বিশ্বাস ভাইও অবিশ্বাস করল, একজন আত্ন তুল্যের স্মৃতিচারণ
মধুসূদন সাহা
স্কুল জীবনের এক বছরের অগ্রজ। সিনিয়র হিসেবে সমীহের চোখে সামান্য মেলামেশা। সেটাই একসময় বাঁধ ভাঙ্গা সম্পর্কের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কে জানত? আমি গঙ্গা পাড়ে বাস করি। গঙ্গায় প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় দুই বার জোয়ার ও দুইবার ভাটা হয়। বিধাতার সৃষ্টির এক অমোঘ নিয়ম। জোয়ার ভাটার এই আগমন গমনের যাত্রাপথ ঘড়ির কাঁটায় নির্দিষ্ট। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে স্মৃতি চারণ তার সাথে আমার বা আমাদের সম্পর্কের জোয়ার সময়ের আগেই ভাটা পড়ে গেল। এটা সৃষ্টিকর্তার নিয়মের অনিয়ম না স্বাভাবিক ঘটনা তা আমার বোধ গম্যের বাইরে।
অকাল প্রয়াণে রফিক উল্লাহ বিশ্বাস। শিরোনামে আছে আত্নতূল্য। তার সামান্য কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আর আমিও বা কি তুলে ধরবো। তিনি নিজেই ছিলেন সরোবরে প্রস্ফূটিত পদ্ম। পদ্মবনে প্রস্ফুটিত অবস্থায় নির্দিষ্ট করে চেনা দায়। কিন্তু সাজানো বাগানের একটি কমলের হারানো বেদনা সমস্ত পদ্মবনকে শিশিরের অশ্রুতে সিক্ত করে তোলে। আমরা পদ্ম না হলেও রফিক উল্লাহর অকাল প্রয়াণ মেনে নিতে পারি না। জানি, আপনার আমারও সময়ের ব্যপার। কিন্তু অকাল প্রয়াণ হলে সষ্টি কর্তার দরবারে আজাহারি করতেই হয়। মানুষ মরে গেলে স্মরণে আসেন, ঠিক। কিন্তু বেশি আসে তিনি যদি সময়ের আগেই চলে যান। তাই রফিক উল্লাহর আবেগ মাখা স্মৃতি চারণ।
মানিকগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাস। সুতরাং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিচিত। একজন মানুষ মরে গেলেই মহান হয়ে যান না। কিন্তু রফিক সম্পর্কে শুরু করলে জানা কথা গুলোর পুনরাবৃত্তি হবে যে, ও ছিল নির্বিবাদী, রাজনৈতিক দলাদলি শূন্য, বন্ধু বৎসল, পরোপকারী এক ব্যক্তিত্ব। অনৈতিকতা, লোভ, লালসা ওকে গ্রাস করতে পারেনি। কলেজ জীবন থেকেই মূলত ব্যবসায় জড়িত। মনে হয় ১৯৭৭/৭৮ থেকে মৃত্যু কালীন সময় পর্যন্ত উনার প্রেসের ব্যবসা। প্রেসের ব্যবসা না বলে বলা ভাল সৃষ্টিকলার ব্যবসা। ধরুন আপনি কবিতা লেখেছেন। ভাল লিখেছেন। কিন্তু কিছুই যায় আসে না। দু’পয়সার মূল্য নেই যদিনা ওটা প্রকাশিত হয়। আর এই মহান কাজটাই এরা করে দেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এদের বানান ও ব্যাকারণগত জ্ঞান অনেকের থেকে বেশি। আপনি কবিতা লিখে কবি হতে পারেন সত্য, কিন্তু আপনাকে সঠিক ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন প্রেসম্যানরাই।
প্রেসের সাথে আমার পরিচয় ছোট বেলা থেকেই। না, পেশা বা সৃষ্টি করার জন্য না। অনেকটা হাস্যকর পর্যায়ে। বড়শির সুতোয় টুন অর্ধ নিমজ্জিত করতে পরিমাণ মত সীসা ব্যবহার করতে হত। প্রেসের অক্ষর সমূহ সীসার তৈরি। প্রতিটা প্রেসের পিছনের দরজার নীচে একটা বাঁধানো প্লাটফর্ম থাকত। সেখানে একটা মেটার ছাপার পর জল, ব্রাশ ও সাবান দিয়ে ঘষে রঙ তোলা হত। মাঝে মাঝে ব্রাশের ঘষায় দুই চারটি সীসার অক্ষর মেটার থেকে খুলে পড়ে যেত। আর সেটাই আমরা প্রেসের পিছনের দরজায় দরজায় ঘুরে সংগ্রহ করতাম। এই হলো প্রেসের সাথে যোগাযোগ। আমার আর একটা তীব্র নেশা ছিল, বিভিন্ন প্রেস ঘুরে ঘুরে, বিভিন্ন সময়ে হওয়া, বিভিন্ন নির্বাচনে প্রার্থী দের প্রতীক সহ পোস্টার সংগ্রহ করা। এ ব্যপারে সহজলভ্যতা ছিল বাবার বন্ধু, মডার্ন আর্ট প্রেসের পরেশ কাকার কাছে, আর জনতা প্রেসের পলাশ দও কাকার কাছে। যাই হোক, সে সময় মানিকগঞ্জে রফিকের প্রগতি প্রেস তখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি।
যতদূর মনে পড়ে বর্তমান মানিকগঞ্জ পৌরসভার বিপরীতে ছিল সর্ব প্রাচীন মানিকগঞ্জ প্রেস। ছিল শরৎ প্রেস, মডার্ন আর্ট প্রেস, পাশে প্রেস হাউস। পরে বন্ধু আর্ট প্রেস, উদয়ন প্রেস, রূপা আর্ট প্রেস ও রফিকদের প্রগতি প্রেস। এছাড়া আরও দু’একটি থাকলেও থাকতে পারে। মনে আসছে না। প্রথমে যৌথ মালিকানায় থাকলেও প্রগতি প্রেসের দীর্ঘ দিনের স্বত্বাধিকারী রফিক নিজেই। প্রয়োজনীয় আধুনিকিকরনও করেছে। এর ভবিষ্যৎ স্বজনরা ঠিক করবেন। আমি সামান্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই সময়কালে রফিকের জীবন ও তার সাথে আমাদের সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততা বিষয়ে।
আর দশটা ব্যবসার মত প্রেসের ব্যবসা নয়। এর সাথে জ্ঞান চর্চার বিষয়ও যুক্ত। এদের কাজে ভাষার শুদ্ধরূপ উপস্থাপনা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে বিষয়ে রফিকের যথেষ্ট পারদর্শিতা ছিল। আমাদের প্রকাশনার কাজে হাতে খড়ি রফিকের এই প্রেস থেকে। আমাদের আর্থিক সংকটের মধ্যে ও নানান কৌশল ও নিপুনতায় ম্যাগাজিন ও অন্যান্য প্রকাশনা রফিক নিজের প্রেস থেকে বের করে দিয়েছে। টাকা পয়সা কোনদিন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এজন্যে উনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তখন জাসদ ছাত্রলীগ করতাম। এর বিভিন্ন শাখার নানান প্রকাশনা প্রায় অর্ধ যুগ আমি এই প্রেস থেকে করেছি। বলাই বাহুল্য, উপযুক্ত আর্থিক লেনদেন কিন্তু কখনও ছিল না। সবসময়ই ভালবাসায় মাথা পেতে নিয়েছে। কাজ করাতে কখনও অস্বীকার করেনি। আজকে যে কাগজে রফিকের জীবনস্মৃতি বেরুচ্ছে তিন যুগের সৃষ্টিশীল কড়চা পত্রিকার প্রথম প্রকাশনা এখানে থেকেই। এখনও কড়চার প্রিন্টার্স লাইনে প্রগতি প্রিন্টিং প্রেসই আছে। তার আগে সুরুয খানের নেতৃত্বে ওখান থেকে আমরা আন্তর্জাতিক পত্র মিতালী পত্রিকা মৈত্রী ইন্টারন্যাশনাল অনেক দিন ওখান থেকে বের করেছি। বের হয়েছে আমার সম্পাদনায় বিটপ সাহিত্য পত্রিকা। দীর্ঘ বিরতির পর যা আজও চলমান। বের হয়েছে বিশিষ্ট সাহিত্যিক, অধ্যাপক মানিকগঞ্জের হিতৈষী সৈকত আসগরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সীমাবদ্ধ যন্তনার জীরাত’। দামঃ দশটাকা। এছাড়া অসংখ্য বই, পত্রিকা ,সাময়িকী, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনার প্রকাশক রফিক উল্লাহ। সেজন্য আমি আগেই বলেছি প্রেসের ব্যবসা এক ধরনের সৃজনশীলতা। এখানে অর্থের প্রাচুর্য নেই। সৃষ্টির অহংকার আছে। যা রফিক সাহেবের ছিল।
এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু কিছুই বলা হতো না। রফিকের দোকান সংলগ্ন চত্বরটা একসময় আমাদের কাছে ছিল বাড়ির চেয়েও বেশি কিছু। এখানে দলমত নির্বিশেষে একটা প্রতিষ্ঠিত আড্ডাচক্র ছিল। আজকের অনেক গন্যমান্যরা ওখানে নিয়মিত এসে ধন্য হতেন। এর সুতিকাগার ছিল ধর্ম রাজ সেন প্রতিষ্ঠিত ‘বিবেকানন্দ জাগরনী সংঘ’। নামে ধর্মীয় হলেও ওখানে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত না। কয়েক বছর সরস্বতি পূজা ছাড়া ওখানে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত না। ওটা খালি জায়গা ছিল। রফিক সহ আমরা ওখানে দোতলা ফাউন্ডেশন সহ বর্তমান কাঠামো গড়েতুলি। তবে আমার বিশ্বাস, এই সংগঠনের মত স্বেচ্ছাসেবী ও ত্রাণ কার্যক্রম মানিকগঞ্জের কোন ক্লাব এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি। আর এই সংগঠনের দীর্ঘদিন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন জনাব রফিকুল্লাহ। আমিও একসময় এই ক্লাবের সভাপতি ছিলাম। ততদিনে ত্রাণের জৌলুস অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। আমি হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারিনি। ঐ ব্যর্থতার দায় আমার।
একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে নিয়মিত ত্রাণ কাজ চালিয়ে গেছে এই সংগঠন। তার নেতৃত্বে ছিল রফিক উল্লাহ বিশ্বাসরা। জামসা ও সাটুরিয়ার টর্নেডোতে, বন্যায়, নবগ্রামের ঝড়ে ও মানিকগঞ্জ শহরাঞ্চলে আপদ কালীন সময়ে ত্রাণতৎপরতায় এই বিবেকানন্দ ক্লাবই সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নেতৃত্বে এই রফিকরাই ছিল। বিপুল ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে নেতৃত্বের কোন্দল ও দুর্নীতির অভিযোগ কখনও শোনা যায়নি। পরবর্তীতে এই সংগঠনের কার্যালয়ে আমাদের দিনরাত্রির দৃষ্টিকটু আড্ডায় ক্লাবের সেবা কার্যক্রম সংকুচিত হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। রফিকও নিজেকে এর নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু মাত্র আড্ডার কাজেই এটা ব্যবহৃত হত না। এখান থেকে অনেক সামাজিক সমস্যারও সমাধান হয়েছে। অনেক দু:স্থরাও উপকার পেয়েছে। আর ক্লাব সংগঠনের কার্যালয়তে ধর্ম কর্মের জায়গা না এই উপলব্ধিটাও সবার থাকা উচিত।
আলোচনা করছি রফিকুল্লাহকে নিয়ে। দেখুন মরে গেছেন বলে বলছি না, এই বিশ্বাস নৈতিকতায় অগ্রণি ছিল। বদমেজাজি ছিল না, কোন বাজে নেশার সাথেও জড়িত ছিল না। দীর্ঘ দিনের এই মেলামেশায় ওকে আমি উচ্চ স্বরে কারুর সাথে ঝগড়া করতে দেখিনি। কোন দলীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমেও কখনো দেখা যায়নি। তবে আলাপচারিতায় প্রগতিশীলতার পক্ষে ছিল। আড্ডা আমাদের সাথে ওর যথেষ্ট হয়েছে। তবে কখনও সীমা ছাড়িয়ে নয়। একসময় তো আমাদের বিবেকানন্দের আড্ডা ছিল প্রায় দিন রাতের। ক্লাব সংলগ্ন ওর দোকান। সেটাও আওতা থেকে বাদ যায়নি। কখনোই ওর দোকানের ছোট খাট আড্ডায় ও বাদ সাধেনি। বরং অংশগ্রহণ করেছে। ব্যক্তি জীবনে তিনি স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে সুখের সংসারের কান্ডারী ছিলেন। তারা অসীম শূন্যতায় ভুগবেন নিঃসন্দেহে। তারপর একসময় স্মৃতির পাতাগুলো ঝাপসা হতে হতে মলিন হয়ে যাবে। আমার সাথে নিকট অতীতে দু’একবার দেখা হওয়া ছাড়া কুড়ি বছরের দূরত্ব। আরও অনেক সুখ ও সাফল্যর কথা উপস্থাপন করতে পারলাম না। তবে আবেগ তাড়িত না হয়ে যৌক্তিক আলোচনার চেষ্টা করেছি। বিবেকানন্দ ক্লাবকে ঘিরে যে পরিমন্ডল ছিল তার অনেকেই পরপারে। সবচেয়ে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা হচ্ছে মনির মৃত্যু। আড্ডায় যারা মনির কথার হাস্যরসে বুঁদ হয়ে থাকতেন তারাই মনির মৃত্যুকালীন অসহায় কান্না শুনতে পাননি। তাদের অনেকেই সীমাহীন অর্থ ও ক্ষমতার অলিন্দে অবস্থান করেন। এর জবাব তাদের বিবেকের কাছে দিতেই হবে। মানিকগঞ্জের সাম্প্রতিক মৃত্যু মিছিল মনোজগতকে তোলপাড় করে তোলে। চিন্তার জগতে একটা সাম্যতা বাসা বাঁধে। বাংলাদেশে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, বর্তমানে সমাজসেবক, কবি, অভিনেতা শ্যামল জাকারিয়ার একটা উক্তি-জীবন, এযেন বৃক্ষ শাখা। পাখি আসে, বাসা বাঁধে চলে যায়।
বেশ কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল রফিকের সাথে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো সুধীরের সাথে কথা বল। বললাম। ক্রমে দু’জনেরই মৃত্য সংবাদ শুনলাম।
ক্রমশঃ বন্ধু শুন্য হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। শূন্যতায় ক্রমশঃ নিঃসঙ্গ হচ্ছি। এই মৃত্যু উপত্যকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য মানুষের কি সাধনা? একি জীবন সংগ্রাম না মূঢ়তা।
পরিশেষে, আমাদের পূজোর অঞ্জলী দেওয়ার মন্ত্র অনেকটা এরকম, আয়ুংদেহী, যশোদেহি, ভাগ্যং ভগবতী দেহীমে ইত্যাদি। আমার মনে হয় আমাদের সমসাময়িকদের একথা বলার দিন চলে গেছে। এখন বলা উচিত, মৃত্যুং দেহীমে। হঠাৎ এবং দ্রুত। কারণ সহপাঠীদের মধ্যে মনির অকাল মৃত্যু আমি উপলব্ধি করেছি। আর সাম্প্রতিককালে পরিণত বয়সে আমার বাবার মৃত্যু আমি কাছ থেকে দেখেছি। তাই আমার এই অভিমত।
কড়চা/ এম এস এস
Facebook Comments Box