আব্দুর রাজ্জাক
বাহারি ঘুড়িতে ছেয়ে গেছে আকাশ। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি নানা রঙের ঘুড়ি আকাশে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে, রঙের মেলা বসেছে আকাশজুড়ে। এই করোনাকালীন সময়ে বিনোদনের খুঁজে আবার যেন বাঙালি সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া লোকায়ত সংষ্কৃতি ঘুড়ি উৎসব। সারা দেশের মত মানিকগঞ্জের মানুষও মেতে উঠেছেন ঘুড়ি উৎসবে। বিভিন্ন পাড়া, মহল্লায় এখন কেবলই শুধু রংবেরঙের ঘুড়ি নীল আকাশে। শিশু-তরুন-যুবক এমনকি মাঝ বয়সীরাও বাদ যায়নি এই ঘুড়ি উড়ানো থেকে। দিন-রাত আকাশে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ঘুড়ি। বিশেষ করে রাতের আকাশে লাইটিং ঘুড়ির ঝলমলে আলো দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন এলাকার মানুষ।
সরজমিনে দেখা যায়, করোনা আতঙ্কের প্রতিটা বিকেল একটু হলেও আনন্দে পার করছেন গ্রামীণ ঐতিহ্য ঘুড়িপ্রেমীরা। ফলে ঘুড়ি বানানোর ধুম পড়েছে। আকাশে চোখ মেললেই ঘুড়ির লড়াইয়ের দৃশ্য! জেলার বিভিন্ন এলাকায় দিন-রাত ছোট-বড় নানা বয়সী ঘুড়ি প্রেমী মেতেছেন এই ঘুড়ি উৎসবে। সকাল-বিকাল বাড়ির ছাদে, খোলা মাঠে, খালি জায়গায় ঘুড়ি উড়াতে দেখা যায়। করোনাকালে কিশোর-যুবকদের বাড়িতে রাখতে অনেক অভিবাবকই ঘুড়ি বানিয়ে বা বাজার থেকে কিনে এনে দেন। জেলায় অনেকেই ঘুড়ি বানানোর ব্যবসা করছেন। ঘুড়ি বাজারে বিক্রি করে তাদের সংসার আয় বাড়াচ্ছেন। বর্তমানে চাহিদা বাড়ায় ২০০ থেকে ৫০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এসব ঘুড়ি। প্রতিদিন আকাশে দিন-রাত্রি পর্যন্ত উড়তে দেখা যায় চিলা, কয়রা, ঢোল, পতিঙ্গা, পাখি, পরি, বাচ, ফুল, প্রজাপতি, সাপাসহ রং বেরঙের ঘুড়ি আকাশে উড়ে।
জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে অভিজাত লোকদের বিনোদনের জন্য ঘুড়ি উড়ানোর আয়োজন করা হতো। ১৭৪০-এর দশকে নায়েব-এ-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঢাকাসহ মানিকগঞ্জে ঘুড়ি উড়ানো উৎসব একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়। তখন থেকেই আমাদের মানিকগঞ্জের খোলা আকাশে অনেক ঘুড়ি উড়তে দেখা যায়। বর্তমানকালে বিনোদনের এতসব উপকরণ থাকা সত্ত্বেও ঘুড়ি উড়ানো একেবারে বন্ধ হয়ে তো যায়ইনি, বলা যায় ভালো রকমেই টিকে আছে।
মানিকগঞ্জের ঘুড়ির আছে বাহারি নাম। কোনোটার নাম কালাপাহাড়, কোনোটার নাম লালপাহাড়, কোনোটা চুড়িদার, পেটকাটা, চুমকি, পঙ্খিরাজ, আবার কোনোটার নাম প্রজাপতি। ঘুড়ি সাধারণত দুই ধরনের। সুতাওয়ালা এবং সুতাবিহীন ঘুড়ি। সুতাওয়ালা ঘুড়ির মধ্যে আছে ঘুড্ডি, ঢাউশ, চং, চোঙা। আর সুতাবিহীন ঘুড়ি হলো ফানুস, বেলুন, হাউই ইত্যাদি। ঢাউশ শব্দ থেকে বোঝা যায় এটা বিশাল আকৃতির উপবৃত্তাকারের ঘুড়ি। আকাশে ওড়ার সময় দেখতে অনেকটা উড়ন্ত চিলের মতো লাগে বলে একে অনেক সময় চিলি বলা হয়। মাছ বা প্রজাপতির আকারেও ঘুড়ি বানানো হয়। বড় আকৃতির অন্য একটি ঘুড়ির নাম উড়োজাহাজ ঘুড়ি। এটি আকাশের অনেক উপরে ওড়ে। এই ঘুড়ি উড়ানোর জন্য শক্ত সুতার প্রয়োজন হয়। অন্য এক ধরনের ঢাউশ ঘুড়ি হলো ঢোপ। এটি একটি ত্রিমাত্রিক আকাশযান এবং জেট বিমানের মতো ওড়ে। চং ঘুড়ি দেখতে অনেকটা ট্রাপিজিয়মের মতো, যার উপরের আর নিচের বাহু দুটি পরস্পর সমান্তরাল এবং উপরের বাহু নিচের বাহু অপেক্ষা ৯ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বড় হয়। কিছু কিছু চং ঘুড়ি দেখতে ঠিক মানুষের মতো। তাই এটিকে মানুষ চং বলা হয়। এটি উড়ানো হয় রাতে এবং এর দু’হাতে দুটি মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আর সেই মশালের আলোতে এটিকে দেখা যায় হেলেদুলে হাত-পা নেড়ে আকাশে উড়তে। সুতাবিহীন ঘুড়ির মধ্যে অন্যতম হলো ফানুস। ফানুস আসলে মুখ খোলা বিরাট আকারের বেলুন। ফানুসের নিচের দিকে একটা প্রশস্ত মুখ থাকে, যা দেহের আয়তনের তুলনায় সরু। মুখটা খোলা থাকে এবং একটা খিল বৃত্তাকারে বাঁকিয়ে মুখটা গোল করে বানানো হয়। ফানুসের সমস্ত দেহটা পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি করা হয়। ফানুসের মুখের নিচে লোহার একটা শিক ঝুলানো থাকে। ঝুলন্ত শিকটার মাঝখানে তুলা বা ন্যাকড়া জড়িয়ে তেল দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া হয়। উড়ানোর সময় ফানুস মশালের মতো শিখাসহ জ্বলতে থাকে আর উপরের দিকে উঠতে থাকে। ফানুস আকাশে কয়েক মাইল পর্যন্ত উড়ে থাকে। আমাদের মানিকগঞ্জে বুদ্ধপূর্ণিমার সময় ফানুস উড়ানো হয়ে থাকে। এছাড়াও আছে নৌকা ঘুড়ি, ঘড় ঘুড়ি, সাপা ঘুড়ি,মানুষ ঘুড়ি, চারকোণা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, কামরাঙা, চরকি লেজ, চিলঘুড়ি, বেত, ডাক, মানুষ ও তারাঘুড়ি, পাল তোলা জাহাজ চিলা ঘুড়ি,কৈইরা ঘুড়ি,বক্স ঘুড়ি, ডুল ঘুড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি ঘুড়ি।
ঘিওরের বানিয়াজুরী এলাকার ঘুড়িপ্রেমী ইসতিয়াক আহমেদ জানান, পড়াশোনার চাপ না থাকায় তারা বেশিরভাগই ঘুড়ি কিনে উড়িয়ে থাকে। গ্রামে ঘুড়ি তৈরিতে যুবকরা ব্যস্ত সময় পার করছে। তাদের কাছেই এখন মিলছে ঘুড়ি। সাধারণত যেকোনো ডিজাইনের একটি ঘুড়ির দাম ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
ঘুড়ি বানানো কারিগর ছৈয়দ আলী জানান, এখন প্রচুর পরিমাণে ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে। কারণ করোনাভাইরাসে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোররা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। তাই বিকেলে একটু আনন্দ পেতেই তারা ঘুড়ি উড়াতে মেতে উঠছে। বাশঁ, বেত এবং বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক-কাগজের মোড়কে ঘুড়ি বানানো হয়। আবার কেউ ঘুড়িতে বাতি লাগিয়ে নিয়ে রাতের আকাশে উড়িয়ে থাকে। ঘুড়ি বিক্রি করে সংসারের জন্য কিছু আয় হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
রাতে ঘুড়ি উড়ানোর জন্য ঘুড়িতে যুক্ত করা হচ্ছে ব্যাটারি চালিত বাতি, যা রাতে উড়ানো ঘুড়িতে জ্বলছে। বড়দের কেউ কেউ ঘুড়ি বানাতে পারলেও শিশু-কিশোররা বেশিরভাগই ঘুড়ি কিনে উড়িয়ে থাকে। আবার যাদের ঘুড়ি উড়ানোর সুযোগ নেই তারা দূর থেকে অন্যের ঘুড়ি উড়ানো দেখে আনন্দ উপভোগ করছেন। ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি তৈরি করার উপকরণও। সেই সাথে কদর বেড়েছে ঘুড়ি তৈরির কারিগড়দের।
এ প্রসঙ্গে বায়রা গ্রামের ঘুড়ি কারিগড় কালিপদ কবিরাজ বলেন,আমি ছোট বেলা থেকেই ঘুড়ি তৈরি করতাম নিজে উড়ানোর জন্য। আগে ঘুড়ি উড়ানো ও ঘুড়ি উৎসব হতো। কিন্তু এখন আর আগের মত এই ঘুড়ি উৎসব হয় না। করোনার কারণে মানুষ অবসর সময় কাটানোর জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঘুড়ি উৎসবে মেতেছেন। তিনি আরও বলেন, ঘুড়ি বিক্রি করে চলতি মাসে আমার ১৫ হাজার টাকা আয় হয়েছ। ঘুড়ির প্রতি যুবক শ্রেণীর মধ্যে বেশি আগ্রহ।
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আইরিন অক্তার বলেন, আধুনিক নেটপ্রেমী কিংবা স্মার্টফোনে বুঁদ হওয়া তরুণ প্রজন্মকে মাঠে ফেরাতে দারুণ কাজ করছে ঘুড়ি। শিশুরা বড় হচ্ছে খাঁচার মধ্যে। ঘরে বসে শিশুরা কম্পিউটার বা ভিডিও গেইম খেলে সময় কাটায়। যারা মাঠে যায়; তারা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে। গ্রামীণ শিশুদের মধ্যেও ক্রিকেট খেলার জোয়ার বয়ে গেছে। এসব খেলার ভীরে ঘুড়ি ওড়ানো খেলা একেবারে বিলীন হয়েছিল প্রায়। তবে এখনকার চিত্র দেখলে মনে হচ্ছে, সেই ঘুড়ি ওড়ানো বিকেলগুলো হয়তো আবার ফিরে এসেছে। গ্রামেগঞ্জে এখন ঘুড়ি উড়ানোর সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। করোনার অবসরে সব বয়সের মানুষ ঘুড়ি উড়াচ্ছে। নীল আকাশে স্নিগ্ধ বিকেলে যেন ঘুড়ির মেলা বসেছে।