ফিরে দেখা অতীত, জীবন-চার
মধুসূদন সাহা
আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন
মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন
বলছিলাম দাশড়া গ্রামের কথা। গ্রাম শহরের মিশেল এই দাশড়া গ্রাম বা শহরতলী। জন জীবনে এই দুইয়ের মিশেল সংস্কৃতি এখানে। শহরের স্কুল থেকে সাইকেলে টিফিন পিরিয়ডে বাড়িতে এসে আবার যাওয়া যেত। এহেন শহরতলীতে প্রায় সকল পেশার মানুষের বসবাস ছিল। কামার, জেলে, স্বর্নকার, কৃষক, কুলী, মুজুর, ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা, চামার, মেথর, উকিল মোক্তার সহ প্রায় সবার বসতি ছিল। ছিল না শুধু কুম্ভকার(কুমার)। হিন্দু মুসলমানের যুগপৎ বসবাস ও সম্প্রীতি ছিল এখানে। পূর্ব দাশড়া হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। মুসলিম পরিবার ছিল হাতে গোনা। আর পশ্চিম দাশড়া মুসলিম অধ্যুষিত ছিল। হিন্দু পরিবার ছিল হাতে গোনা। মাঝখানে বিভাজিকা শহরের রক্তনালীর মত আজকে বিলুপ্ত নিকট অতীতে স্রোতধারায় প্রবাহিত মানিকগঞ্জের ঐতিহাসিক খাল।
জনবসতির মানিকগঞ্জে হরিজন পল্লী ঋষিপাড়ার কথা আগে বলেছি। এই ঋষিপাড়া থেকে উত্তরে একটু হেঁটে আসলেই হাতের ডান দিকে প্রাচীন জনপদের চিহ্ন বিদ্যমান। পাঁচু বেপারী গংরা যে বাড়িতে বসবাস করতেন। ক্রয় সূত্রে না। বন্দোবস্ত বা দখলে আমার জানা নেই। ওটা ছিল মানিকগঞ্জ কোর্টের বিখ্যাত উকিল সুরেশ চন্দ্র ও দীনেশ চন্দ্র সেনদের বাড়ি। প্রাচীন দালানের কাঠামো ও দুটি দূর্গা মন্দির ছোটবেলায় আমার নিজের দেখা।
এ সমস্ত বাড়ির পরে একটু উত্তরে হাতের ডানদিকে ছিল মোহিনী রায়ের বাড়ি। তিনি স্বনামধন্য দারোগা ছিলেন। দারোগা বাড়ি বলেই পরিচিত। থাকতেন ঐ একই পরিকাঠামোয় ফারুক সাহেব। মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য চিত্রকর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর আমাদের অগ্রজ লুই ভাইরা। ফারুক সাহেব বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও বাবার বন্ধু ছিলেন। আমাদের বাড়িতে ও উৎসব অনুষ্ঠানে উনার যাতায়াত ছিল। আর লুই ভাইয়ের সাথে আমারও একই রকম সম্পর্ক। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে আমি প্রাচীন বাংলায় যে কয়টা দারোগা বাড়ি দেখেছি সব গুলোর সন্মূখভাগ প্রায় একই রকম। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা যেতে নয়াডিঙ্গি ও বাড়বাড়িয়া ব্রীজের মাঝখানে হাতের বাঁদিকে একটা পুরাতন দালানের কাঠামো ছিল। এখন আছে কিনা জানিনা। অনেকেই দেখে থাকবেন। ওটা লুই ভাইদের সাদৃশ্য বাড়ি। ওটাও দারোগা বাড়ি ছিল। আমি অনেক বার কাছ থেকে দেখেছি। অনুরূপ বাড়ি ছিল ঘিওরের মৌহালিতেও।
ফারুক সাহেবের বাড়ির কাছাকাছি আরেক হরিজন পট্টি বাগদী পাড়া। এরূপ পাড়া পৌরসভার উচুটিয়াতেও আছে। এরাও ধর্মে হিন্দু। পেশা মুটে, কুলী। হাল আমলে বহুমুখী। এদের মূল কর্মসংস্থান ছিল দাশড়ার চারটি ও বেউথার খাদ্য গুদামে। নিকট অতীতে লোহার পুল (পুরাতন) সংলগ্ন এক নম্বর গুদামটি সংস্কার করে মহকুমা খাদ্য অফিস তৈরি করা হয়। যা এখনও বিদ্যমান। চারটি দালানের গঠন ও মাপজোক কিন্তু একই। এখানেই আমরা এদের জীবন জীবিকা দেখেছি। এ সম্পর্কে পরে আর একটু আলোচনা করা যাবে প্রাসঙ্গিক ভাবে। এই বাগাদী পাড়ায় একটা বাইচের নৌকা আমি অনেক দিন দেখেছি। বড় ছিপি নৌকার গলুইয়ে লেখা থাকত মন্মথ চন্দ্র কর্মকার।
এদের সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে এরা এই অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা মনে হয় না। প্রাচীন শাসকগোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজনে উপমহাদেশের কোন জায়গা থেকে এদের নিয়ে এসে থাকবেন। নৃতাত্ত্বিক ভাবে আমরা আর্য আর দ্রাবিড়ের সংকর। এদের মধ্যে দ্রাবিড়ের বৈশিষ্ট্যই সবটুকু। তাই আমার এ ধারণা। এছাড়াও মেথর ও চামাররাও নিশ্চিত আগত।
দাশড়ার পেশা ভিত্তিক পাড়ার মধ্যে ধোপা পাড়া অন্যতম। এর সাথেও আমাদের প্রাচীন যোগাযোগ। নিম্ন মধ্যবিত্ত এই পাড়ায় পুরোটাই জাতি ব্যবসা করত। পাশে ছিল রায় বাড়ির বিশাল পুকুর। এই পুকুরে ও এদের বাড়ির উঠানে অনেক কাপড় কাঁচার কাঠের স্থায়ী কাঠামো দেখা যেত। আমাদের কাছে পরিচিত ছিল ধোবাবাড়ি বলে। এখানে দুই ধরনের ধোপা ছিল। একদল বাড়ি দোকানে কাপড় সংগ্রহ করে প্রক্রিয়ার পর ওভাবেই ডেলিভেরী দিত। আর একদল শহরের বিভিন্ন জায়গায় দোকান নিয়ে কাজ করত। তবে জামাকাপড় ঝকঝকে করে দিত। নিখুঁত কাজ। এদের বাড়ির সামনে কালীমন্দির। বাৎসরিক পূজা হত। আর মন্দির সংলগ্ন ছোট্ট একটা মাঠের মত ছিল। সেখানে প্রতিবছর দোলের জমজমাট মেলা বসত। দোলের দিন একবেলা বিকেলে অনেকেই বাড়িতে রথাকৃতি ছোট ছোট রঙ কাগজের কাঠামো বানিয়ে তার মধ্যে গোপাল নিয়ে মেলায় আসত। খুব ছোটবেলা থেকেই আমিও যেতাম আমাদের দোলের কাঠামো নিয়ে। বেশির ভাগ সাথে থাকত আমার ছোট দিদি। এই মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল তক্তা বিস্কুট। মেশিন বা বেকারীতে তৈরি নয়। হাতে বানানো গুড় আর আটার মিশ্রণে ৬/৭ ইঞ্চি আয়তাকার পাতের মত। তবে মুচমুচে। বিস্কুটের পূর্ব পুরুষ আর কি। আর সব অন্যান্য মেলার মত। আমরা যার যার দোল নিয়ে লাইন দিয়ে বসে যেতাম। অনেক দোল হত। কাঠের কাঠামোর সবচেয়ে বড় দোল আসত জেলে পাড়ার, সাথে বাদ্যকর। মেলায় প্রচুর লোক সমাগম হত। অনেকেই দোলে আবির ছিটিয়ে এক পয়সা, দুই পয়সা দিত। কদাচিৎ ৫ পয়সা দিত কেউ কেউ। আর এই দোল নিয়ে পয়সা তোলাই আমাদের মেলায় যাওয়ার অন্যতম আকর্ষণ ছিল। তাছাড়া অনেক বছর দোলের সাজানোর উপর মেলায় পুরস্কার থাকত। সন্ধ্যা বেলার একটু আগে দোল নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে পাড়ায় পাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঘোরা। অনেকেরই কাছে কাশি থাকত। তা বাজাতে বাজাতে এ বাড়ি ও বাড়ি। এটা দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ছিল। তবে আমাদের মূল লক্ষ্যই ছিল পয়সা তোলা। পাড়ায় বাড়ি বাড়ি যাওয়ার আগে সবাই মিলে সুর করে গান গেয়ে জানান দেওয়া হত, সাথে কাশির বাজনাতো ছিলই। যতদূর মনে পড়ে গানটা ছিল এরকম-
জয় দে লো গোপালের মা
গোপাল এল দোরে
ধান দূর্বা দিয়ে গোপাল
বইড়া নে লো ঘরে।।
অনেক দোলেই ব্যাটারীর সাহায্যে লাইটের ব্যবস্থা ছিল। তবে আমাদের মোমবাতি। পাড়া শেষ হলে বাজারে, দোকানে দোকানে। কাছারি পর্যন্ত। যতীন ঘোষের বাড়ির রাস্তার উল্টোদিকে তখন যৌন কর্মীদের পল্লী ছিল। যা বেশ্যাপট্টি নামে পরিচিত। ওরা নাকি দোল নিয়ে গেলে অনেক পয়সা দিত। আমি অবশ্য কোনদিন যাইনি ভয়ে। আটটা নয়টার সময় বাড়িতে এসে দোল সহ ঠাকুরের ভোগ হত। খিচুরী, পায়েশ, লাবড়া ও ভাজা। খেয়ে দেয়ে ঘুম। তবে পয়সার উত্তেজনায় ভাল ঘুম হত না। সকালে উঠেই পয়সা গোনা। এক পয়সা, দুই পয়সাই বেশি। কিছু পাঁচ ও দশ পয়সার কয়েন। কদাচিৎ সিকি। দু’টাকা থেকে চার টাকার মধ্যে থাকত। তারপর ভাইবোনদের মধ্যে ভাগ হত। বেশ কিছু দিন তেলে ঝালে থাকা যেত রাজার হালে।
এর একটা ভয়াল স্মৃতি আছে। একবার মেলা থেকে সন্ধ্যার একটু আগে দোল নিয়ে বেরিয়েছি। সাথে দিদি ও আরও কয়েক জন। হঠাৎ শুরু হলো কাল বৈশাখী। মুহুর্তে ধূলায় গাছের ডাল পালা, জলে একাকার হয়ে গল। আমার মাথা থেকে দোল ও আমাকে ধরে দিদি সহ অনেকেই কাছের ঘোষ বাড়িতে উঠলাম। বাড়ি তো নয় পারি বাসা যেন। ঝড় জলের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। সেই সাথে দুলতে খাকলো ঘর। বড়রা ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে গেল। আমরা ছোটরা পাঁচ ছয় জন চকির তলায়। কান্না আর চিৎকারের রোল পড়ে গেল। বাড়ি বাড়ি শঙ্খ বাজতে লাগলো। আধ ঘন্টার তান্ডবের পর কমলে বাড়ির পথ ধরলাম। সে বছর আর দোল নিয়ে ঘোরা ও টাকা তোলা হয়নি। সে স্মৃতি আজকেও শিহরিত করে।
ধোপা বাড়ির দক্ষিণে পটলের চক পর্যন্ত ডাইনে বায়ে প্রান্তিক মুসলমান অধ্যুষিত জনপদ ছিল। এখন অবশ্য সে অবস্থায় নেই। এদের অনেকের সাথেই আমাদের আত্মার সম্পর্ক ছিল। হজা কমিশনারের বাড়ির কাছে ছিল আমাদের আমিনা দিদিগো বাড়ি। আমিনা দিদি ও তার মা আমাদের বাড়ির নিত্য দিনের সহযোগী। আমেনা দিদির কোলে পিঠে আমি ছোট বেলায় বড় হয়েছি। ওর ছেলে দেলু আর আমি মামা ভাগ্নে। আমিনা দিদি ২য় বিয়ে করেছে রওশন আলীর বড় ছেলে হযরতের সাথে। ঐ বাড়িতেও আমি গেছি। এদের মানিকগঞ্জ মহিলা কলেজের পাশে কাওছার ভাইদের বাড়ির উল্টো দিকে বেকারী ছিল। জানিনা আমার আমিনা দিদি কেমন আছে।
হজা কমিশনারদের পাড়ায় ছিল নইমুদ্দিন চাচা। তার ছেলেরা শান্তু, মেঘা। আমাদের পটলের চকের জমির বর্গাদার ছিল। এই অঞ্চলের প্রায় মানুষই কোন না কোনভাবে ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্কিত ছিল।
এই অঞ্চলের আরেক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মোশারফ হোসেন ভাই। নির্বিবাদী, সঙ্গীত সাধক ও প্রগতিশীল মানুষ। আজীবন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা। কোন লোভ লালসা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। একজন সাচ্চা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
ধোপা বাড়ির পাশে রায় বাড়ির পুকুর আয়তনে বিশাল। দেবেন্দ্র কলেজের পুকুর ছাড়া এত বড় পুকুর মানিকগঞ্জ শহর বা শহরতলীতে খুব কমই চোখে পড়ে। এই প্রাচীন পুকুরের ঘাট বাঁধানো ছিল। ভগ্নদশা আমরা দেখেছি। এটা ছিল আমাদের স্নানের অন্যতম পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে দুই বিশিষ্ট পরিবারের বাড়ি ছিল। তাদের একজন নিশিকান্ত রায় বাহাদুর। বৃটিশ সরকারের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। খান বাহাদুর আওলাদ হোসেনের মত উনারও রায় বাহাদুর উপাধি বৃটিশের দেওয়া। পরিত্যক্ত অবস্থায় এই বাড়িতে বসবাস করত ইয়াকুব পেশকার। উনার বড় ছেলে হাসান ভাই। প্রয়াত মেঝ ছেলে বি এ হায়দার টুটুল আমার ছোটবেলার বন্ধু ও ক্লাসমেট ছিল। সে কাহিনী পরে বলব।
এই বাড়ির দক্ষিণে আরেক বিখ্যাত রায় পরিবারের বসতি ছিল। শ্রীপতি কান্ত রায় আর নৃপতি কান্ত রায়। প্রথমজন মানিকগঞ্জের হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী এরা দাশড়ার জমিদার ছিলেন। উপরোক্ত দুই রায় বাড়ির পুরোনো কাঠামোর ভগ্নাংশ এখনও বিদ্যমান। আর এই পাড়াটা এখনও রায় বাড়ি বা রায় পাড়া নামে পরিচিত।
রায় বাড়ির উত্তরে শর্মা ডাক্তারের বিশাল বাড়ি ছিল। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ছিলেন। তারচেয়েও বড় পরিচয় তিনি কালী সাধক ছিলেন। উনার বাবাকেও আমরা দেখেছি কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করতে। দীপাবলির কালী পূজায় পাঁঠা বলি আমি নিজে দেখেছি। বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক অস্থায়ী দোকানপাট বসত। পরদিন হত কবিগান। লোকে লোকারণ্য থাকত।
শর্মা ডাক্তারের বাড়ির উত্তরে ছিল আরেক জোতদার বল্লভ বেপারীর বাড়ি। স্বামী স্ত্রী দুজনকেই ছোট বেলায় দেখলেও স্পষ্ট মনে আছে। আমাদের সহ বেশ কয়েক পাড়ার মানুষের স্নানের পুকুর ছিল বল্লভ বেপারীর পুকুর। বাড়ি, উঠোন সহ পুকুরের দুই পাড়ে বিশাল চালা সহ বিরাট জায়গা জুড়ে বাড়ি। বাসন্তী পূজা হত বাড়িতে। উনার ছেলে মঙ্গল কাকা আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। মঙ্গল কাকার মেয়ে অনিমাদি আমার দিদির সাথে পড়তো। বল্লভ বেপারী দাঁত ব্যথার চিকিৎসা করতেন। ছোটবেলায় দাঁতের ব্যথা হলে আমরা সবাই উনার কাছে ছুটে যেতাম। আমার নিজের দাঁতের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য ঘটনার স্বাক্ষী আমি। একদিন ভোরে দাঁত ব্যথার নিরসনে ছোটবেলায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বল্লভ বেপারীর কাছে। আমাকে দাড় করিয়ে একটা গাছন্ত (গাছের শাখা প্রশাখা) আনলেন। বসিয়ে হা করতে বললেন, ঐ কাঠিটা মুখে ঢুকিয়ে বিড় বিড় করে এদিক ওদিক নাড়লেন। যা দেখলাম তাতে অবাক তো হলামই, যা আজ পর্যন্তও আমার রেশ কটেনি। আমার মুখ থেকে জড়াজড়ি করে থাকার দুটো সাদা রঙের ছোট পোকা পড়ল মাটিতে। বর্ণনায় বুঝতে পেরেছেন আমি তখন বোধ সম্পন্ন। দৃষ্টি বিভ্রম বা অলীক কল্পনা নয়।
বল্লভ বেপারীর বাড়ির পূর্ব দিকে এক দুয়ারের বাড়ি ছিল হরিদাস সাহার। উনার তিন ছেলেই সামাজিক ভাবে গ্রামে শহরে পরিচিত ছিলেন। বড়জন সুভাষদা ক্রীড়াবিদ, দাশড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির অন্যতম সংগঠক, আইনজীবী, সমাজসেবক ও ফিফা তালিকাভুক্ত রেফারি ছিলেন। মেঝ জন পিযুষদা ছিলেন মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য তবলা বাদক, ব্যবসায়ী। একসময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একচেটিয়া বাজাতেন। তার ছোট জন গুরুদাসদা ক্লাব সংগঠন, পূজা কমিটি, সমাজসেবা সহ সামাজিক লোক। উনার সাথে আমরা দাশড়ার মাঠে একটা ব্যয়াম প্রশিক্ষণাগার তৈরি করেছিলাম। যেখানে এখন পল্লীমঙ্গল সমিতির ক্লাবঘর। চারিদিকে ঘেরা জায়গায় উনি আমাদের ব্যয়াম প্রশিক্ষণ দিতেন। অনেকেই ছিল। আমার সন্তোষের কথা মনে আছে। খুব ভাল শিক্ষা উনার থেকে পেয়েছিলাম। সেজন্য সম্বোধনে উনি এখনও আমার ওস্তাদ। উনার এক ছোটভাই ছিল রঞ্জিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিল। আমাদেরও জুনিয়র। জগন্নাথ হলের ঐতিহাসিক ছাদ চাপায় নিহত হয়েছিল। বড় হৃদয় বিদারক ঘটনা।
ঐ বাড়ির পূর্বে পাল পাড়া। কিরন পাল, কালা পাল, মনিন্দ্র পাল। এই পরিবারের সাথে আমাদের অনেকটা আত্মীয়তার সম্পর্ক। মৃনালদা ও মীরাদি আমার দিদিদের সাথে পড়ত। ভারতী দিদি আমার ছোটদিদির বান্ধবী। দুলালদার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এখনও মিস করি। শম্ভুদা বুলবুল খেলার ওস্তাদ। মানিকগঞ্জের প্রথিতযশা সংগীত শিল্পী কাজল পাল শম্ভুদার স্ত্রীও শ্রদ্ধেয়। যদিও সরাসরি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ঐ বাড়ির সুশীল পাল তনু আমাদের ছোটভাই। ওর ভ্রাতৃবোধ, সহমর্মিতা, ত্যাগ তিতিক্ষা আজকের যুগে বিরল। সমাজজীবনে এটা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আর মৃনাল পাল দাদা দিদির গার্লস স্কুলের ক্লাসমেট। শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান গরিমায়, সামাজিক অবস্থানে নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে শ্রদ্ধার।
উনাদের পাশে বাকালি পাড়া। নোয়াই বাকালি বাবার বন্ধু ছিলেন। বাজার লক্ষ্মীমন্ডবের কীর্তন দলের অন্যতম মুখ। ঐ বাড়িতেই মঙ্গল বাকালির (গুতা বাকালি) সাথে অফুরন্ত স্মৃতি যা আরেক দিন।
(চলবে)
কড়চা/এম এস