বৃষ্টি(মেঘবালিকা)
তখন আমার আস্তানা জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারের বাংলো। এক সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদর মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ, সাথে ভেসে আসছে মৃদু সুরে সুন্দর নারী কন্ঠ। কিন্তু ঠিক কোন দিকে তা ঠাঁওর করতে পারলাম না। হরি চাচাকে জিজ্ঞেস করলে তার উত্তরে কেন জানি না চমকে উঠলাম। যদিও আমি তেমন ভীতু নই।
যতোই রাত বাড়ছে ততই যেন সেই নারী কন্ঠস্বর কাছে আরও কাছে ভেসে আসছে। আমি আর স্থির থাকতে না পেরে হরি চাচার কাছে একটা টর্চ আর কিছু নিজেকে রক্ষা কবচ নিলাম। হরি চাচার বারন অগ্রাহ্য করেই কোনো জবাব না দিয়েই বেরিয়ে পরলাম সেই কন্ঠের সন্ধানে।
কিছুটা পথ যেতেই ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে, পথ-ঘাট কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু সেই সুর ভেসে আসছে কানে। একটু যেতেই দেখতে পাই সাদা পোষাকে কে যেন হেটে যাচ্ছে। তার পিছু নিলে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তরুলতা কাঁধে পড়তেই চিৎকার করে উঠি। মুহূর্তেই একটা হাসি, মনে হল সে যেন আমায় আড়ালে দেখছে। তবুও থামিনি, হেঁটে চলেছি। অন্ধকার আরও গভীর হচ্ছে। হঠাৎ দেখি আলো নিভে যাচ্ছে আবার জ্বলছে। একটা বিভৎস্য বাতাস বইছে। তারই মাঝে শুনতে পাই নুপুরের ছমছম আওয়াজ। কোনো নারী আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এদিক ওদিক কিংবা পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি কেউ নেই।
বেশ কয়েক বার আওয়াজ আসাতেই একটু থমকে গেলাম। শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে। আর পারছি না চলতে, কিন্তু আমার তো থামলে চলবে না। খুঁজে পেতে হবে সেই রমনীকে যার নুপুরের ছন্দে…
সেকি সাধারণ রমনী, নাকি মায়াবিনী?
জানি ভূত বলে কিছু নেই। কোনো অশরীরী আত্মা থাকতে পারে না। এই অবিশ্বাস-ই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন দেখি আমি একটা অন্ধকার গুহার মধ্যে। সামনে কিছু অপরিচিত মানুষের ছবি টাঙানো। তার উপর ফুলের মালা। মনে হল এগুলোর হত্যা করা হয়েছে। একটু চোখ ফেরাতেই দেখি সাদা কাপড়ে শায়িত কতকগুলি মমির কাফন বাক্স।
আশে পাশে কেউ নেই দেখে উঠে দাঁড়াতেই মুহূর্তের মধ্যে একটা প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। ভয়ংকর একটা প্রতিশোধের আগুনের গোলা ছুঁড়ছে আমার দিকে। আমি ছুটে পালাতে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি সামনে একটা ফুটফুটে সুন্দর রমনী। চোখ জোড়া খুনে লাল। আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুনের দৃষ্টিতে যাচাই করল কিছুক্ষণ। তারপর এগিয়ে আসতে লাগলো। প্রথম কয়েক কদম হেঁটে, তারপর প্রচন্ড গতিতে। শূণ্যে লাফিয়ে উঠেই ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। চমকে উঠে একপাশে সরে গেলাম। মাথার উপর ফুট খানেক দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল দুটো নিষ্ঠুর পা। পারে নি ছুঁতে, কন্ঠে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। কিছুটা আহত। কর্কস ক্ষুধার্ত কন্ঠে বলে উঠল,
—কেন এসেছিস এখানে? তুই তো আমার শত্রু না!
বলেই আবার উড়ে এসে লাথির পর লাথি হালকা নখের আঁচড়ে নিল। সরে যেতে পারছি না কিছুতেই। ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসছে। ঝাপসা দেখছি, অন্ধকার হয়ে আসছে পৃথিবী। অতি কষ্টে একটু ঢোক গিলে কিছু শব্দ বেরিয়ে-
— তুমি কে? এভাবে কেন নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার করছ? উত্তর আসে।
— আমার সাথে যারা অন্যায় করেছে। অকথ্য অত্যাচার করেছে তাদের বদলা নিতে চাই। বদলা শুনতে পাচ্ছিস।
বলে আবার একটা লাথি মারে। আধো আধো ভাবে তার সেই যন্ত্রণার চিৎকার আমার কানে ধ্বনিত হল। বুঝলাম।
তারপর গড়াতে গড়াতে একটা পাথরের সাথে ধাক্কা লাগার আগেই একটা কোমল ফর্সা হাত এসে আটকে দিল। রমনী থমকে গেল মেয়ের কান্ড দেখে।
মেয়েটি আলতো করে তুলে নিল তার কোলে, মাথা তুলে দাঁড়াতে জ্ঞান শূন্য হয়ে যাবার উপক্রম। চেহারাটা ভালো করে দেখার পর ব্যথা বেদনা সব ভুলে নিশ্চিতে যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
অল্প পরেই জ্ঞান ফিরে পেলাম। চোখ মেলতেই দেখি মায়ের চেয়ে মেয়ে আরও সুন্দর। আরেক দফা চমকে উঠলাম। মেয়ের চোখ জোড়া চেহারার চেয়েও সুন্দর। মণি দুটো যেন স্বচ্ছ – টলমল জলের মধ্যে ঘন নীল দুটো দ্বীপ। এক দৃষ্টিতেই চেয়ে আছে আমার দিকেই।
কি বলব ভেবে না পেয়ে মাথা নত করার চেষ্টা করেই উঠে বসলাম।
মেয়েটি বলে ওঠে — আশা করি খুব একটা লাগেনি তোমার? চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
— জানি না, মেয়েটির কন্ঠে সন্দেহ। ব্যথা লাগছে না কোথাও।
—এখানে কেন এসেছ? কি তোমার পরিচয়?
কিছুটা আশ্চর্য হয়ে বললাম — তুমি এখানে কেন? কেন এই প্রতিহিংসা?
রমনীর আবার আবির্ভাব, দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল — তুই বেঁচে আছিস এটাই যথেষ্ট, আর বেশি কিছু কৌতুহল দেখালে ফল ভালো হবে না। এই কথাটাই কোথায় যেন আমার জোর তৈরি হল। জেদ ধরে বসলাম।
— ঠিক কি কারণে এই অত্যাচার? রাত বিরেতে ভয় দেখানো তার সঠিক সত্যতা যাচাই না করে যাব না; যায় যদি যাক তবে প্রাণ।
—এই যে ভাল মানুষের বাচ্চা চলে যা, আজ বেঁচে গেছিস বলে ভাবিস না আঘাত হানব না। আমাকে বিরক্ত করবি না।
— আমি তো উত্তর এখনো পাই নি?
—আমার রাগাবি না! আমি পিশাচিনী, প্রেতত্মা! ভয় লাগে না তোর?
—না! আমি বিশ্বাস করি না, তুমি ভদ্র ঘরের ভদ্র বউ।
একটু বিদ্রুপ হাসি হেসে হা! হা ভদ্র বউ?
— আঃ! বড্ড বেশী বলিস।
ছিলাম একসময়, কিন্তু ওরা আমাকে বাঁচতে দিল না। পুড়িয়ে মারল অকথ্য অত্যাচার করে। এমনকি আ-আমার নিষ্পাপ ফুলের মত শিশুকেও ছাড়েনি। আমার শরীরে এখনও আগুনের সেই জ্বালা হয়। আমি তাদের শাস্তি যত দিন না দিচ্ছি ততদিন আমার মুক্তি নেই।
—কিন্তু তোমার এই আচরণে কত নিরীহ মানুষের ক্ষতি হচ্ছে সে কথা একবারও ভেবেছ? বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
— আমাকে ওরা ঘরে ঢুকতে দেয় না, বাধ্য হয়ে নিশির ডাক দেই।
পরিস্থিতি সামলাতে কোনো উত্তর না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনলাম।
কষ্টময় চোখ জোড়া নিঃশব্দে ভাষায় কি যেন আরও বলতে চাইছে অথচ পারছে না।
—তুই চলে যা! জীবনটা খুব দামী। হারানোর ব্যথা তুই বুঝবি না।
আমার চোখের কোণে কেন জানি না টলটলে ছলকে উঠল জল, আর বারো বছরের ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। আজ আবার নতুন করে সব হারানোর কষ্ট কাঁদিয়ে দিল।
একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা, দুপুরে বাড়ির বউদের চুলের বিনুনি বাঁধা, গল্প স্বল্প আর হাসি আড্ডা যেমন ছিল, তেমনি ছেলেদের দাবা খেলা আর আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। কি জানি কখন কার কালো নজরে পড়ে গেল যা আমাদের সেই একান্নবর্তী পরিবারে ফাটল ধরল। আলাদা হল হাড়ি, সংসার। বাবা চলে গেলেন এই ভাঙনে।এত বড় ধাক্কা নিতে পারেন নি। আমি বড় তাই বাবার পরে আমায় হাল ধরতে হল, বাড়ি আলাদা হলে অভাবের কারণে বাড়ি চলে যায় প্রমোটারের হাতে। চাকরির জন্য এখানে ওখানে খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি তখনই পেলাম একটা চাকরি। চাকরি তো মিলল কিন্তু পোস্টিং হল এই আলো-বাতাসহীন এই জঙ্গল মহলে। রাস্তা ঘাটের কোনো বালাই নেই। রাতে হিংস্র পশুর হামলা। তার উপরে তোমার এই ভূতরে পৈশাচিক গা শিউরে ওঠা তোমার প্রতিশোধের অত্যাচারের আগুনের মুখোমুখি।
একটা দীর্ঘশ্বাস, তারপরেই হঠাৎ আঘাত জ্ঞান হারিয়েছি বোধ হয়। পরদিন সকালে দেখি আমি আমার বিছানায় সারাদেহে ব্যথার যন্ত্রণা। পা নাড়াতে গিয়ে বুঝলাম, আঁকড়ে গেছি যেন কেউ ইচ্ছে মত আঘাত করেছে। আয়নার সামনে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আ-আমি তো ঠিক আছি।
ঈশ্বর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে কিন্তু আর তোমায় ? শোনা গেল বুক-চেরা এক দীর্ঘশ্বাস। আমায় ঠেকিয়েছে ঈশ্বর।
কথাটা ঠিক না ভুল তা যাচাই করতে আয়নার সামনে দাঁড়াতে বলে ছিলাম সেই রমনীকে। ঠিক উত্তর দেবে কিন্তু সেই সৌভাগ্য ধরে রাখার ক্ষমতা দেয় নি বিধাতা।