কবিতার শক্তি/ আবুল ইসলাম শিকদার

প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, এ লেখায় কবিতা নিয়ে কোন গুরুগম্ভীর আলোচনার ইচ্ছে আমার একেবারেই নেই। শুধু একটি মামুলি মুহূর্তকে উপস্থাপন করার কিছুটা লোভ একেবারে সামলাতে পারছিনা।

আসলে জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা গুলোকে আমরা কখনো খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করি না। কেননা সেগুলোতে আমাদের খুব বেশি লাভালাভের প্রশ্ন থাকে না। কিন্তু একটু ভালো করে মনোযোগ দিলে দেখা যাবে, ক্ষুদ্রতম ঘটনা থেকেও আমরা জীবনের জন্য কত মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি।

এই বন্যায় আমরা আবার করোনাকালের মতই ঘর বন্দি হয়েছি। খুব দরকার না হলে বাইরে যাওয়া হয়না। আমার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে আমার প্রিয় দাদা ভাইকে নিয়ে। সে খুবই চঞ্চল। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে। কাজেই তাকে সামাল দেওয়া রীতিমত একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হবে দেড় মাস পরে। কিন্তু তার ম্যাচিউরিটি অনেক বেশি। আমার পক্ষে তার সব প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দেয়া সব সময় সম্ভব হয়না। তার পরও সে আমার সঙ্গটাকে খুবই উপভোগ করে এবং তার একটি বাক্য এরকম,

“তোমাকে ছাড়া আমার চলে না”

যাহোক তাকে সামাল দিতেই সেদিন দুপুরে দোতালার বারান্দায় একথা ওকথা বলে তার পানিতে যাওয়ার ইচ্ছাটাকে অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছিলাম। সেও কিছুটা ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ দেখা গেল সে এটা ওটা জানলা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। আমি হাত থেকে নিয়ে গেলাম অনেকটা জোর করে। তার পরও সে একটি বোতল এবং অন্যান্য টুকটাক কয়েকটি জিনিস গ্রিলের ফাঁক দিয়ে পানিতে ফেলে দিল এবং এটাই তার একটি মজার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

তারপর আমি তাকে কোনমতে নিবৃত্ত করে ওই ফেলে দেয়া বোতল সম্পর্কে এমনিতেই কবিতার মত করে বেশ কয়েকটি লাইন এলোমেলোভাবে বলে চললাম। সে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার এই আবৃত্তি শুনছিল। সে মাঝে মাঝেই আমার কথা অত্যন্ত মন দিয়ে শোনে এবং পরে খুব যথার্থভাবে সেগুলোর রিপেটেশন করে। শুধু কবিতাই নয় তাকে যে কোন বিষয় সম্পর্কে মাত্র একবার বললেই সেটা সে ধরে রাখতে পারে। যাহোক আমি সেই ফেলে দেওয়া বোতল সম্পর্কে এরকম বলছিলাম,

তুমি আমাকে ফেলে দিলে কেন?
আমি এমন কি অপরাধ করেছিলাম!
এই বন্যায় আমি ভাসতে ভাসতে
কোথায় হারিয়ে যাবো, আমি জানিনা।
হয়তো দূরের কোন দেশে,
হয়তো তোমাদের সাথে আর দেখা হবে না।
আমি কি তোমাদের কোন উপকার করিনি?
আমি তো তোমাদের টেবিলেই ছিলাম,
তোমাদের ফ্রিজেও থেকেছি,
আমি কি তোমাদের পানি পান করাইনি?
তাহলে আজ কেন তুমি এভাবে ছুড়ে ফেলে দিলে?

এমনি আরো কীসব যেন বলছিলাম। আমি হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তার চোখ ছল ছল করছে। সে হাত দিয়ে চোখের পাতা ঘষছে। আমি হাত সরিয়ে নিয়ে দেখি তার চোখ ভিজে গেছে। সে আমাকে বলল, দাদা তোমার কবিতা শুনে আমার খুব খারাপ লাগছে ওই বোতল টার জন্য। চলনা ওই বোতল টা আমরা পানি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসি। একবার নয়, দুবার নয়, সে বহুবার আমাকে বোতলটি উঠিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করলো। কিন্তু ততক্ষণে বোতলটি বাতাসে ভেসে ভেসে অনেক দূর চলে গেছে।

ঐটুকু শিশুর মনে কি তাহলে শব্দাঘাত লেগেছে? তার কান হয়ে প্রাণ পর্যন্ত চলে গেছে? তাকে অনেক কথা ব্যয় করেও হয়তো এ বিষয়টি মাথায় ধরানো যেতো না।

কিন্তু যখনই কবিতার মত করে বলেছি তখন-ই প্রতিটি শব্দ তার ঐ শিশু হৃদয় তন্ত্রীতেও প্রবল আঘাত করেছে। সব শব্দের অর্থ হৃদয়ঙ্গম না হলেও সে আভাসেই সবটুকু বুঝে নিয়েছে। বড় ভাব বড় তত্ত্ব আলোচনা না করেও বলা যায়, কবিতার অনন্ত শক্তি এখানেই নিহিত।

কড়চা/ এ আই এস

Facebook Comments Box
ভাগ