ফিরে দেখা অতীত জীবন
মধুসূদন সাহা
কড়চার সম্পাদক সুরুয খান ও আমি একই শহরে বাড়ি ও মানুষ হলেও বাল্যবন্ধু না। আমাদের পরিচয় কলেজ জীবন থেকে। কারণ ওর উচ্চ পদস্থ সরকারি আমলা পিতা চাকুরী সূত্রে জেলা উপজেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেই সাথে ওরাও। তবে সম্পর্কের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ওর সাথে আমার সম্পর্কের রসায়নে কখনও ভাটা পড়েনি। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে। স্থান, কাল, পাত্র নন বা দূরত্ব কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
কলেজ জীবনের শুরু, মানে ১৯৭৭ সন থেকে আজ পর্যন্ত সম্পাদক সুরুয খান মানিকগঞ্জে, স্বল্প পরিসরে হলেও জাতীয় ভাবে সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে।
ওকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সময়ে মানিকগঞ্জে এক সাহিত্যের বলয় তৈরি হয়েছিল। যাকে তদানীন্তন সময়ের প্রধান বলয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেই বলয়ের আমি একজন সদস্য। আমার মধ্যে সাহিত্যের সৃষ্টিশীল কিছু থাকলে তার মধ্যে ওর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। কথা প্রসঙ্গে মানিকগঞ্জের অন্যতম সাপ্তাহিক কড়চা-তে ও আমাকে উপরোক্ত শিরোনামের উপস্থাপনার যে দায়িত্ব দিয়েছে তাতে এই প্রসংগটা আসেই। ব্যক্তি পূজা না, বিষয় উপস্থাপনার প্রয়োজনেই এটা উল্লেখ করলাম। এ তো সিন্ধুতে বিন্দু। যথাসময়ে ও স্থানে এই আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ করে আমি আমার উপরোক্ত উপস্থাপনার সত্যতা প্রমাণ করে দিব।
এবার প্রসংঙ্গে আসি। অতীত হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগের সময়কাল। অতীত স্মৃতিচারণ যোগ্য, স্মরণীয় কিন্তু সবসময় বরনীয় নয়। অতীত প্রীতিও সর্বদা সুখের নয়। অতিরিক্ত অতীত প্রীতি মানে সীমাবদ্ধ গন্ডিতে বিচরন, বর্তমানকে অস্বীকার করার সামিল।
“আধুনিক হতে বা থাকতে হলে অতীত ও ঐতিহ্যপ্রীতি বর্জন করতে হয়, কারণ তা পিছুটান মাত্র– যা ধরে রাখে, ভরে তোলে না, আবর্তিত রাখে, এগিয়ে দেয় না সন্মুখের দিকে।” [প্রগতির বাধা ও পন্থা, আহমদ শরীফ,পৃঃ৬৪।]
আমার আলোচনা এই আঙ্গিকেই হবে। ভাল মন্দ স্থান কাল পাত্রের বিবেচনায়। তবে অতীত অনুকরন বা ফিরে যাবার আমন্ত্রণ পত্র নয়।
আমার দেখা অতীতের সময় বলতে প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল আগে থেকে শুরু হবে। আমার ষাটের কাছাকাছি জীবনে ওটাই আমার স্মৃতি শক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিষয়ের কারণে আরও আগে বিচরণ করতে হলেও তা হবে শ্রুতি থেকে।
পৃথিবীর সভ্যতা নদী/সমুদ্র ভিত্তিক। নদীকে কেন্দ্র করে তার তীরবর্তী অঞ্চলে সুপ্রাচীন থেকে প্রাচীনকাল পর্যন্ত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ভারত উপমহাদেশের সুপ্রাচীন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতাও গড়ে উঠেছিল সিন্ধু, সরস্বতী প্রমুখ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে। তেমনি টেমস নদী তীরে লন্ডন, নীল নদের তীরে মিশর, যমুনা নদীর তীরে দিল্লি, বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা, নবাবী আমলের বাংলার মসনদের মুর্শিদাবাদ গঙ্গার তীরে। ইংরেজদের হাতে কলকাতা শহরের পত্তনও গঙ্গা নদীর তীরে। প্রায় এমনই ইতিহাস পৃথিবীর মানচিত্রে। তার কারণ খুব সহজ। তখন যান চলাচলের যান্ত্রিক ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়নি। স্থল যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। যা ছিল খুবই কষ্ট সাধ্য। এই সেদিন, বছর তিরিশের আগের কথা। আমি নিজে কর্মসূত্রে মানিকগঞ্জ থেকে বর্ষাকালে বরঙ্গাইল হয়ে নাগরপুর গেছি ১৫/১৬ টা খেয়া পার হয়ে, অথবা তরা থেকে জলপথে। এর থেকে প্রাচীনকালের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমাদের ধারণা ও বাস্তবতা একই। মানিকগঞ্জের সভ্যতাও শুরু হয়েছিল নদীকে কেন্দ্র করে। মানিকগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থে প্রাচীন মানিকগঞ্জ সম্পর্কে আলোচনায়ও এই বিষয়টি উঠে এসেছে। ফরিদপুর থেকে সাভার পর্যন্ত সমুদ্রের খাড়ি সাদৃশ্য জলাশয় ছিল। তাকে বলা হত টোল সাগর। এখানে জেগে উঠা ভূমিতেই প্রাচীন মানিকগঞ্জ। আর ভিতর দিয়ে শিরা উপ শিরার মত যে জলধারা সৃষ্টি হয়েছিল তাই এই অঞ্চলের খাল, বিল, নদী, নালা। আর এগুলোর স্রোতস্বিনী প্রধান ধারা সমূহই মানিকগঞ্জের অন্যতম নদী খাত। এর মধ্যে মানিকগঞ্জের সীমানা ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে পদ্মা, যমুনা আর মানিকগঞ্জের মানচিত্রে পথ করে বয়ে চলেছে বা মৃতপ্রায় কিছু নদী খাত যা কালীগঙ্গা, ইছামতি, ধলেশ্বরী প্রমুখ নামে পরিচিত। আর আছে এদের শাখা প্রশাখা। এমনই এক নদী প্রবাহের তীর ঘেঁষে জন্ম হয়েছিল প্রাচীন মানিকগঞ্জের সভ্যতার প্রধান বলয়ের ভিত্তি প্রস্তর। তা কিন্তু কালীগঙ্গা না, ধলেশ্বরী।
টাংগাইলে যমুনা নদীর উৎসমুখ থেকে ধলেশ্বরী ১২০ কিলোমিটার এর মত প্রবাহিত হয়ে, এলাসিন ঘাট পার হয়ে মানিকগঞ্জের কাছাকাছি এসে দক্ষিণ ও উত্তরে দুটি শাখায় বিভক্ত ছিল। উত্তরের ধারাকে ধলেশ্বরীর মূল প্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত ছোট ধলেশ্বরীর শাখা আয়নাপুরের কাছাকাছি কালীগঙ্গায় মিলিত হয়েছে। আর এই শাখারই অপর দু’টি ধারা মানিকগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যা এককালে প্রমত্তা ধলেশ্বরী নামে পরিচিত ছিল। আর এর তীরেই গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মানিকগঞ্জ। ১৮৪৫ সনে মানিকগঞ্জ মহুকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ধলেশ্বরীর উপকুলে। বিশ শতকের গোড়ায় মানিকগঞ্জ মহুকুমা দাশড়া মৌজায় স্থানান্তরিত হয়। আর ১৮৮৫-৯০ সনে তার বর্তমান জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
মানিকগঞ্জের ইতিহাস অনুযায়ী ১৯৪০/৪৫ পর্যন্ত মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীতে সব ধরনের নৌকা লঞ্চ ষ্টীমার চলত। আমার কাকাতো ভাই মিন্টুদা নিশি বাবুর কাছারির কাছ থেকে লঞ্চে সাভার যাওয়ার স্মৃতি আমাকে বলেছেন। বর্তমানে উনার বয়স ৭৫ এর কাছাকাছি। সে হিসেবে এটা ১৯৫০/৫৫-ই হওয়া উচিত। তাছাড়া এখানে থেকে এলাসিন, সাভার, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে জলযানে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। মানিকগঞ্জের উপর দিয়ে বহমান ধলেশ্বরীর দুই ধারা আজ মৃত। কোথায়ও ক্ষীন ধারা বর্তমান। আর তার বুকে আজকে শহর, নগর, গ্রামের বাহুল্য। চরতিল্লী, চরগড়পাড়া, চর গোলড়া, চরমত্ত, বারাহির চর, ফারিরচর সহ পূর্ব মানিকগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গড়ে উঠেছে ধলেশ্বরীর বুকে। সেই সাথে সভ্যতার ধারা বদল।
মানিকগঞ্জের ইতিহাস বা ধলেশ্বরীর ইতিহাস ঘাঁটা আমার এই উপস্থাপনার উদ্দেশ্য নয়। তবে মানিকগঞ্জের মাটির একজন সন্তান হিসেবে সব কিছুই সদা সর্বদা চেতনায় জাগ্রত। স্মৃতি আর আবেগের মাখামাখি। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সাথে ধলেশ্বরী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। আর মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশের আগে আমার জ্ঞাত পূর্ব পুরুষদের দ্বিতীয় ভিটে ছিল ধলেশ্বরীর তীর ঘেঁষে। তাই মৃত ধলেশ্বরী ও আমার পূর্বপুরুষদের মত স্মৃতি বিজড়িত ও স্মরণীয়। আগামী সংখ্যায় সেখান থেকেই শুরু করতে চাই।
কড়চা/ এম এস এস