ফিরে দেখা অতীত, জীবন- সাত
মধুসূদন সাহা
পূর্ব দাশড়া থেকে শহরে যেতে কাটাখালীর উপর একটা ছোট্ট ব্রীজ আছে। মূল খাল থেকে এই ধারাটা পটলের চকে গিয়ে মিশেছিল। সে সংযোগ এখন আর নেই। এই জায়গা পার নামও কাটাখালী। এই সরু ধারার খালটা কাটা হয়েছিল কিনা জানিনা। আর একটা অনুমান বর্ষা কালে এই খালে প্রচুর কাটাল (স্রোত) পড়তো। তার জন্যও এরূপ নামকরণ হতে পারে। এখন যে ছোট কংক্রিটের ব্রীজ আছে যখন মাটির রাস্তা ছিল তখন এখানে বাঁশের ব্রীজ থাকতো বর্ষার সময়। আর উন্যার সময় (গরমকালে) ঢাল বেয়ে নামতে উঠতে হত। ব্রীজ পার হয়ে দাশড়া ও বাজারের সংযোগ ব্রীজ তখন ছিল না। এমনকি প্রথম দিকে বাঁশের ব্রীজও ছিল না। ছিল মতি পাটনির ইজারা নেওয়া গুদারা (খেয়া)। তাকে দেখার অস্পষ্ট স্মৃতি মনে আছে। তার মেয়ে জামাই পারাপার করত। নাম মনে নেই, তবে সবাই জামাই জামাই করত। আমার যতদূর মনে পড়ে তিন পয়সা ভাড়া ছিল। অনেকের আবার বাৎসরিক জমা থাকত। আমাদের ছিল না। আমরা গোডাউনের গা ঘেঁষে পায়ে চলার পথে যাতায়াত করতাম। পয়সা থাকলেই খেয়া পার হতাম। এটা ছিল বাজার থেকে আমাদের বাড়ির সোজা পথ। গোডাউনের পাশ দিয়ে ছিল ঘুরপথ। পরে মতি পানির নাতি বেনু পাটনি ও চন্ডী পাটনি খেয়া পারাপার করত। বেনু অনেকটা বন্ধু স্থানীয়। এখনো ভাল সম্পর্ক আছে।
কাটাখালের ছোট ব্রীজের অপর পারে পালেদের বিশাল এক পতিত জায়গা ছিল। ভীষণ জঙ্গলাকীর্ণ। অনুমান প্রায় এক একরের উপর। খাল সংলগ্ন অল্পজায়গায় আশ্রিত হিসেবে একটা প্রান্তিক পরিবারের বসবাস ছিল। পাটি বানানো তাদের পেশা ছিল। অষ্টীদের বাড়ি বলে জানতাম। জায়গাটা ছিল বর্গাকৃতির। দক্ষিণে রাস্তা থেকে উত্তরে জামান মঞ্জিল। পূবে বুদ্ধ ঘোষের বাড়ি থেকে খাল পর্যন্ত। প্রচুর গাছ গাছালি ও বাঁশঝাড়ে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। উত্তরে ছিল প্রচুর শেয়ালের বাসা। সন্ধ্যা হলেই তাদের আনন্দের ডাক শুরু হত। শেয়ালের বাসা ছিল সুরুয খানের বাড়ির উল্টোদিকে খালের ওপারেই। এছাড়া ছোট ছোট ফাঁকা জায়গায় আমাদের ব্যাডমিন্টন ও হাডুডু খেলার জায়গা ছিল। একটি মজা পুকুরও ছিল। তাতে বর্ষার জল ঢুকত। কাটাখালির পাড়ে একটা ছোট জায়গায় প্রতি বছর উল্কা স্পোর্টিং ক্লাবের নামে সরস্বতী পূজা করতেন পাড়ার দাদারা। অনেক দিন ছিল। ঐ জায়গাটা এখন আধূনিক বহুতল আবাসন ও মিনি শহর।
কাটাখালি থেকে গোডাউনের রাস্তায় প্রথম বাড়ি বুদ্ধ ঘোষের। বাজারে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান ও বিরাট বাড়ি। ছিল জমিজমা ও নিজস্ব হালখামার। প্রচুর গরুও ছিল। রাস্তার ধারে বা পালেদের জায়গায় বাঁধা থাকত। রাখাল ছিল আলম। এ বাড়িতে ঋষিপাড়ার রজনী পাগলাও থাকত। মানিকগঞ্জে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরে পাকসেনারা আসলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই হিন্দু অধ্যুষিত পাড়া। বেশ কয়েকজন শহীদ হন। তাদের মধ্যে রজনী পাগলা একজন। উনার স্মৃতি এখনো চোখে জ্বল জ্বল করে। এ বাড়িতে বাৎসরিক কার্তিক পূজাও হত। উনার এক ছেলের নামও কার্তিক। এখানে উল্লেখ্য যে, দাশড়ার বেশ কয়েক বাড়িতে কার্তিক পূজা হত। তার মধ্যে বলখেলার মাঠের কাছে ঘোষবাড়ি, বুদ্ধ ঘোষের বাড়ি আর শঙ্কর পালের বাড়ি। তিন বাড়িতেই কিন্তু একজন করে ছেলের নাম কার্তিক।
পালেদের ভিটার পর ছিল বেতিলার হরিপদ সাহার বাড়ি। যেটা ক্রয়সূত্রে মালিক হন জামান সাহেব। তার নামে সাইনবোর্ড টানানো বাড়ি জামান মঞ্জিল। এরা পুরো পরিবার পূর্ব দাশড়া গ্রামের অন্যতম শিক্ষিত ও ভদ্র পরিবার।
এরপর বৈষ্ণব বনিকের বাড়ি। বাজারে কাসা পিতলের ব্যবসা তো ছিলই। বড় ছেলে বৈদ্য বনিক কিছু দিন মানিকগঞ্জে ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। আর ছোটজন মহাদেব দা’ মানিকগঞ্জে ব্যাপক পরিচিত। তখন টেলিভিশন ছিল হাতে গোনা। আমরা মহাদেব দা’র বাড়িতে টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখতাম, মোঃ আলী, জো ফ্রেজিয়ার, ইনোকী সহ আরও কত কি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে।
এর পরের বাড়ি লক্ষন কর্মকারদের। বিশাল গোল চত্বরে বেশ কয়েক ঘর বাস করতেন। কেউ স্বর্ণকার, কেউ ট্রাংক তৈরি ও ঝালাই এর কাজ করতেন। আর লক্ষন কর্মকার ছিলেন মানিকগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরীর লাইব্রেরিয়ান। সবাই মোটামুটি প্রান্তিক মানুষ ছিলেন।
এরপর ছিল মানিকগঞ্জের অন্যতম ব্যবসায়ী পরিবার গদাধর পালের বিশাল বাড়ি। বৃটিশ আমল থেকে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির মানিকগঞ্জের পরিবেশক ছিলেন। কোম্পানির দুর্দিনে উনারা বিটিসিকে সাহায্যও করেছিলেন। সে প্রত্যয়নপত্রও উনাদের ছিল। তবুও কোম্পানির কতিপয় দূর্নীতি পরায়ন অফিসারের যোগ সাজসে জোর করে ব্যবসা উনাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল বেশ অনেক বছর আগে।
দাশড়া গ্রামে ও মানিকগঞ্জে গদাধর পাল ও শংকর পাল পরিচিত ও ধনাঢ্য পরিবার। যার গোড়াপত্তন বৃটিশ আমলে গদাধর পালের বিটিসির সাথে ব্যবসায়ের কারণে। এ ছাড়া পারিবারিক ভাবেও এরা বিশাল সম্পত্তির অধিকারী। তাদের বংশ তালিকা যতদূর জানি, গদাধর পাল আর জলধর পাল দুই ভাই ছিলেন। তার মধ্যে গদাধর পাল নিঃসন্তান ছিলেন। আর জলধর পালের তিন ছেলে ছিল। বুচা পাল, সূর্য পাল আর চন্দ্রা পাল। বুচা পালের একাধিক বিবাহ ও সন্তানের কথা শোনা যায়। পরবর্তীতে তিনি ভারত প্রবাসী হন। তার আরেক ভাই সূর্য পালও ভারত প্রবাসী হন। বাংলাদেশে থেকে যান বুচা পালের দুই ছেলে শংকর পাল ও দুখী পাল। আর তাদের কাকা চন্দ্রা পাল। দুখী পাল আবার স্বাধীনতার আগে ভারত প্রবাসী হন। আর চন্দ্রা পাল স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন শহীদ হন। থাকে শুধু চন্দ্রা পালের ছেলে কিয়দংশের উত্তরাধিকার। বাকী বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার ছিলেন শংকর পাল। শংকর পাল স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সম্পত্তি রক্ষা, বিশেষ করে বিটিসির এজেন্সি রক্ষা করার জন্য সপরিবারে ধর্মান্তরিত হয়ে সমস্ত উপাচার মেনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতার পর আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে এসেছিলেন। মানিকগঞ্জ বাজার লুঙ্গীপট্টি এলাকায় অধিকাংশ ঘর ছিল গদাধর পাল এস্টেটের। আর দাশড়া খাদ্যগুদাম সংলগ্ন খালপাড় ঘেঁষে বিশাল বাড়ি। আর বিপুল ফসলী জমির স্থাবর সম্পত্তি।
ব্যক্তি জীবনে শংকর পাল ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ। ক্রীড়ামোদী, বাজার হরি সভার এককালীন সভাপতি, ক্লাব সংগঠক, সমাজ সেবক ও নিরহঙ্কার মানুষ। উনার সাথে দাশড়া মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলেছি। আমার মনে হয় যে সাধের এজেন্সির জন্য শংকর পাল ধর্মান্তরিত পর্যন্ত হয়েছিলেন তার হারানোর শোকেই তিনি অকাল মৃত্যু বরন করেছেন। শ্রদ্ধা জানাই তার স্মৃতির প্রতি।
শংকর পালের পর গোডাউন সংলগ্ন মেঘলাল সাহার বাড়ি। উনারা দুই ভাই ছিলেন। গোডাউন সংলগ্ন খালপাড় থেকে জীবন ডাক্তারের বাড়ি পর্যন্ত উনাদের বিস্তৃত বাড়ি ছিল। মেঘলাল সাহাদের জায়গায় খালপাড় থেকে সরকারি রিকুইজিশনে চারটি বড় খাদ্যগুদাম হয়। পরে একটিকে অফিস ঘর করা হয়েছে। মেঘলাল সাহার অন্য ভাইয়ের জায়গা শত্রু সম্পত্তির আওতায় বেদখল হয়েছে। এরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের বংশধর ও জ্ঞাতি।
এরপর পূর্ব দিকে ছিল জ্ঞানেন্দ্র, যোগেন্দ্র ও জীবন সাহাদের বাড়ি। আর একই সাথে ছিল জিতেন সাহা ও সন্তোষ সাহাদের বাড়ি। জ্ঞানেন্দ্র সাহার বিশাল রেশনশিপ ছিল। উনি পরে বাজারে বাড়ি করে চলে যান। যোগেন ডাক্তারের পুরো পরিবার ভারতে। উনি ডিগ্রীধারী ডাক্তার ছিলেন। উনার ছেলেরা কিরনদা, বাবুলদা ভাল ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। খেলোয়াড় ছিলেন ছয় ফুটের সুদর্শন জীবন সাহাও। উনি প্রথম জীবনে বড় ভাই যোগেন ডাক্তারের সাথে থাকতেন। পরে তিনি নিজের ফার্মেসীতে ডাক্তারিও করতেন। উনার ছোটো ছেলে সুদেব সাহা সাবেক ছাত্রনেতা, আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। জীতেন সাহাও ভারতে প্রবাসী। উনাদের বাড়ির দুই দিকেই জলাশয় ও জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। গোডাউনের রাস্তার নীচের নালা দিয়ে বর্ষা কালে নুতন জল আসত। এখন সেখানে বহুতল আবাসন।
এটা রাস্তার একদিক। অন্যদিকে বুদ্ধ ঘোষের পরের বাড়ি সম্প্রতি প্রয়াত মহা ঘোষের। প্রসিদ্ধ মিষ্টির কারিগর। বাড়িটা ঐতিহাসিক। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম প্রহরে এ বাড়িতে পাকসেনাদের গুলিতে দুই জন শহীদ হন। মহা ঘোষের মা ও স্ত্রী। স্বাধীনতার পরেও অনেক দিন ঐ বাড়ি সংলগ্ন গাছে ও টিনের বেড়াতে গুলির দাগের স্মৃতি আমার মত আরও অনেকের মনে আছে। উনার দুই পক্ষের ছেলেরা এখনো বাজারে মিষ্টির ব্যবসা বজায় রেখেছে।
এরপর হরিপদ সাহার বাড়ি। রাস্তা সংলগ্ন তাদের জায়গায় বাড়ি করেছেন প্রয়াত নীলরতন স্যার ও তার ভাইয়েরা। পিছন দিকে ছিলেন সপরিবারে হরিপদ সাহা। উনাকেও রাতের অন্ধকারে পাকসেনারা ধরে নিয়ে হাতটা বেঁধে কালীগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন। উনি বাজারে তৈরি রুটি বিক্রি করতেন।
ঐ পাশে মান্য পাল। তাকেও পাক সেনারা হাতপা বেঁধে কালীগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছিল। তিনিও ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন। বর্তমান শহীদ রফিক সড়কে তার মিষ্টি ও মাটির হাড়ি পাতিলের দোকান ছিল। বাড়িতেও হাড়ি পাতিলের ঘর ছিল। সরস্বতী পূজার সময় চেষ্টায় থাকতাম রাতের অন্ধকারে নিজেদের মনে করে প্রয়োজনীয় পাত্র তুলে আনতে।
এরপূর্বে ছিল কুন্ডু বাড়ি। পরে ডাক্তার বাড়ি। সাড়ে তিন হাজার টাকায় কিনে নেন ডাঃ উপেন্দ্র নাথ দাস। আমরা ও লোকে চিনত ভুন্দা ডাক্তার বলে। মোটেও তিনি ভুন্দা ছিলেন না। কি ডিগ্রী ছিল জানা নেই। তবে সাধারণ রোগ নিরাময়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
সাদা পোশাকে থাকতেন। চেম্বার ছিল আগের শিখা মেডিক্যাল এর উল্টো দিকে। কোন ঔষধ কোম্পানীর ঔষধ তিনি দিতেন না। চেম্বারের পিছনে একটা ল্যাবের মত ছিল। সেখানে বড় বোতলে নানা রঙের তরল সাজানো থাকত। বেশ কয়েকটা মিশিয়ে শিশিতে ঔষধ দেওয়া হতো। তারপর বোতলের গায়ে কাগজের পরিমাপ কাচি দিয়ে কেটে জিকার আঠা দিয়ে লেবেল সাঁটিয়ে দেওয়া হতো। বিদঘুটে স্বাদের ঔষধ। তবে উপকার পাওয়া যেত। সাথে নিতে হত মাপমত শিশি। উনার ছেলে বাবুল দা-ও ডিগ্রীছাড়া ডাক্তারী করেছেন অনেক দিন। ঐ একই দোকানে। বর্তমানে ভারত প্রবাসী।
এর উত্তরে বাড়ি ছিল পলাশ দত্তের। শহরে বন্ধু আর্ট প্রেস নামে উনার একটা ছাপাখানা ছিল।
পূর্ব দিকে ছিল মতি পাটনীর বাড়ি। কেদারী সাহার বাড়ি। নরত্তোম বৈরাগীর আশ্রম। নরত্তোম বৈরাগীকে আমার খুব ভাল লাগত। শ্রদ্ধা হত। বসন ভূষনে বিলাসিতাহীন মৃদুভাষী একজন আসল বৈরাগী মনে হতো। আমাদের বাড়িতেও আসত। (চলবে)
কড়চা/ এম এস