সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে ফিরে দেখা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
রুহুল ইসলাম টিপু
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ৫০ বছরের বাংলাদেশ। ২০২১ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন বছর। ৩০ লক্ষ ভাই-বোনের জীবন উৎসর্গ। ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানি। এ পরিসংখ্যানগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের করে আতঙ্কিত, আমরা হই উৎকন্ঠিত, আবেগ এবং কান্না ধরে রাখা কঠিন হয়ে যায়। উৎসর্গিত এবং ত্যাগী বিশালসংখ্যক এ দেশের মানবজীবনের প্রতিজনের নেপথ্যের ইতিহাস বড় নির্মম, নিষ্ঠুর এবং বেদনার। বিশাল এ ত্যাগের উপর নির্মিত আমাদের স্বাধীনতা, প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের দেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় চুক্তিমূলে স্বাধীন হয় নাই। দেশবাসীকে লড়তে হয়েছে প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। নানাবিধ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। এমনকি দেশের ভিতর অভ্যন্তরীণ শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে। অজ¯্র বিরুদ্ধশক্তি অতিক্রম করেই অর্জিত আমাদের লালসবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ পরিচালনার সুসংগঠিত অধ্যায়সমূহের অন্যতম অর্জন হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং মুজিবনগর সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথগ্রহণ। আজ ১০ এপ্রিল ২০২১ পঞ্চাশ বছর পূর্বের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ফিরে দেখার বড় প্রয়োজন অনুভব করি। সে আলোকেই কড়চা’র পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমার উপস্থাপনা।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এ মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলায় বর্তমান মুজিবনগর এ দেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এতে ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়। আর এ ঘোষণাবলে বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) বৈধ বলে বিবেচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকার পরিচালনার এটি ১ম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ; মুজিবনগর, বাংলাদেশ, তারিখ: ১০ এপ্রিল ১৯৭১।
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং
যেহেতু তিনি আহুত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ^াসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ^াসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে;
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি,
এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং
তাঁর কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং
বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশে^র একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম।
স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী, বাংলাদেশ গণপরিষদের ক্ষমতা দ্বারা এবং ক্ষমতাবলে যথাবিধি সর্বাধিক ক্ষমতাধিকারী।
এ প্রসঙ্গে আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ ১৯৭১ তুলে ধরা হলো, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একই দিনে আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ নামে একটি আদেশ জারি করেন। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল আইন চালু ছিল, তা রক্ষার্থে এটা করা হয়।
প্রসঙ্গক্রমে আমাদের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের যাত্রা শুরু ১১ জানুয়ারি ১৯৭২। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীনতার বিজয় অর্জন করে। আমরা অতীব আনন্দে উদ্বেলিত যে এ বছর বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন করবো। ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ মুজিবনগরস্থ প্রবাসী সরকার স্বাধীন বাংলাদেশে এসে দায়িত্ব নিলেন। তখন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অনুসারেই দেশ পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ১১ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশে অস্থায়ী শাসনতন্ত্র আদেশ জারি করেন। এ শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারির পটভূমিতে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরের ঘোষিত স্বাধীনতার আদেশ ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং যে অবস্থার প্রেক্ষিতে এ স্বাধীনতা আদেশ জারি করা হয়েছিল তার অবসান ঘটেছে। তাছাড়াও এদেশের গণমানুষ সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইচ্ছা পোষণ করেন। ফলে জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষিতে এ ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেছেন। এটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত (বাংলাদেশের প্রকৃত সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত) এই ‘অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ দেশে সংবিধানের কাজ করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনার প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ এর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিবসে শ্রদ্ধা এবং অবনত চিত্তে স্মরণ করি সকল মুক্তিযোদ্ধাদের। একই সাথে দেশ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ সমুন্নত করে সুখী সমৃদ্ধ এবং আত্ম মর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিশ^কে নেতৃত্ব দিবে এটিই সকল নাগরিকের প্রত্যাশা।
(সূত্র: তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা : প্রথম আলো, এপ্রিল ২০২১ এবং সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, মোঃ আব্দুল হালিম, ব্যারিস্টার-এট-ল)
কড়চা/ আর ই টি