ডাক্তার এবং সাধারণ মানুষ একইভাবে সুস্থ থাকতে পারেন/ ডা. অপূর্ব চৌধুরী

ডাক্তারদের বেশিরভাগ সময় রোগীর সংস্পর্শে থাকতে হয়। রোগের একটি প্রধান উৎস হলো আরেকজন রোগী। হাসপাতাল এমন একটি জায়গা-একইসাথে রোগ ভালো করার, একই সাথে রোগে আক্রান্ত হওয়ার জায়গা। এই রোগীদের দেখাশোনা করতে গিয়ে ডাক্তারদের সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হওয়ার কথা।

কোভিড আসার আগে অপারেশন থিয়েটার ছাড়া এবং যে সমস্ত রোগ ছোঁয়াচে তেমন রোগীকে পরীক্ষা করাকালীন ছাড়া মাক্স কিংবা কোন ধরনের পিপিই পরার প্রয়োজন কখনো দেখা দেয় নি, কিংবা তেমন কোন সর্তকতা অবলম্বন করতে হয় না। তাহলে কি করে ডাক্তার কিংবা সেবা কর্মীরা সুস্থ থাকেন, ভালো থাকেন?

কিন্তু ডাক্তার, নার্স, কিংবা যেকোনো স্বাস্থ্যকর্মী সতর্ক না থাকলে যেকোনো ধরনের অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে এবং হয়। বরং সাধারণ মানুষের চেয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদেরই জীবাণুতে সহজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সাধারণ মানুষের মতো ডাক্তার কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীরাও অসুস্থ হয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক বেশি হয়। কারণ জীবাণুতো আর মানুষ বোঝে না। যেমনটা কোভিড কাউকেই ছাড়ছেনা।

কিন্তু কিছু নিয়ম এবং সর্তকতা পালন করলে ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী, যেমন ভালো থাকতে পারে, এবং ভালো থাকে । তেমনি একই নিয়মগুলো সাধারণ মানুষ মেনে চললে তারাও সুস্থ থাকতে পারে। এই নিয়েই আজকের আলোচনা।

চিকিৎসক জীবনে সব রোগীদের একটা পরামর্শ দিয়ে বলি, প্রতিটি মানুষ তার শরীরের সেরা ডাক্তার। একজন দক্ষ চিকিৎসক শুধু তাকে গাইড দিয়ে সেটি বুঝতে সাহায্য করে। তারমানে নিজেই নিজের শরীরকে যেমন সবচেয়ে বেশি বুঝে, তেমনই নিজের শরীরকে নিজেই সবচেয়ে বেশি ভালো রাখতে পারে।

সহজ করে বলি, সাধারণ তিনটি নিয়ম মেনে চললে তিনি ডাক্তার হন আর সাধারণ মানুষ হন, শরীর ভালো থাকে।
1. নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার
2. নিয়মিত ভালো ঘুম
3. নিয়মিত ব্যায়াম।

তিনটি শেষ হওয়ার পরে হাসতে হাসতে চতুর্থটা বলি, নিয়মিত বাথরুম হওয়া।

সব রোগকে দু ভাগে ভাগ করি। একটি হল শরীরের ভেতরে বিভিন্ন অংশের রোগ। আরেকটি হল বাহির থেকে কোন জীবাণু শরীরে ঢুকে শরীরকে রোগাক্রান্ত করা।

বাহির থেকে শরীরের যত্ন না নিলে শরীর যেমন ভিতরে আক্রান্ত হয়, তেমনি সরাসরি বাহির থেকে কিছু ঢুকে শরীরকে আক্রান্ত করতে পারে। যেহেতু শরীরের ভিতর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নেই, বাহিরে নিজেদের কাজ গুলোকে ঠিক রাখলে ভেতরের কাজ গুলো ঠিক থাকে।

শরীরের ভিতরে কোন অংশের জন্মগত ত্রুটি, জীবনধারণ, দুর্ঘটনা, এসবে যেহেতু অনেকক্ষেত্রে নিজের কোন হাত নেই, সেসব রোগের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হলে চিকিৎসক সমাধান দিয়ে সারিয়ে তোলেন। কিন্তু বাহির থেকে যে জীবাণুগুলো শরীরে ঢুকে শরীরকে রোগাক্রান্ত করে, সে ক্ষেত্রে নিজের অনেক ভূমিকা এবং নিয়ন্ত্রণ থাকে। সেটিতে সতর্ক হলে এমনতর রোগগুলো থেকে বাঁচা যায়।

শরীরে যে কোন জীবানু ঢোকার রাস্তা হল দুটি। হয় নাক-মুখ দিয়ে, নয় হাত দিয়ে। এখানে (ইউ কে) ডাক্তাররা হসপিটালে ঢোকার শুরুতেই হাত সেনিটাইজ করে নেয়। রোগী এবং ভিজিটরদেরকেও উৎসাহিত করা হয় এমন কাজ করতে । রোগীর গায়ে হাত দেবার আগে গ্লাভস পরা না থাকলে হাতকে যেমন সেনেটাইজ করে নেয়, তেমনি কাজ শেষে আরেকবার হাতকে জেল দিয়ে সেনিটাইজ করা হয়। এটি কোভিড আসার আগ থেকেই করা হয়। হাত জীবাণুমুক্ত থাকলে শরীরে ঢোকার কোন উপায় থাকেনা।

সাধারণ মানুষ ঘরে ঢোকার সাথে সাথে প্রথমে যেকোনো কিছু ধরার আগে হয় হাতটি সেনিটাইজ করবেন অথবা সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নেবেন। এটি সারা জীবন মেনে চলবেন । শুধু কভিড থেকে বাঁচার জন্য নয় । যে কোন জীবাণু আপনার শরীরে ঢোকার পথ পাবে না। বাহির থেকে এসে হাত ধোয়ার সাথে সাথে নাক, চোখ এবং মুখ ধুবেন। এই তিনটি জীবাণুর প্রবেশদ্বার।

দিনের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করবেন। এক ভাগ কাজের জন্য, একভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ ঘুমের জন্য। ঘরের কাজ হোক আর পরের কাজ হোক, কাজ তো কাজই। ঘুমের সমস্যা হলে বাকি দুই ভাগ সমস্যাগ্রস্ত হয়। শরীরের ক্ষমতা ঠিক রাখা, রোগ আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করা, সর্বোপরি ভালো থাকার জন্য ভালো ঘুমের কোনো বিকল্প নেই।

আবার ভালো ঘুমের জন্য স্ট্রেস ফ্রী থাকা একটি জরুরী বিষয়। নিজের একটি ভালো লাগার কিছু খুঁজে নিন। সপ্তাহে ছুটির দিন সেই কাজটিতে ডুবে থেকে স্ট্রেস ফ্রি করুন। সময় সময় ছুটি নিন, কম পয়সায় পরিবার নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতে যান, সেটা না পারলে বাড়ির আশেপাশে নিজের কোন প্রিয় জায়গায় সময় পেলে ঘুরে আসুন। টিভি কিংবা অনলাইন আপনার মানসিক স্ট্রেস কোনভাবেই দূর করবে না । বরং সেটি আরও বাড়িয়ে দেয়। ঘর থেকে বের হন, প্রকৃতির কাছে যান।

মন এবং শরীর দুটোই ভালো রাখার জন্যে নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই। কিটো কিম্বা ফিটো এসমস্ত ডায়েট রেগুলেশন ফলো করে আয়নায় নিজের শরীরের সেইপ ভালো দেখেন, কিন্তু ভিতরের শরীরের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন। শরীরের সেইপ ভালো থাকা মানে শরীর ভালো থাকা নয় । পয়সা খেকো এসব চটি ডাক্তারের ফর্মুলা অনলাইনে আপনাদের যেভাবে মাথা খেয়ে ফেলে, ভিতরে ভিতরে আপনাদের শরীরটাকে আরো বেশি খেয়ে ফেলে। ব্যায়াম শরীরের ইমিউনিটি বাড়ায়, রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, ফুসফুস এবং কিডনির কার্যক্ষমতা ঠিক রাখে, মস্তিষ্কে ফোকাস বাড়ায় এবং স্মৃতিভ্রষ্ট থেকে রক্ষা করে। এমন করে নিয়মিত ব্যায়ামের উপকারিতা নিয়ে বিশাল পাতা লেখা যায়। নিয়মিত হাঁটুন, গাড়িতে কম চড়ে যে পথটুকু হেঁটে যেতে পারবেন, সেটুকু হেঁটে যান। কাজের লোক কমিয়ে দিয়ে নিজের হাতে ঘরের কাজগুলো করুন। ব্যায়ামের জন্য হাঁটা নয়, বরং রিলাক্স করে হাঁটুন। মন এবং শরীর দুটোই উৎফুল্ল থাকবে।

শরীরের ব্যায়ামের সাথে সাথে মনের ব্যায়াম দরকার। আজে বাজে বই পড়ে, অনলাইনে আজেবাজে লেখা পড়ে মনকে বিষাক্ত করবার চেয়ে প্রতিদিন অল্প করে হলেও ভালো কিছু পড়ুন, ভালো কোন গান শুনুন, ভালো একটি প্রোগ্রাম দেখুন। ধর্মীয় কাজে ভালো লাগলে সে কাজগুলো করুন, তা যেন গোঁড়ামির পর্যায়ে চলে গিয়ে নিজের এবং আশেপাশে ক্ষতি না করে। যে জিনিস পড়তে, দেখতে কিংবা শুনতে গিয়ে সাময়িক মনে হবে বিনোদনের খোরাক, কিন্তু বিনিমযয়ে আপনার মন মস্তিষ্ক এবং চিন্তায় ঢুকিয়ে দেবে অস্বস্তি, ঈর্ষা, অপ্রোজনীয় চাহিদা, তুলনা, ক্ষোভ এবং ক্রোধ। ভালোর বিকল্প শুধু ভালোই। বিনোদনকে শিক্ষণীয় করে তুলুন। দেখবেন, শিক্ষা এবং বিনোদন মনকে কেমন করে প্রজাপতি করে রাখে।

দামি খাবার নয়, পুষ্টিকর খাবার খান। শুনতে হাসি পেলেও খাবার একই সাথে মস্তিষ্ক, পেট এবং পায়ু, তিনটাকেই ঠিক রাখে। খাবার যেমন খাবেন, শরীরের তিন অঙ্গে ঠিক সেই ধরনের প্রভাব পড়বে। নিয়মিত ডিম, দুধ, বাদাম জাতীয় কিছু এবং ফলমূল রাখেন খাবারে। মাংসের চেয়ে মাছ এবং সালাদ বেশি খান। একসাথে অনেক খাবার খাওয়ার চেয়ে কম করে কয়েকবার খান। দিনে একবেলার বেশি ভাত খাবেন না। দু একটি নির্দিষ্ট খাবারে নির্ভরশীল হওয়ার চেয়ে খাবারে বৈচিত্রতা আনুন।

ডাক্তাররা এই সাধারণ নিয়মগুলো মেনে চলে বলে দিনের পর দিন রোগ এবং রোগীর সংস্পর্শে থাকার পরেও তারা ভাল থাকেন ।
যদিও সবাই নয়, যারা মানেন তারা বাঁচেন।

চিকিৎসক কিংবা সেবাকর্মীর বাহিরেও চিকিৎসক নয়, এমন যে কোনো মানুষই এই নিয়মগুলো মেনে চললে সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সবল থাকতে পারেন। রোগ থেকে তিনি দূরে থাকেন না, বরং রোগ তার ভেতরে ঢুকতে পারে না । নিয়মগুলোকে সাধারণ করে নিন। স্বভাব তখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে ।

অপূর্ব চৌধুরীঃ চিকিৎসক এবং লেখক জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য বই: অনুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত

 

Facebook Comments Box
ভাগ