কাঙ্গাল হরিনাথ, নির্ভিক সাংবাদিকতার অনন্য মডেল/ শ্যামল কুমার সরকার

হরিনাথ মজুমদার। পিতা হলধর মজুমদার। মাতা কমলিনী দেবী। জন্ম কুষ্টিয়া জেলার (তৎকালীন পাবনা) কুমারখালী উপজেলার নিভৃত গ্রাম কুন্ডুপাড়ায় ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই। পরবর্তী জীবনে তিনি কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। গ্রামীন সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ ও সমাজ সেবক। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৫৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি নিভৃত গ্রাম হতে হাতে শিখে প্রথম প্রকাশ করেন মাসিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’। কাজটি করতে গিয়ে তিনি শত বাধার মুখে পড়েন। তবুও তিনি প্রায় এক যুগ হাতে লিখে প্রকাশ করেছিলেন পত্রিকাটি। এরপর পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে পত্রিকাটি। ১৮৭২ সালে কালাকানুনের বিরুদ্ধে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান পত্রিকার সম্পাদক কাঙ্গাল হরিনাথ। তিনি নিজেই ঘুরে বেড়াতেন গ্রামে গ্রামে। নিজে সংগ্রহ করতেন শোষন, অত্যাচার, বঞ্চনা আর নির্যাতনের সংবাদ।

১৮৬৩ সালে কাঙ্গাল হরিনাথ ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে শিলাইদহের জমিদারের (জোড়াসাঁকোর ঠাকুর) বিরুদ্ধে এবং কৃষকদের পক্ষে প্রবন্ধ লিখে তোলপাড় সৃষ্টি করেন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ ছিল নির্ভিক সাংবাদিকতার অনন্য মডেল। এক অভাবী মায়ের একটি মোটা তাজা গরু ছিল। পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হামফ্রে সে গরুটিকে পছন্দ করেন। ফলে তারই নির্দেশে সে গরুটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অনুসন্ধানে নামেন কাঙ্গাল। সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তিনি ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র পরবর্তী সংখ্যায় ‘গরুচোর ম্যাজিষ্ট্রেট’ শিরোণামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামফ্রে এতে ভয় পেয়েছিলেন কি পাননি তা কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে লেখা তার চিঠি পড়ে দেখা যাক।

‘‘এডিটর, আমি তোমাকে ভয় করি না বটে, কিন্তু তোমার লেখনীর জন্য অনেক কুকর্ম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি’’। পাঠক, একবার ভেবে দেখুন ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’, কাঙ্গাল হরিনাথ এবং উল্লিখিত পত্রটির কথা। এভাবেই চরম অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছিলেন কাঙ্গাল। ৬৩ বছরের জীবন শেষে ১৮৯৬ সালের ১৬ এপ্রিল কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার নিজ গৃহেই এ পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন।

এর পর চলে গেছে শতাধিক বছর। হয়েছে দেশভাগ। নিয়েছে পাকিস্তানিরা বিদায়। আমরা পেয়েছি স্বপ্নের বাংলাদেশ। হয়েছি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন। তাও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। দেশে এখন অফসেট মেশিনে চকচকে কাগজে প্রতিদিন শত শত পত্রিকা ছাপা হচ্ছে। সংবাদপত্রকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই মহাখুশী। এরই মাঝে আমরা পেলাম কুড়িগ্রামের সুলতানা পারভীন নামের একজন ডিসিকে (সাবেক)। গণমাধ্যমে প্রকাশ, তার নানাবিধ অন্যায় কাজের রিপোর্ট করায় তারই নির্দেশে প্রশাসনের তিনজন কর্মকর্তা মাঝরাতে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বাংলা ট্টিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। শুধু তাই না। ডিসির নিদের্শনা অনুযায়ী আরিফুলকে বেদম পেটানো হয় এবং ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এ কাজগুলোও করেন জেলা প্রশাসনের কর্তারাই। উক্ত ডিসিকে তাৎক্ষনিক প্রত্যাহার করা হয়। প্রত্যাহার করা হয় তার আজ্ঞাবাহী তিন কর্মকর্তাকেও। এক্ষেত্রে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর গৃহিত পদক্ষেপ সর্বমহলে প্রসংশিত হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের গৃহীত ব্যবস্থাকেও স্বাগত জানিয়েছেন দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষ। দেখা যাক, সে ডিসি ও তিন কর্মকর্তার সর্বশেষ পরিণতি। আপাতত আমরা ভাবতে থাকি কাঙ্গাল হরিনাথ ও পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ হামফ্রেকে নিয়ে। ভাবতে থাকি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও জন প্রশাসন নিয়ে।

শ্যামল কুমার সরকারঃ লেখক ও কলামিস্ট

Facebook Comments Box
ভাগ