মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পুনর্মিলনী-২০২১
এসএসসি-১৯৭৭
মধুসূদন সাহা
গতকাল (৪ ডিসেম্বর) ছিল আমাদের প্রাণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ১৯৭৭ মাধ্যমিক শিক্ষা বর্ষের পুনর্মিলনী। অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের মনে হয় দুই সেকশন ছিল। প্রায় শতাধিক ছাত্র। নবম শ্রেণিতেই আমাদের এসএসসি’র পাঠ্যক্রম শুরু হত। তাই তখন থেকেই আমরা যার যার ইচ্ছে অনুযায়ী বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ভাগ হয়ে যাই। সম্পর্কের কম বেশি থাকলেও সুতোর টান কারুর সাথে নড়চড় হয় নি। জীবনের এক দীর্ঘ সময় এই স্কুলের সাথে। শিক্ষা জীবনের ভিত্তি প্রস্তরও এখানে। জীবনের এক বিচিত্র ও শ্রেষ্ঠ সময় এখানে কাটিয়েছি। কত সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনা, সাফল্য ব্যর্থতার কাব্যের বন্ধনে এখানে আবদ্ধ। সময়ও কম না। এ জীবনের শুরুটা প্রায় ৫০ বছর আগে। স্বাভাবিক কারণেই স্মৃতির মনি কোঠায় শ্যাওলা জমা। উপস্থাপনার অবয়ব ও সংক্ষিপ্ত। ভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপনার আশা রেখে আজকের সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি
আমাদের স্কুল মানিকগঞ্জের প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। ঐতিহ্যে বনেদিয়ানার ছাপ স্পষ্ট ছিল। এর অন্যতম কারণ সরকারি তকমা থাকলেও শিক্ষক ও ছাত্র নির্বাচনে স্কুল যত্নবান ছিল। নিয়ম শৃঙ্খলায় ছিল অনন্য। স্কুল জীবনের দুরন্তপনা থাকলেও বখাটে ছাত্রের উপস্থিতি প্রায় ছিল না বললেই চলে।
মানিকগঞ্জ শহরের মধ্যস্থলে বিশাল এলাকা জুড়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর সৌন্দর্য অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে প্রাচীন ফটক দেওয়া ঘাটলা বাঁধানো বিশাল পুকুর। ফটকের দুই পাশে চুন শুড়কির দৃষ্টি নন্দন বসার জায়গা। আমাদের সময়ই পরে পূর্ব দিকে আর একটা স্নানের ঘাট তৈরি করা হয়। তখন ছিল পাকা দালান ও দেয়াল দেওয়া টিনের ঘরের সমাহার। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পৌরসভার রাস্তা। আকারে বড় না হলেও স্কুলের পূর্ব পশ্চিমে ছিল দু’টি খেলার মাঠ। পূব দিকেরটায় তখন ছিল বাস্কেট বল খেলার ব্যবস্থা। গোল পোস্ট সহ। আজকে এত বছর পর মানিকগঞ্জে বাস্কেট বল খেলা হয় কিনা জানি না। কিন্তু তখন আমাদের সিনিয়র ভাইদের নিয়মিত খেলতে দেখেছি। উভয় মাঠেই অদল বদল করে নিয়মিত ভলিবল খেলা হত বিকেলে। অন্যদের জন্য অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলেও মূলত আমরা ছাত্র শিক্ষকরা মিলে খেলতাম। স্কুলের কাছাকাছি বাসা হওয়ায় স্যারদের মধ্যে রুস্তম আলী স্যারের কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। উনার ছেলে যায়ীদ ও শ্যালক মোস্তাক আমরা ভাল বন্ধু ছিলাম। তাছাড়া উনার কাছে প্রাইভেটও পড়েছি। তাই খুব পরিচিত ছিলাম। মোস্তাক বাংলাদেশ ব্যাংকে ও যায়ীদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চ সামরিক কর্মকর্তা ছিল। যায়ীদ অত্যন্ত মেধাবী ও স্কুলে বেশিরভাগ সময়ই ক্লাসে প্রথম হয়েছে। এর বেশি আর জানিনা।
আমাদের স্কুলে আধুনিক ক্রিকেট সেট ছিল। আমারা অনেকবার ওগুলো ব্যবহার করে ক্রিকেট খেলেছি। হাইস্কুলের মাঠে। স্টেডিয়ামের পাশের টা। হকি সেট সহ হকি খেলার ব্যবস্থা ছিল আমাদের সময়। তখন ছিল স্কুলের আভ্যন্তরীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর হত। হাই জাম্প, লং জাম্প, দৌড়, রিলে দৌড়, শর্ট ফুট, ডিসকাস, জেবলিন, পোল জাম্প, সাজ যে যেমন পার, অংক দৌড়, বিস্কুট দৌড়, আরও কত কি। পরিশেষে কাছি টানাটানি তো ছিলই। ছাত্রদের ছোট মাঝারি বড় তিন ভাগে ভাগ করা হতো। অনুরূপ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আন্ত:স্কুলও হত। আন্ত:স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতাও হত। আমাদের সময় এগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক সুরেশ স্যার ও ধীরেন সন্যাসী স্যার সহ অনেকেই। প্রধান শিক্ষক ছাড়াও অনেক সময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাননীয় মহকুমা প্রশাসক উপস্থিত থাকতেন।
এছাড়া আমাদের কমন রুমে টিফিন পিরিয়ডে ক্যারাম, দাবা, বাগাডুলী ও টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা ছিল। আমাদের পুকুর পাড়ে টিন শেড দালানে একটা জিমনেশিয়াম ছিল। প্যারালাল বার, ডাম্বেল, বারবেল, বুকডনের পিড়ি সহ নানা উপকরনে সম্বৃদ্ধ ছিল। নিয়মিত না হলেও যথেষ্ট-ই ওগুলো আমরা ব্যবহার করেছি।
স্কুলের দ্বিতল ভবনে ঢুকতেই বাঁদিকে ছিল সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ। বাঁদিকে শেষ টা ছিল প্রধান শিক্ষকের কক্ষ। আর ঢুকতে ডানদিকে ছিল শিক্ষকদের কমনরুম (বসার জায়গা)। ডান দিকের শেষ রুম ছিল লাইব্রেরী ও ক্রীড়া সরঞ্জামের কক্ষ। সেখান থেকে বই নিয়ে কয়েকদিন রেখে পড়ার ব্যবস্থা ছিল। আর বিল্ডিং-এ বেরুনোর বাম পাশে ছিল অফিস রুম। আর বারান্দায় ঝুলানো থাকত একটা বড় কাঁসার ঘণ্টা। যা ছিল সময় ও কার্যক্রম নির্ধারক। এই ঘন্টার শব্দ এখনও বুকে বাজে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুভূতি হত। আর এই কাজটা নিপুণ ভাবে করতেন আমাদের পোড়রার চাঁন ভাই। লুঙ্গি পড়েই তিনি অফিস করতেন। উনার ছেলেরাও এই স্কুলের ছাত্র ছিল। আমাদের ছোট বড় ক্লাসের সহপাঠি।
আসি বেলের কথায়। ক্লাস শুরুর পনের মিনিট আগে থেকে পাঁচ মিনিট অন্তর পর পর দুটো বেল পরতো। এদুটো ছিল অনেক গুলো একনাগাড়ে ঠুক ঠুক সুরেলা শব্দ। পনের মিনিটের মাথায় ঐ রকম শব্দের পর একটা জোরে শব্দ। স্কুলের ক্লাস শুরুর ইঙ্গিত ও প্রথম পিরিয়ড। এই ভাবে ২য় ও ৩য় পিরিয়ডে যথাক্রমে ২ ও ৩ টি শব্দ। ৪র্থ পিরিয়ডে চারটে বড় শব্দের সাথে ঠুক ঠুক অনেক গুলো শব্দ। মানে টিফিন পিরিয়ড। আবার ঐ রকম ওয়ার্নিং বেলের পাঁচ মিনিট পর ফাইনাল চারটে ঘন্টা। শুরু হল টিফিনের পর পঞ্চম ক্লাস। এভাবে ৫ম, ৬ষ্ঠ, ৭ম পিরিয়ডের ঘন্টার পর শেষ ঘন্টাটা ছিল ঐ ঠুক ঠুক শব্দ। যার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। যেটা ছিল কাঙ্খিত ছুটির ও আনন্দের ঘন্টা ধ্বনি। এই ঘন্টার চানভাই ছাড়া অন্য কেউ বাজালে আমরা ঠিক বুঝতে পারতাম। সবচেয়ে বুকে বাজতো পরীক্ষার বেল গুলো। কোথা দিয়ে সময় চলে যেত বুঝতেই পারতাম। বেল গুলো রাবনের শক্তি শেলের মত বুকে বাজতো।
আমাদের সমস্ত শিক্ষকরাই ছিলেন শ্রদ্ধেয়। কারুর প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ ছিল না। যাদের কথা মনে আছে শংকর স্যার, বুড়ো স্যার (নাম মনে নেই), হাবিবুর স্যার, মফিজ স্যার, সুরেন স্যার, সুরেশ স্যার, ধীরেন স্যার, বরকত উল্লাহ, নাজিমুদ্দিন, রুস্তম আলী, খলিলুর রহমান, জ্যোতীষ, রতিকান্ত, জয়দেব, আইয়ুব আলী, নগেন, আব্দুর রহমান, পরিমল, জিন্নাত আলী, গনি, ইনাদের নামই মনে পড়ছে। সবচেয়ে বেশি বেত ব্যবহার করতেন রুস্তম আলী স্যার। অনেক স্যার বেতের অভাবে ডাস্তার ব্যবহার করতেন। কান ধরে বেঞ্চের উপর দাড় করানো ছিল জলভাত। নাজিমুদ্দিন স্যার ক্লাসের বারান্দায় কাছিম বানিয়ে রাখতেন। ওগুলো আমাদের গা সওয়া ছিল। খুব একটা মনেও নেই। প্রায় দিনই ক্লাস চলাকালীন প্রধান শিক্ষক পুরো স্কুল ঘুরে দেখতেন। আর স্কুলের অফিস স্টাফদের নাম মনে নেই। তবে দপ্তরী চান ভাই, লেবু। আর সাফাই কর্মী যোগেশ। স্কুল খোলা ও বন্ধের কাজ করতেন বৃদ্ধ বাহাদুর ভাই। এছাড়া আরও অনেকেই ছিলেন।
স্কুলের ছাত্রদের পরীক্ষা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়াদি যা ছাত্রদের জানানো প্রয়োজন তার দপ্তরী মারফত নোটিশ খাতা ক্লাসে ক্লাসে পাঠিয়ে শিক্ষক মারফত ছাত্রদের জানিয়ে দেওয়া হতো। সবচেয়ে বুক কাঁপানো সময় ছিল আমাদের পরীক্ষার প্রশ্ন দেওয়ার আগ মুহুর্তে, ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দেখানোর সময়, বার্ষিক পরীক্ষার পর প্রগ্রেস রিপোর্ট দেওয়ার সময়। আর আনন্দের সময় ছিল টিফিন পিরিয়ডে, ক্লাস ছুটির সময়, রেজাল্ট ভাল হলে, স্কুলে ধর্মঘট হলে।
স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে গেটের কাছে খাবারের দোকান অনেক থাকত। তার মধ্যে কাঠি আইসক্রিম, ছোলা, বাদাম, হাতে বানানো চানাচুর, আমড়া, কুল, কামরাঙা, চাটনী-ই প্রধান ছিল। বিক্রেতাদের সাথে ভালই সখ্য ছিল। সবসময় পয়সা না থাকলে ও বাকীতেও খাওয়া যেত। দৈনিক কোন বরাদ্দ ছিল না। কোন কোন দিন তিন পয়সা থেকে সর্বোচ্চ বার পয়সা (দুই আনা) খরচ করেছি। তবে তিন পয়সাই বেশি পেতাম বাড়ি থেকে। তাও মা দিতো। স্কুলের পূর্ব দিকের মাঠের পাশে ছাত্রদের হোস্টেল ছিল। কয়েকজন স্যারও থাকতেন সেখানে। আর হোস্টেল ও মসজিদের মাঝখানে ছোট্ট একটি কিচেন ছিল। আর সর্ব পূর্বে ছিল টয়লেটের ব্যবস্থা। স্কুলে আমরা কোনদিন জলের বোতল নিয়ে যাইনি। স্কুলের টিউবওয়েলে একহাত দিয়ে পাম্প করে ডান হাত চেপে মুখ লাগিয়ে জল খেতাম পুরো স্কুল জীবনে। আমাদের স্কুলে মাসিক তিন টাকার বিনিময়ে টিফিনের ব্যবস্থা ছিল। ক্লাস ক্যাপ্টেন তা টিফিন পিরিয়ডে এনে বিতরণ করত। তার মধ্যে ছিল লুচি হালুয়া, লবঙ্গ, সিঙারা, পরোটা মিষ্টিই অন্যতম। সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। একবার রুস্তম আলী স্যারের পরিচালনায় কেদার মাষ্টার নামক নাটক করা হয় স্কুলের নিজস্ব স্থায়ী স্টেজে। আমি অভিনয়ে ছিলাম। তখন রাতে হোস্টেলে থাকা, স্কুলের পাশে আমজাদিয়ার হোটেলে খাওয়া আমার প্রথম মুক্তির স্বাদ। তাছাড়া সরস্বতী পূজায়ও অনুরূপ ব্যবস্থা ছিল।
এতক্ষণ মাঝপথের গল্প বললাম। এবার শুরু করি। গার্লস স্কুলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ার পর সম্ভবত ১৯৬৮ এর উত্তাল দিনে হাইস্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। বাবা নিয়ে গেলেন সহকারী প্রধান শিক্ষক রবিউল স্যারের চেম্বারে। সেখানে একজন শিক্ষকের অধীনে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর সুযোগ মিললো। সহপাঠি হিসেবে যায়ীদ এর স্মৃতি অম্লান। শিক্ষক ছিলেন বুড়ো স্যার, হাবিবুর স্যার আর একজন। শ্বেতশুভ্র দাড়িওয়ালা অতি সরল সেই স্যারকে আমি আর যায়ীদ কি বিরক্ত যে করেছি তার ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এত সোজা স্যার বেত এনেছিলেন শুধু মাত্র আমাদের দুজনের জন্য। মারতে আসলে ক্লাস থেকে দৌড়। কখনও দুই জনে হামাগুড়ি দিয়ে বেঞ্চের তলায়। স্যারের সাধ্য কি আমাদের মারে। যায়ীদ কিন্তু অনেক দিন আমাদের ক্লাসের ফাস্ট বয় ছিল।
তখন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তাল সময়। অনেকগুলো ঘটনা পর পর ঘটে যাচ্ছে। তার মধ্যে আমাদের সিনিয়র ভাই সাঈদ খান মজলিশ সহ আরও অনেকের নেতৃত্বে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ আলী ও রবিউল স্যারদের বিতাড়নের আন্দোলন।
পূর্ব পাকিস্তানের বিকৃত ইতিহাস গ্রন্থ দেশ ও কৃষ্টি বাতিলের আন্দোলন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলন ও এর ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতার আন্দোলন আমার পুরো শৈশব জুড়ে। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত উপরোক্ত ঘটনা প্রবাহে আমাদের অনেক দিনই ক্লাস হয়নি। স্কুল স্টাইক করে মিছিলে মিছিলে ঘোরাই আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। আর স্কুলের থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিস। সেখানে নিয়মিত হাজিরা খাতায় সই করে গেছি। কোন কোন দিন স্কুল স্টাইক হলে স্কুলে থেকে ছাত্রলীগের অফিসে খবর দেওয়া হতো টিফিন নিয়ে আসার জন্য। এর মধ্যেই আমার পঞ্চম শ্রেণির সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আমরা পালিয়ে বেড়াই। বাড়ি দোকান লুট হয়ে যায় দেশীয় ভাইদের দ্বারা। এ নয় মাস কোন পড়াশোনার বালাই ছিল না আমার। স্বাধীনতার পর যখন স্কুলে আসি তখন বইখাতা কিছু ছিলই না। স্কুলের দোতালায় তখন মুজিব বাহিনীর আস্তানা। ক্লাসের শুরুতে আমাদের বরাবরই প্যারেড হতো। লাইন ধরে ক্লাস অনুযায়ী দাঁড়িয়ে যেতাম। সাইজে ছোট থাকায় সামনের সারিতেই আমার জায়গা ছিল। স্বাধীনতার পর প্রথমদিন আমাদের কুচকাওয়াজে অনেক নুতন কিছু হল। তার মধ্যে আগে প্রতিদিন আমাদের পাকিস্তানের নামে শপথ করতে হতো। পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত সমস্বরে গাইতে হত। সেদিন নুতন বাংলাদেশের নামে শপথ নিলাম। সমস্বরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইলাম। আর স্কুলের উপরের মুজিব বাহিনীর সদস্যদের একজন প্যারেড গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলণের পর এস এল আরের ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়লেন শূন্যে।
তারপর স্কুল থেকে মাঝেমধ্যেই খাদ্য জাতীয় সহযোগিতা ছিল। একবার এককালীন চল্লিশ টাকা নগদ পেয়েছিলাম। দু’ এক বছরের মধ্যেই আবার আন্দোলন, স্কুল স্টাইক, হরতাল, ধর্মঘট শুরু হলো। ছাত্রলীগ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে জাসদের জন্ম হলো। তখনও কিন্তু বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অফিস আগেরটাই। যেটা জাসদের ছাত্র সংগঠন। তো একবার স্কুল স্টাইক হয়ে মিছিল সহকারে মডেল স্কুলে গেল। সেখানে স্টাইক করে মিছিল তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে আসলে রক্ষীবাহিনী অতর্কিতে মিছিলের সামনে গাড়ি থামিয়ে চরম হামলা করে। আমরা ভয়ে খাল পার হয়ে সেওতার ভিতর দিয়ে সিএনবি’র পুকুর পাড়ে চলে যাই। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবার ছাত্রলীগ অফিসে আসি। তখন স্কুলের দপ্তরী আমাদের টিফিন নিয়ে আসার জন্য বলে যায়। যারা ছিলাম বেশি করে খেয়ে আসি। এরপর জাসদ নিষিদ্ধ হয়। সামরিক বাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী জনতার অভ্যূথ্থান হয়। ষড়যন্ত্রে জিয়া তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। তারপর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু হতে হতে ১৯৭৭। ততদিনে আমরা স্কুল পেরিয়ে গেছি। তবে ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত স্কুল জীবনে আর কোন অসহযোগ ছিল না।
আমাদের সময় স্কুলের সামনের গেট, পাশে স্কুলের ক্যান্টিন ও তার পাশে শহীদ মিনার ছিল। ছিল স্কুলের ইউনিফর্ম। সাদা প্যান্ট ও আকাশী শার্ট। বাঁদিকে স্কুলের সুদৃশ্য কাপড়ের ব্যাজ।
১৯৭৭ সনের আমাদের মাধ্যমিক ব্যাচ নানা কারণে বিখ্যাত ছিল। আমাদের বিজ্ঞান বিভাগের রবীন্দ্র কর্মকার ঢাকা বোর্ডে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করেছিল। বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল কৃষি বিজ্ঞানের নাসিরও। বিজ্ঞানে আমরা ১৭ জন প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। আমাদের সিট পড়েছিল দেবেন্দ্র কলেজে পূর্ব দিকের পুকুর পাড়ের টিন সেডে। দীর্ঘ বিরতির পর ফল প্রকাশের সময় দেখতে গেলাম প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। গনিত ও রসায়নে লেটার সহ প্রথম বিভাগ। তবে খুব বেশি নম্বর পেয়ে নয়। অনেকটা কাটায় কাটায়। তারপর প্রসংশাপত্র, মার্কশীট, সার্টিফিকেট এর পর চললাম কলেজে। পিছনে পড়ে রইলো যা বললাম। আর অনেক না বলা স্মৃতিও। পড়ে রইলো আমার শৈশব, কৈশোর আরও কত কি। আজকে আমরা বার্ধক্যের দারপ্রান্তে। জীবন নদী এভাবেই বয়ে চলে, চলছে, চলবে। আর আমরা মিশে যাব সাগরে।
শেষ বেলায় ফিরে দেখার চেষ্টা আমাদের প্রায় ৫০ বছর আগের শিক্ষা জীবন। সহপাঠি, শৈশব, কৈশোর আরও কত কি? গতকাল অনুষ্ঠিত হলো আমাদের এস এস সি ১৯৭৭ ব্যাচের পুনর্মিলনী। মহৎ উদ্যোগ। সমাজ সংসারের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা প্রায় এক তৃতীয়াংশ একত্রিত হয়েছিল। নানা কথকতা আচার অনুষ্ঠানের জোয়ারে ভেসে গিয়েছিল ৫০ বছরের আগের জীবনে। আমার মত অনেকেই পারেনি জীবনের অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে এই আলোর মিছিলে যোগ দিতে। উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানালে ছোট করা হবে। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ এর গানে শেষ করি-