শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা/ শ্যামল কুমার সরকার

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

শ্যামল কুমার সরকার

বুদ্ধিজীবী কারা? আমার মতে, কোনো ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির, ব্যক্তিস্বার্থের হিসাব-নিকাশ না করে জাতির ও জনগণের কল্যাণে যাঁরা বিবৃতি ও লেখালেখির মাধ্যমে বুদ্ধি-পরামর্শ প্রদান করে জাতির মেধা ও মননের পথকে গতিশীল রাখেন, জাতির উন্নয়নে ও জাতিকে সংকট মুক্ত করতে ভূমিকা রাখেন তাঁরাই বুদ্ধিজীবী। এরা কোনো রাজনৈতিক দলের বাক্সবন্দি নন এবং জাতির স্বার্থে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিতে একটুও দ্বিধা করেন না। এরা কখনোই বুুদ্ধি বিক্রি করেন না, বুদ্ধির ব্যাপারী নন। এসব মহান মানুষেরা সব সময় নিজস্ব বিবেক দ্বারা চালিত।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড ঘটে ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাতে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা পরিকল্পিতভাবে সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাসা হতে ধরে নিয়ে যায়। চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া ও রাজারবাগ সহ অন্যান্য স্থানের নির্যাতন কেন্দ্রে নৃংশসভাবে হত্যা করে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে ফেলে রাখে তাঁদের।

একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কুখ্যাত রাও ফরমান আলি এদেশের ২০ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকান্ড চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলির টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্ণর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।

১৪ ডিসেম্বরকে বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দিন আহমদ। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’ এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার ৭০ জন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কতৃক নির্মিত ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রামান্যচিত্রে বলা হয়, স্বাধীনতা যুদ্ধে ৬৩৭ জন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক, ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক শহীদ হয়েছেন।

১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। তখন বাংলা একাডেমি সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ বিশেষ পেশাজীবীরা ‘‘বুদ্ধিজীবী’’ হিসেবে বিবেচিত হবেন। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে ‘‘স্মৃতি-৭১’’ গ্রন্থ। এরই ধারাবাহিকতায় ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করে বাংলা একাডেমি।

‘‘বাংলা পিডিয়া’’র তথ্য অনুযায়ী, একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় রয়েছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন্য চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। সব মিলিয়ে এই তালিকায় নিহত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার একশ’১১ জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ১৫২ জনের নামে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে সরকার।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান এর মতে (ভোরের কাগজ, ডিসেম্বর, ২০১৯) পাকিস্তানিরা ১৯৬৯ সালেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে চেয়েছিল। এ কমিটির কাছে ৫০০ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম রয়েছে।

অতএব দেখা যায় যে, বিজয় লাভের এত বছর পরেও (স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসেও) আমরা প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নির্ণয় ও তাঁদের তালিকা প্রকাশ করতে পারিনি। এটি নিঃসন্দেহে বড় ধরনের ব্যর্থতা। সম্প্রতি (ডিসেম্বর-২০২০) জামুকা-আইনে সংশোধনী এনে সংস্থাটিকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের তালিকা প্রকাশের ক্ষমতা দেয়া হয়।

বলাই সংগত, কোনোভাবেই জাতির সূর্য সন্তানরা এভাবে অবহেলায়-অবজ্ঞায় হারিয়ে যেতে পারেন না। তবে আশার কথা, সরকার ১ হাজার ২২২ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও এ লেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় নি।

শ্যামল কুমার সরকার : সভাপতি, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মানিকগঞ্জ জেলা শাখা।

Facebook Comments Box
ভাগ