তিতাসের ভালোবাসা

রুহুল ইসলাম টিপু

তিতাস চাকুরী করেন বনানীতে; ভালোলাগে তার নদী, গাছ, পশু, পাখি, ফুল, আকাশ এসব। একটি নদীর নামও তিতাস। নিজেকে নদীর মধ্যে ধারণ করে আছে তিতাস। নদীর প্রবাহমান পানির মতই তিতাসের জীবন; এখন তাকে আর শিশু বলা হয় না; পরিপূর্ণ মানুষ। ঢাকায় মেসে থাকেন, মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডে। জনবহুল ঢাকার কোলাহলের মধ্যে একটি অভাব অনুভব করছে তিতাস। নিড়িবিলি জেলা শহর থেকে পড়াশুনা শেষ করে; চাকুরী একটি ট্রাভেল এজেন্সীর হিসাব রক্ষক। বাবা মোবারক সাহেব তিতাসের জন্মের পূর্বে কিছুদিন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় চাকুরী করেছিলেন। প্রথম সন্তান জন্মের পর তিতাস নাম রেখে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া জেলার প্রতি ভালোবাসাকে বাবা ধরে রেখেছেন। তবে তিতাসের জন্ম ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় নয়; মানিকগঞ্জে মোবারক সাহেবের নিজ বাড়িতে। ডিসেম্বর মাসের ০৭ তারিখে তিতাসের জন্ম, সাল ১৯৯০। বাংলাদেশের মহান বিজয় অর্জিত হয় ডিসেম্বরে। এজন্য বেশ গৌরব অনুভব করেন তিতাস। ০৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ নয় বছরের গণ আন্দোলন সফলতার দিবস। স্বৈরশাসকমুক্ত বাংলাদেশে তার জন্ম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা মোবারক সাহেবের বয়স ছিল ১০। তিতাস জানে মুক্তিযুদ্ধে তার দাদার ভূমিকা, মানিকগঞ্জ শহরের একটি সম্ভ্রান্ত হিন্দু বাড়ীতে অবস্থান করে পরিবারের সকল সদস্যদের রক্ষা করেছিলেন। এটি তার মনোজগতের গর্বের এবং অহংকারের ধন।

তিতাস নির্ধারিত পথে প্রতিদিন অফিসে আসেন; অফিসের ঠিক কাছাকাছি এসে একটি দৃশ্য তাকে খুবই অবাক করে। তাদের অফিসের সামনের রাস্তা উত্তর দক্ষিণ লম্বালম্বি; এর সঙ্গে লাগোয়া পূর্ব পশ্চিম একটি সড়ক। এ সড়কেই সে দেখতে পান একজন নারী প্রতিদিন অনেকগুলো কুকুরকে খাবার দিচ্ছে; কুকুরগুলো রাস্তার; কারো পোষা কুকুর নয়; খাবারগুলো কখনও পচা বাসি এমন নয়। সতেজ, সুস্বাদু এবং বিভিন্ন রকমের খাবার সে কুকুরগুলোকে খাওয়ায়। তার খাবার পরিবেশনা এবং আন্তরিকতা দেখার মতো; তিতাস নিয়মিত এটি উপভোগ করেন। চোখ জুড়িয়ে যায়। এ কাজে মেয়েটির রয়েছে অসীম মমতা, যত্ন এবং ঐকান্তিক ভালোবাসা। কুকুরকে তিতাস একসময় ভয় পেতো। কারণ তার বাবা মোবারক সাহেবকে অনেক পূর্বে একদিন কুকুর কামড়িয়েছিল। সেই থেকে তিতাস কুকুর দেখলে দূরে দূরে থাকতো। তিতাসের খুব ইচ্ছে করে, এ নারীর নাম জানতে। কথা বলার সাহস তার হয়নি। তিতাস ভাবেন, এখন মানুষ মানুষকে ভালোবাসার বদলে করছে ঘৃণা, আহত, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং এমন কি হত্যা পর্যন্ত। সেখানে কুকুরকে ভালোবাসা! এটি ভাবতে তিতাসের আহত মনও আনন্দিত হয়ে উঠে। কুকুরের প্রতি একজন নারীর এতো মমত্ববোধ। মাঝে মাঝে দেখা যায়, রান্না করা গরম খাবারগুলোও দিচ্ছে মেয়েটি। এটি দেখার জন্য তিতাস প্রতিদিন অফিসের নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পূর্বে এ রাস্তার এক কোণে দাড়িয়ে থাকে। খাবারের মধ্যে বিরিয়ানিও থাকে। খবরের কাগজ পেতে বা প্লাস্টিকের প্লেট এ খাবারগুলো সাজিয়ে দেয়। কুকুরগুলো লেজ নেড়ে, মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মেয়েটির সঙ্গে ভাব বিনিময় করে এবং খাবার গ্রহণ করে। এ এক অভিনব দৃশ্য। কুকুরগুলোকে মেয়েটি শাসনও করে। কুকুরগুলো মেয়েটির গায়ে উঠছে; কখনও হাত থেকে বিস্কুট তুলে নিচ্ছে; তাদের সাথে ধমক, ভালবাসা এবং আদরের মাখামাখি এই যে সম্পর্ক এটির উপর পৃথিবীতে আর কিছু থাকতে পারে না, এর নামই কি ভালোবাসা। এ ভালোবাসাই আমার বড় প্রয়োজন, এটি তিতাসের কামনা।

একদিন দেখা যায়, একটি কুকুর আহত এবং শরীরের অনেকাংশ রক্তাক্ত। কেউ এমনভাবে আঘাত করেছে, সেটি দেখে মেয়েটি কেঁদেছিল; রাগে দুঃখে রাস্তায় চিৎকার করে বলছিল, যে আঘাত করেছে, তাকে হাতের কাছে পেলে, এখনই তার বিরুদ্ধে মামলা করে দিবে। কুকুরকে আঘাত করার জন্য মামলা এবং বিচার। যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে কত অসহায় মানুষ বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তিতাস যেন অন্য এক ভালোবাসার পৃথিবী দেখতে পাচ্ছে। তিতাস মেয়েটিকে আত্মিকভাবে সমর্থন দিচ্ছেন। আমি অবশ্যই তোমার সঙ্গে আছি; আমিও লড়বো নির্যাতনকারী অপরাধীর বিরুদ্ধে। অপরাধীর সাজা হবে না, তা হতে পারে না।

গতমাসে বাড়ি যাওয়া হয়নি, তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে; তিতাস ভাবেন, তার স্ত্রী কি এই কুকুরপ্রেমী নারীর মতো হবে; তার বাবা মা বা পূর্বসূরী কি ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? মানুষ, দেশমাতৃকা এবং প্রাণীকুল প্রেমীকে তিতাস বিয়ে করতে চান। তাকে নিয়েই তিতাস দেশ এবং পৃথিবীর সেবক হবেন; এটিই তিতাসের ভালোবাসা।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ