করোনা এবং বাবার মৃত্যু
রুহুল ইসলাম টিপু
করোনা এলো। পৃথিবী হলো স্তব্ধ। ২০২০ সাল। মানিকগঞ্জে বাবা এবং মা। আমরা ঢাকায়। ২০২০ এর মার্চ থেকে অগাস্ট ঘরেই কাটাতে হয়। ভরসা শুধুই মোবাইল। নববর্ষ, রোজা, দুই ঈদ চলে যায় বাড়ি আর যাওয়া হয় না। মাকে বলি সাবধান হতে; মা আমাদের বলেন সতর্ক থাকতে। মা সারাক্ষণ বাড়ির গেট বন্ধই রাখেন। গেটের পাশেই রাখেন এক বালতি পানি, মগ, সাবান, গামছা। ওয়াশ রুমেও হাত ধোয়া এবং স্যানিটাইজের ব্যবস্থা রাখা হয়। সতর্কতার কমতি ছিল না। চারদিকে মৃত্যু এবং করোনা আতঙ্ক। ভীতিকর পরিবেশ। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ শহরের আনাচে কানাচে বন্যার পানিও ঢুকে পড়ে। আমাদের বাড়ি এ থেকে নিস্তার পায়নি। স্নেহার ’ও’ লেভেল পরীক্ষা এপ্রিল ২০২১-এ। নভেম্বর ২০২০ এর মধ্যে পাসপোর্ট করতেই হবে। সবক্ষেত্রেই উৎকন্ঠা এবং অনিশ্চয়তা। সেপ্টেম্বর-এ পাসপোর্ট অফিসের সার্ভার সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হয়। চলে যাই মানিকগনগঞ্জে। পৌরসভার নাগরিকত্ব সনদ, জন্ম সনদসহ সংশ্লিষ্ট নথি সংগ্রহ ও সরাসরি ছবি তোলা সম্পন্ন হয়। করোনাকালীন কষ্টের অনেক দিক এখন প্রায় বিস্মৃত। প্রথম দিকে খবর পাই পাশের বাড়ির মজিবুর ভাই সৌদী আরবে করোনায় মারা যান। মানিকগঞ্জ সমিতি, ঢাকার কোষাধ্যক্ষ অ্যাডভোকেট গোলাম সারওয়ার রিপন ভাই এর মায়ের মৃত্যু আমাদের প্রচন্ডভাবে ব্যথিত করে। ঢাকা মেডিক্যালে মারা যাওয়ার পর রায়ের বাজার দাফন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন শুধুমাত্র নিকটতম কয়েকজন। রিপন ভাইয়ের স্ত্রী বিয়োগ ঘটেও এ সময়। পত্রিকার পাতা এবং টেলিভিশনে শুধুই করোনা, হাসপাতাল, মৃত্যু সংবাদ। জীবন এবং জীবিকার সমীকরণ আর দেশের মানুষ মেলাতে পারে না। কবরস্থান এবং শশ্মানের ব্যস্ততায় আমরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।
বছরের শেষ দিকে করোনা’র প্রকোপে কিছুটা ভাটা পড়ে। ২৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন মানিকগঞ্জ পৌরসভার ভোটের দিন ধার্য করে। ভোটের আমেজ আছড়ে পড়ে মানিকগঞ্জ পৌরসভায়। কড়চা’য় মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচন উপলক্ষে কয়েকটি লেখা নিয়ে আসি। দেশ ৪৯ বছর থেকে ৫০ বছরে পদার্পণ করছে আমাদের আবেগ বেশ উচ্ছ্বসিত। বাংলাদেশ মহাবিজয়ের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্ম শতবর্ষ উদযাপন করছে। বাংলাদেশের ৪৯তম বিজয় দিবসে নিজ গ্রাম মান্তাকে দেখার বড় সাধ হলো। আগের দিন ঢাকার বাসা থেকে সন্ধ্যায় বের হই। পথিমধ্যে ছিল বিশাল যানজট। মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশ করি রাত ২ টায়। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। বাবার ডাকেই বিছানা ত্যাগ। গোসল নাস্তা সেরে চলে যাই মান্তা। সন্ধ্যায় চলে আসি। বাবা বলেন, ‘কয়ডা ভাত খেয়ে যাও।’ আমি বাবার কথা শুনিনি। এ অবাধ্যতার জন্য নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।
২৫ ডিসেম্বর ছিল শুক্রবার। রাতে গ্রাম থেকে এক ভাতিজা ফোন করে জানায় দাদার শরীর ভালো না। সকালেই চলে যাই বাড়ি। সারাদিনই ছিলাম বাবার নিকট। বাবা তেমন অসুস্থ এটি বুঝতে পারিনি। শুধু জানালেন হাতে চিন চিন ব্যথা করে। একটু শ্বাস কষ্ট ছিল। বাবা বলেন, সেদিন ভাত খাওনি। আমি বড় কষ্ট পেয়েছি। আর এমনটি হবে না। আমি খেয়েই যাবো। এটি ছিল বাবা-পুত্রের শেষ কথপোকথন। রাতে ঢাকায় চলে আসি। পরদিন বিকেল ৩টায় মা ফোন করেন। বাবা খুব অসুস্থ। তাঁকে মুন্নু জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি মানিকগঞ্জের পথে। বাবা আবার উল্টা পথে এনাম মেডিক্যাল, সাভার। প্রথমে আইসিইউ। এরপর লাইফ সাপোর্ট। ২৮ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনের দিন বাবা চলে গেলেন। আমার গাড়ি পিছনে। সামনে অ্যাম্বুলেন্স। প্রাণহীণ বাবা বাড়ি যাচ্ছেন। অনেকদিন পূর্বে বাবা বলেছিলেন, তাঁকে বেউথা গোরস্থানে রাখতে। এ গোরস্থান প্রতিষ্ঠায় তিনিও ছিলেন উদ্যোগীর একজন। আর নদীর পাড়। কালীগঙ্গাকে তিনি বড় ভালোবাসতেন।
বেউথা এবং মান্তার মানুষ জেনে যায় খবর। মান্তাবাসী আবদার করেছিলেন সেখানে তাঁকে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে যেতে। পৌর মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ভাইয়ের কার্ড পকেটে। তাঁকে ফোন করি। প্রতিশ্রুতি দিলেন মান্তা নিয়ে যাওয়ার। পাঠাবেন গাড়ি। নির্বাচনের দিন গাড়ি এবং চালকের উপস্থিতির সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয়নি। সবই করছি গাড়িতে বসে। সিঙ্গাইর সড়ক। মানিকগঞ্জের পথে। ডিজি হেলথ থেকে আসে আমার মোবাইলে একটি মেসেস। বাবার করোনা পজিটিভ। আমি থমকে যাই। বাড়ি ভর্তি শত শত বাবার প্রিয়জন। করোনা পজিটিভ, এ সংবাদ বাড়িতে উপস্থিত মুরুব্বীদের আমি জ্ঞাত করি। মুহূর্তে সবাই সরে যেতে থাকেন। গাল মন্দ এবং মারমূখী হয়ে উঠে সকলে আমার প্রতি। কেন এ সংবাদ দেওয়া হলো। আমি যতই আকুতি নিয়ে বুঝাতে চাই- বাবাকে দাফন করবো। স্বাস্থ্যবিধি পালন করে। আসুন, আপনারা বাবাকে ভালোবাসেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কবরস্থ করার কাজ সম্পন্ন করি।
কেউ এগিয়ে আসেননি। আমি এলাকায় নিয়মিত থাকি না। সকলকে চিনিও না। কোথায়, কিভাবে, কেমন করে দাফন সম্পন্ন করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। এ ছিল আমার এক মহা বিপদ। আমাদের এলাকার এক নারী এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ভাই চিন্তা করবেন না। আমি সাহায্য করবো। বাবার দাফনে সাহায্য করেছিলেন আমার এই বোনের নাম দুখী। গোসল করান রমজান কাকা; সহযোগিতা করেন সম্পর্কে মামা আমার অনুজ দাশড়ার তৈয়্যব, ছোট ভাই এর স্ত্রী’র ভাই সেলিম। মাঝরাত পেরিয়ে নতুন দিনের সূচনায় আকাশে ভরা পূর্ণিমা। বেউথা মসজিদে বাবা শায়িত। জানাজা শুরু। নির্বাচন এবং ঘুম উপেক্ষা করে আবারও লোক সমাগম। সংখ্যা আমার নিকট বিবেচ্য নয়। কাতার গুণে দেখি মানুষ আনুমানিক শ’তিনেক এর উপর হবে। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং শ্রদ্ধা। বাবাকে সম্মান জানানোর জন্য। জানাজায় শরীক হয়েছেন। আপনাদের প্রতি আমরা ঋণী। বাবার মা আমার দাদীর নাম পূর্ণিমা। বাবা কবরস্থ হন চাঁদের আলোয়। আলোকিত রাতে আকাশে তাকিয়ে অনুভব করি বাবাকে। বাবা তাঁর মা পূর্ণিমার নিকট ভালো থাকুন। ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ বাবা মোঃ আনছার আলীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং ভালোবাসা।
সকল পূর্ণিমা তিথিতে আমরা ভালোবাসার আলিঙ্গনে জড়িয়ে পৃথিবীতে শান্তি বর্ষণ করি- বাবার প্রতি এ আমার অঙ্গীকার।
কড়চা/ আর আই টি