দিনেও স্বপ্নলোকের মতই মোহাবিষ্ট করে রেখেছে।
পরিশেষে আবারো তার এই অন্তর্ধান দিবসে জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, মানিকগঞ্জ জেলা শাখার পক্ষ থেকে তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি।
আবুল ইসলাম শিকদারঃ সভাপতি, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, মানিকগঞ্জ শাখা।