অটিজম সচেতনতা দিবস/ রুহুল ইসলাম টিপু

অটিজম সচেতনতা দিবস

রুহুল ইসলাম টিপু

০২ এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস। ২০০৮ সাল হতে বাংলাদেশসহ বিশ্ব পরিমন্ডলে জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। এদিন আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। অটিজমে আক্রান্ত এবং অন্যান্য শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারার উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য এমন এক বিশ্ব পাবো যেখানে বিকশিত হবে অটিজমে আক্রান্ত’র মেধা প্রতিভা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ঘোষণা করে যে এ দিবসে অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নতিতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহ প্রচার প্রসার করতে হবে। এ বছর সারাদেশে বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। জাতীয় দৈনিকে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হচ্ছে। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্মানে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে নীল আলো প্রজ্জ্বলন করে সাজানো হচ্ছে। অটিজম এর উপর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাস্তা ব্র্যান্ডিং, স্মারক ও লিফলেট বিতরণের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

১৫তম অটিজম সচেতনতা দিবসে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বার্তায় এ দিবসের সকল কার্যক্রমের সফলতা কামনা করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি এখন সমাজের বোঝা নয়। পরিপূর্ণ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, নির্দেশনা এবং অনুপ্রেরণায় তারা দক্ষ মানব সম্পদ হিসেবে বিকশিত হবেন। রাষ্ট্রপতি জানান, যে সকল ব্যক্তি এবং শিশুরা অটিজম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় তাদের জন্য সকলকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, সরকার ইতোমধ্যে অটিজমে আক্রন্ত ব্যক্তিদের কল্যাণে প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানামূখি সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে; নিউরো ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্ট গঠন এর অন্যতম একটি। প্রধানমন্ত্রী যুক্ত করেন, অটিস্টিক ব্যক্তিদের সহায়তায় গ্রহণ করা হয় ‘বলতে চাই’ এবং ‘অটিজম বার্তা’ শিরোনামে কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, অটিজমে আক্রান্ত শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পরিপূর্ণ সেবা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং স্নেহের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠবেন। ফলশ্রুতিতে তারা হবেন পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সম্পদ।

অটিজম সচেতনতা দিবসে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। নতুনভাবে আশা জেগে উঠে আমার। শ্রেয়া’র বয়স ২৪ বছর। দীর্ঘ সময়। আমি একটি অটিস্টিক পরিবারের প্রধান ব্যক্তি। কন্যা শ্রেয়া অটিজমে আক্রান্ত এ সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই আমি এবং আমার স্ত্রী নানাবিধ বাধা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে দিন মাস বছরাতিপাত করছি। পরিবারে যুক্ত হয় অপর দুই কন্যা। তারাও কঠিন সমস্যাকে প্রাতহ্যিক জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে একটি ফোন পাই চয়নের মা’য়ের নিকট হতে। চয়ন অটিজমে আক্রান্ত। বয়স ২২। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে বাড়ি। চয়ন এর বাবা ঢাকার মিরপুরে পরিবারসহ বসবাস করতেন। প্রায় ২ বছর হয় চয়নের বাবা চন্দন মারা যান। আয় উপার্জনের সকল পথ বন্ধ। চয়ন প্রতিবন্ধী ভাতা পেতেন ঢাকায় থাকাকালীন। এখন মানিকগঞ্জ শহরে বসবাস করেন। জানা যায় বেশ মানবেতর জীবন তাদের। প্রতিবন্ধী ভাতা স্থানান্তরের কাজটি করতে পারেন নি। তাই মাসিক ভাতাপ্রাপ্তিও বন্ধ।

একজন অটিজমে আক্রান্ত মানব-মানবী’র সাথে শারীরিকভাবে সীমাবদ্ধ কোন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তির পার্থক্যকে এক করে দেখা ঠিক নয়। বিস্তর পার্থক্য- আমার অভিজ্ঞতার আলোকে। একজন অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে পুরো পরিবারই বিভিন্নমূখী চ্যালেঞ্জ এর মধ্যে পতিত হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় আমি কাউকে সাথে পাইনি। যে ধরনের সুযোগ সুবিধা আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, সমাজ এবং রাষ্ট্রের করার কথা। সেসবের বিন্দু মাত্র আমার কপালে ঘটেনি। রাষ্ট্রের নিকট হতে প্রাপ্তির মধ্যে শুধু জন্ম সনদ। অন্য কোন আইনী অধিকারের সনদ শ্রেয়া’র নেই। মাসিক ভাতাপ্রাপ্তির আশা দুরাশা মাত্র। অথচ শ্রেয়া অটিস্টিক। শ্রেয়া বাংলাদেশের প্রথম দিককার অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের একজন। শ্রেয়া যখন অটিজমে আক্রান্ত তখন বিভিন্ন কারণে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। সেসময় চিকিৎসকবৃন্দ অটিজম অটিস্টিক ইংরেজি বানান ভুল লিখতেন। আমি তাদের শুদ্ধ করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান সরকার অটিজম বান্ধব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের উদ্যোগসমূহের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। একই সাথে এ লেখায় কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

আমরা অনেক বৈষম্যের শিকার। অটিস্টিক সন্তানের বাবা, পরিবারের সদস্য হিসেবে বৈষম্য ও অন্যায্যতার মধ্যে আমাদের এ দেশে বসবাস করতে হচ্ছে। আমরা আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে চাই। আমাদের পাশে এসে না দাঁড়ালেও আমরা অখুশি হবো না। তবে বৈষম্য অন্যায্যতা ন্যায়পরায়নহীনতা বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে আমরা চলতে পারবো না। একসময় আমরা হারিয়ে যাবো। হয়ত পড়ে থাকবে শ্রেয়া’রা। যেমন পড়ে আছে চয়ন বাবা ছাড়া।

যেসব পন্থায় বিশ্ব অটিজম দিবস পালনের কথা বলা হয়েছে; যেমন- অটিজমের ইতিহাস সম্পর্কে জানুন; ব্লু আলো জ্বালিয়ে দিন; নিজ পোশাককে তুলে ধরুন- পরিধেয় বস্ত্রে অটিজমের রঙকে আলিঙ্গন করুন; বিখ্যাত ব্যক্তি যারা অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন তাদের চিত্র সামনে নিয়ে আসুন; যেসব খেলনা অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়ক সেসব সম্মুখে নিয়ে আসুন: অটিজম বান্ধব ব্যবসা এবং নিয়োগকর্তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন: অটিজম সম্পর্কিত বইপত্র পড়ুন; কমিউনিটিতে অটিজম সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করুন; মানবতা ছড়িয়ে দিন এবং অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পর্কে জানুন, তাকে দেখুন, পর্যবেক্ষণ করুন, তার কথা শুনুন, তার সৃষ্টিকে তুলে ধরুন।

বিনয়ের সাথে শেষ কথা বলি। অটিজমে আক্রান্ত বা অটিস্টিক ব্যক্তিরাও মানুষ। তাদের পরিবারের সকল সদস্য-সদস্যারাও অটিজমে আক্রান্তগ্রস্ত। এই বিষয়টি সমাজ, রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সকলকে অনুধাবন করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাই। বিশ্ব অটিজম দিবসে একজন অটিস্টিক কন্যার পিতার এ ক্ষুদ্র নিবেদন।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ