বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে প্রাসঙ্গিক ভাবনা
রুহুল ইসলাম টিপু
১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। মানুষের অধিকার। আমার, আপনার সকলের অধিকার। আমাদের দেশের আপামর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা উপহার দিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর অন্যতম চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বীভৎস ইতিহাস। ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। গৌরব এবং অহংকারের সাথে ১৯৭১ কে স্মরণ করি। একজন উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমাদের মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বিষয়ে দু’একটি কথা বলার আগ্রহ থাকা অস্বাভাবিক নয়।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ অবসানের পর ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর। তিন বছরের মধ্যে বিশ্ব সম্প্রদায় পেয়ে যায় জাতিসংঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
একটু পিছনে ফিরে দেখি, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা প্রণয়ণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪৬ সালে মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান যুক্তরাষ্ট্রের এলিনিয়র রুজভেল্টের নেতৃত্বে একটি কমিটি এ ঘোষণার খসড়া প্রণয়ন করেন। প্রণেতাদের মধ্যে অন্যান্যরা হলেন প্রফেসর পি.সি.চাঙ্গ (চীন), রেনে ক্যাসিন (ফ্রান্স), হারনান সান্তা ক্রুজ (আইনজীবী চিলি), প্রফেসর চার্লস ম্যলিক (লেবানন), ওমর লুফতি (মিশর), রাষ্ট্রদুত মিসেস হৌসা মেহতা (ভারত), জেনারেল কার্লোস পি রোমুলো (ফিলিপাইন), বোগামোলভ (সোভিয়েত ইউনিয়ন) এবং রিকুইকার (যুগোস্লাভিয়া)। এ কমিটিকে সাহায্য করেন তদানীন্তন মানবাধিকার বিভাগের প্রথম পরিচালক কানাডার প্রফেসর জন হামফ্রে। এ ঘোষণার পক্ষে ৪৮ টি দেশ ভোট দান করে এবং কোন দেশই সার্বজনীন ঘোষণার বিপক্ষে ভোট প্রদান করেনি। তবে ৮ টি দেশ (তৎকালীন সোভিয়েত ব্লক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও সৌদি আরব) ভোটদানে বিরত থাকে। ৩০ ধারা সম্বলিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই ঐতিহাসিক দলিলে মানুষের সব মৌলিক অধিকারকে সযত্নে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ দলিলকে জাতসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রথম চেয়াম্যান মিসেস এলিনিয়র রজভেল্ট পৃথিবীর সকল দেশের সকল মানুষের “ম্যাগনা কার্টা” বলে আখ্যায়িত করেন।
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইনের রূপ পরিগ্রহ করে। কারণ মানবাধিকার ঘোষণার ব্যাপক প্রভাবের প্রথম ক্ষেত্রটি হলো আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি প্রণয়ন। যেমন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিল। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ব্যাপক প্রভাব পরিমাপের দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হলো এশিয়া ও আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংবিধান, আইন এবং এমনকি আদালতে যা মানবাধিকার ঘোষণার দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। তদানীন্তন জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের মতে ১৯৬৮ সাল পর্যন্তকমপক্ষে ৪০ টি দেশের সংবিধান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার আলোকে প্রণীত। আমাদের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১১ এ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ মানবাধিকার ঘোষণার ব্যাপারে সম্ভবতঃ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হলো জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত হবার পর পৃথিবীব্যাপী যখনই কোথাও মানবাধিকার লংঘিত হয়েছে তখনই জাতিসংঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্তবারংবার তাই উচ্চারিত, উদ্ধৃত এবং সকল রাষ্ট্রর প্রতিনিধিদের দ্বারা সমর্থিত হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দেশের নাগরিক এবং একজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে আমাকে বেশ আলোড়িত করে। আমাদের রাষ্ট্রের বয়স ৫০ স্পর্শ করছে কয়েকদিনের মধ্যেই। এটি আমাদের বিশাল অর্জন। দারিদ্র্যকেও যাদুঘরে পাঠাবো, নাগরিক হিসেবে এ অঙ্গীকার আমাদের সকলের। দীর্ঘ ৫০ বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিসংখ্যান ও তথ্যচিত্র আমার নিকট নেই। তবে বাংলাদেশের নির্যাতিত এবং সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও পরিবার এবং গোষ্ঠী জানেন এ বেদনা ও কষ্টের গভীরতা; মানবাধিকার হরণের করুণ বাস্তবতা। আমিও যে এ কাতারের একজন নই, তা কিন্তু নয়। আমি এবং আমাদের দেশের মানুষ শিখতে চেষ্টা করি, নিজের এবং অন্যের অধিকার রক্ষায় যত্নবান, সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং সক্রিয় হতে; স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হবে, এটি উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি।
বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে আমি রক্ষা কবচের দিক সামান্য একটু আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই উল্লেখ করেছি সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা পত্র। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মুখবন্ধে লিপিবদ্ধ দুটি অনুচ্ছেদ খুব সর্তকতার সাথে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, মুখবন্ধের অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং শান্তির ভিত্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন মানব পরিবারের সকল সদস্যরা একে অপরের অন্তর্নিহিত মর্যাদা এবং মম্মান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকারগুলির স্বীকৃতি দেয়। ঘোষণার অন্য একটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, যদি আইনের শাসন দ্বারা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা না করা হয়, তাহলে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অধিকার জনগণের থাকবে।
নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আমার রক্ষা কবচ। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) অনুচ্ছেদগুলো মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত। তৃতীয় ভাগের শুরুতে অর্থ্যাৎ ২৬ অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকাররের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয় তবে তা বাতিল হয়ে যাবে। আইনের দৃষ্টিতে সমতা-অনুচ্ছেদ ২৭; অবস্থানগত কারণে বৈষম্য-অনুচ্ছেদ ২৮: ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না; সরকারি চাকুরিতে অধিকার-অনুচ্ছেদ ২৯; আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার-অনুচ্ছেদ ৩১; জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকাররক্ষণ- অনুচ্ছেদ ৩২; গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ-অনুচ্ছেদ ৩৩: বিনা কারণে কাউকে আটক করা যাবে না। কোনো কারণে কাউকে আটক করা হলে, সেটির কারণ জানিয়ে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। কোনো অবস্থায় তাকে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় হাজতে রাখা যাবে না। আটকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে পার্শবর্তী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক ব্যক্তিকে হাজির করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে; জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ-অনুচ্ছেদ ৩৪: ফৌজদারী অপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি না হলে অথবা জনগণের বৃহৎ স্বার্থে আবশ্যক না হলে কাউকে জোর করে কাজ করানো যাবে না; বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ-অনুচ্ছেদ ৩৫; চলাফেরার স্বাধীনতা-অনুচ্ছেদ ৩৬; সমাবেশের স্বাধীনতা-অনুচ্ছেদ ৩৭; সংগঠনের স্বাধীনতা-অনুচ্ছেদ ৩৮; চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা-অনুচ্ছেদ ৩৯: রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রতিটি নাগরিকের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা রয়েছে, সংবাদপত্রগুলোতেও এ স্বাধীনতা দেওয়া আছে; পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা-অনুচ্ছেদ ৪০; ধর্মীয় স্বাধীনতা- ৪১; সম্পত্তির অধিকার-অনুচ্ছেদ ৪২; গৃহ ও যোগাযোগের রক্ষণ-অনুচ্ছেদ ৪৩; মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ- অনুচ্ছেদ ৪৪: যেকোনো কারণে মৌলিক অধিকার ভঙ্গ হতে পারে। এক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ (১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদনের মাধ্যমে অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা-৫ এ বলা হয়েছে, কাউকে নির্যাতন করা যাবে না; কিংবা কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না অথবা কাউকে এহেন শাস্তি দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদ, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্চনাকর দন্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ রক্ষাকবচ হাতিয়ার দিয়ে আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তি, ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠী বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে নিজেদের মূল্যায়িত করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারি।
জাতিসংঘের মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরাস এ বছরের মানবাধিকার দিবসকে আরো বাস্তবতার সাথে বলিষ্ঠ পালনের আহ্বান জানান। তিনি মানবাধিকারের বিশ্ব কনফারেন্স ভিয়েনা ডিক্লেরাশনের ২০ বছর পূর্ণতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা পত্রের এ বছর ৭২ বছর পূর্তি হবে। ভিয়েনা কনফারেন্সে ৮ শত এনজিও প্রতিনিধি, জাতীয় ইন্সটিটিউট, বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গ অংশগ্রহণ করে দূর দৃষ্টি সম্পন্ন দীর্ঘ মেয়াদী স্বপ্ন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সে আলোকেই দি অফিস অব দি হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাসচিব ভিয়েনা কনফারেন্স এর প্রতিজ্ঞাকে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানান। একই সাথে এ সময়ের মানবাধিকারের প্রতীক নেলসন ম্যান্ডেলা’র প্রয়াণে তার প্রতি শোক জ্ঞাপন করেন। যিনি পৃথিবীকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন জীবন ব্যাপ্তি অঙ্গীকারলব্ধ মানবের সম্মান, সমতা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কর্ম। আমরা অনুপ্রাণিত হয়ে এমন এক পৃথিবী তৈরি করবো যেখানে সকলের মানবাধিকার সমুন্নত থাকবে।
এটি আমারও প্রত্যাশা। আসুন সকল বাংলাদেশের নাগরিক জেগে উঠে মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের কর্মে পৃথিবীর নেতৃত্ব গ্রহণ করি।
কড়চা/ আর আই টি