গ্রামীণ নারীরা বহুমূখী কাজের স্বীকৃতি চায়
রাশেদা আক্তার
‘গ্রামীণ নারীরা সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেয়’ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে ১৫ অক্টোবর বিশ্ব গ্রামীণ নারী দিবস উপলক্ষে মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরমত্ত গ্রামে আলোর পথিক নারী সংগঠনের আয়োজনে এবং বারসিক এর সহযোগিতায় আলোচনা সভা ও নারীদের উৎপাদিত নিরাপদ খাদ্যের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
আলোর পথিক নারী সংগঠনের সভাপতি সুমি আক্তারর সভাপতিত্বে আলোচনা সভার শুরুতেই দিবসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রবন্ধ পাঠ করেন সংগঠনের সদস্য লতা আক্তার।
দিবসকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ নারীরা তাদের উৎপাদিত ও যোগানকৃত নিরাপদ খাদ্যের প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে তারা লাউ, শিম, মূলা, লালশাক, পুঁই শাক, মিষ্টি কুমড়া, ধুন্দল, বেগুন, আলু, বেল আলু, সোয়াচ পাতা, দুধ কচু, চালকুমড়া, কলা, আদা, হলুদ, ডাটা, কচুর লতি ইত্যাদি শাক-সবজি ও বীজ এবং হাঁস ও মুরগির ডিম প্রদর্শন করেন। পাশাপাশি গ্রামীণ নারীরা তাদের বাড়ির আশ-পাশ থেকে নানা ধরনের অচাষকৃত শাক যেমন সেচি, ফুল সেচি, খারকুন, নেটাপেটা, কলমী, কচু, তেলাকুচ, কাঁটা, নুনকুটে, বউটুনি ইত্যাদি শাক শাক এবং শাপলা, শালুক ও কচুর লতি প্রদর্শন করা হয়।
আলোর পথিক সংগঠনের সদস্য ফাতেমা বেগম বলেন, আমরা নারীরা সারাদিন কত রকমের কাম (কাজ) করি। আমি হাঁস-মুরগি পালি। বাড়িতে শাক-সবজি বুনি। চকে (জমিতে) নানা রকম ফসল বুনি। আমরা যে শাক-সবজি বুনি হেইডা অনেক নিরাপদ খাদ্য। বাজরের খাধ্যে সার-বিষ দেয়া থাকে। বাড়িতে আমাগো কোনো সার-বিষ লাগে না। সারাদিন কাম করতেই থাকি। পুরুষরা বাড়ি আসলে কয়, আমারে দেইখা কাম দেখাইতেছো। কিন্তু আমি যে আসলেই সারাদিন কাম করি হেইডা (সেটা) বুঝে না। ডিম বিক্রি করে সেই টাকা সংসারে খরচ করি। তখন আবরার ভাল বলে। কিন্তু আমাগো কামের কোনো মূল্য দেয়না। আমরা চাই ঘরে-বাইরে আমাদের কামের মর্যাদা দিক।
সংগঠনের সদস্য রেনু আক্তার বলেন, আজ জানলাম আমাগো জন্যও একটা দিন আছে। আমরা সবাই মিলে চাই আমাগো কাজের গুরুত্ব দেওয়া হোক। আমরা আগামী বছর এই অনুষ্ঠান আবার করুম (করবো) এবং আমরা প্রত্যেকে সেই অনুষ্ঠানে আমাদের স্বামীদের নিয়ে আসবো। এসব কথা স্বামীদের শোনা দরকার। তাইলে না মর্যাদা দিব।
প্রত্যয় কিশোরী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া আক্তার বলেন, আজ আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। আমি দেখি গ্রামের নারীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করতেই থাকে। ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের কাজ শেষ হয়না। আমার দাদীকে দেখেছি বৃদ্ধ বয়সেও সে পাটি বানাতো বসে বসে। অনেক নারীদের বলতে শুনি মরার আগে আর কাজ শেষ হবেনা। আসলেই গ্রামের নারীরা অনেক কাজ করে। আজ এই দিবসে আমিও চাই গ্রামের নারীদের কাজের গুরুত্ব দেওয়া হোক। তাদের কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
সভাপতি সুমি আক্তার তার বক্তব্যে বলেন, আজ আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। একটি গাড়ির যেমন সামনে পেছনে চাকা থাকে তেমনি আমরা নারীরাও সংসারে সেই চাকার মত। গাড়ির চাকা নষ্ট হলে যেমন গাড়ি চলে না, ঠিক তেমনি নারী ছাড়ও সংসার অচল। আমরা সারাদিন শতরকমের কাজ করি। কিন্তু আমাদের কাজ পুরুষদের চোখে পড়ে না। তারা বলে, কি করো সারাদিন। আমাদের কাজকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু অনেক স্বামীরা আবার ভালও আছে। তারা অনেক সাহায্য করে। কিন্তু বেশিরভাগ স্বামীরাই বলে, মহিলা আবার কোনো কাজ করে নাকি। আজ এই দিবসের মাধ্যমে আমরা দাবি তুলতে চাই আমাদের নারীদের কাজকে অবহেলা না করে মর্যাদা দেওয়া হোক। আমরা আমাদের ঘরের কাজের স্বীকৃতি চাই।
আলোচনা শেষে নারীরা তাদের প্রদর্শনকৃত বীজ থেকে লাউ, শিম, পালংশাক, পুঁইশাক ও ধুন্দল বীজ বিনিময় করেন।
গ্রামীণ নারীরা সংসারের নানা ধরনের কাজ করার পাশাপশি কৃষি এবং উৎপাদনমূখী কাজের সাথেও সম্পৃক্ত নিবিড় ভাবে। গ্রামের নারীরা একদিকে যেমন সন্তান লালন-পালন করেন, ঠিক তেমনিভাবে বীজ সংরক্ষণ, বীজ বপন, ফসল উত্তোলনের কাজেও অবদান রেখে চলেছেন কৃষির সূচনা লগ্ন থেকেই। গ্রামীণ নারীরা তাদের বসত বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করেন এবং মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন রকম শাক-সবজি চাষ করেন কোনো রকম রাসায়নিক সার ছাড়াই। ফলে এসব খাদ্য একদিকে যেমন তার জন্য নিরাপদ তেমনি পুষ্টিগুণও থাকে অনেক বেশি। বিশ্বের বেশির ভাগ নারীরা গ্রামে বাস করেন। গ্রামীণ নারীরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা ধরনের কাজ করে থাকেন। গ্রামীণ নারীদের বহুমাত্রিক ভ’মিকা ও অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদার আন্দোলন চলছে। সমাজের অগ্রগতিতে গ্রামীণ নারীর অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামীণ নারীর বহুমূখী কাজের মূল্যায়ন ও মর্যাদা নিশ্চিত হোক।
কড়চা/ আর এ