মা এখন কক্সবাজারে
রুহুল ইসলাম টিপু
আমার মা। আমার পৃথিবী। মা মা করেই জগত দেখা। মা এখন কক্সবাজারে। আনন্দিত উচ্ছ্বসিত। ছোট ভাই ইপু’র প্রতি কৃতজ্ঞ। ২১ অক্টোবর ২০২১ ফ্যামিলি ট্যুরে মা’কে সাথে নিয়ে কক্সবাজারে পৌছে। গিয়েছে আকাশ পথে। প্লেনে চড়া মা’য়ের প্রথম অভিজ্ঞতা। দেশের অন্যত্র মা’কে নিয়ে বেড়ানো হলেও কক্সবাজারে নিয়ে যাইনি। এই প্রথম মা বাবা ছাড়া বেড়াতে বের হলেন। বাবা অপারে। তাই বিচিত্র স্মৃতি সুখ দুঃখ মিশ্রিত কত কথাই না আজ মনে পড়ছে। মনের গহীনে এক ইচ্ছে ছিল আমিও মা’র সাথে যাই। সব সম্ভব তো একসাথে আসে না। বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে ওরা। দেখছি আর ভাবছি। মা’য়ের মুখে হাসি নেই। অথচ সমুদ্র তো আনন্দ বিলাসের স্থান। কান্নারও সাথী। সমুদ্রের জলে আজ মিশে আছে মা’য়ের চোখের পানি। জীবনে একাকীত্ব বড় কঠিন সময়। আমরা সাথে আছি। তবুও মা একা। জীবন সাথী ছাড়াই কাটাতে হবে বাকী জীবন।
মা’য়ের বয়স এখন ৭৭। আমি যখন নবম দশম শ্রেণিতে পড়ি। মা’য়ের গলায় একটা ঘা হয়েছিল। কিছুতেই আরোগ্য না হওয়ায় পিজি’তে এসে চিকিৎসা গ্রহণ করা হয়। চিকিৎসক বেশ আতঙ্কিত ছিলেন। মানিকগঞ্জ এসে পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর করবী আহমেদ বিউটি আপা’র মায়ের নিকট বলেছিলেন। আপা আমি মরে গেলে আমার তিন সন্তানকে আপনি দেখবেন। এ পরিবারের সাথে আমরা ছিলাম বেশ ঘনিষ্ট। খালাম্মা’ও ঘন ঘন আসতেন। আমাদের দেখতেন। মা’কে বলতেন, তোমার কিচ্ছু হবে না। সে যাত্রায় সত্যিই মা আরোগ্য লাভ করলেন। এরপর হতে প্রতিবছর মহরম মাসে আমরা শিরনীর আয়োজন করি। আয়োজনের নেপথ্যের কথা তেমন কেউ জানেন না। আমরা বলি পবিত্র মাস। এ মাসের যেকোন একটি দিন মিলাদ মাহফিলের আয়োজন। পাড়া প্রতিবেশি যতটুকু পারি অন্য সকলকে সাথে নিয়ে ক্ষির খিচুড়ি নিজ হাতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি। দীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ এটি করছি।
মা কক্সবাজারে। আমি সাথে থাকলে মা’য়ের সকল অনুভূতি তুলে ধরতাম। কক্সবাজার ভ্রমণকে কেন্দ্র করে আজ মা’য়ের সাথে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। ১৯৯২ সাল। আমি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোর্স সম্পন্ন এর সময় সহপাঠিদের সাথে পিকনিক এ যাই। স্থান কালিয়াকৈর বেতবুনিয়া। ফেরার পথে নবীনগর হতে আর ঢাকায় না ফিরে রওয়ানা হই মানিকগঞ্জের পথে। এসে দেখি মা নেই। কেউ নেই বাড়িতে। মা সদর হাসপাতালে। দ্রুত রিক্সায় পড়ি মরি করে মা’য়ের নিকট আসি। দেখি হাসপাতালের বিছানায় মা। অজস্র রক্তক্ষরণ। নামমাত্র চিকিৎসা চলছে। বাবা অসহায়ের মতো বসে আছেন। মা’য়ের সাথে পাশের বাড়ির এক মেয়ে। আমিও তেমন বুঝি না। কি করবো। মা’কে তো বাঁচাতেই হবে। বাবা বললেন, রাজ্জাক এখন মানিকগঞ্জে। বাবা’র ভাগ্নে। পিডব্লিউডি মানিকগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আব্দুর রাজ্জাক। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। গাড়ী যাতায়াতের ব্যবস্থাও এখনকার মতো এতো সুপ্রশস্ত নয়। রাজ্জাক ভাই কোয়ার্টারে তখনও উঠেন নি। অফিসের উপরে একটি রুম তাঁর জন্য ব্যবস্থা ছিল। বাবা আমি সেখানেই যাই। রাজ্জাক ভাই বললেন তাঁর ড্রাইভার মন্টু গাড়িসহ যাবে। গাড়িতে রাজ্জাক ভাইয়ের ঢাকার বাড়িতে যেতে বললেন। সেখান থেকে চিকিৎসা হবে। বেশ আশস্ত হলাম। দুশ্চিন্তায়ও কাটলো না। আমরা তো কেউ তেমন চাকুরি-বাকুড়ি করি না। শুধু বাবা’র বেতনের উপরই ভরসা। রাতেই একজনকে গ্রামে পাঠানো হলো। প্রয়োজনে জমি বিক্রি করবো। মা’কে বাঁচাতেই হবে। পরদিন ঢাকায় চলে আসি।
উঠি রাজ্জাক ভাইয়ের খিলগাঁও এর বাড়িতে। পরদিন সকালে রাজ্জাক ভাইয়ের গাড়ি আবার হাজির। মা’কে নিয়ে যাই মিডফোর্ড হাসপাতালে। ভর্তি করা হলো। বাবা থাকেন দিনের বেলায়। আমি আসি বিকেল বেলা। রাতে মা’য়ের নিকট একজনকে থাকতে হবে। মহিলা ওয়ার্ড। তিনি হবেন নারী। ওয়ার্ড এর সিস্টার’কে অনুরোধ করি। আমাদের বাড়িতে মা ছাড়া কোন নারী নেই। এক ভাই পড়াশুনা করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে। অন্য এক ভাইয়ের পড়াশুনা ঢাকা কলেজে। একইসাথে একটি প্রাইভেট বায়িং হাউসে চাকুরি করে। সে বাড়ি অফিস সামলাচ্ছে। এ অবস্থায় আমাকে মা’য়ের পাশে একটু থাকার অনুমতি দিন। আমি অন্য কোথাও যাবো না। তিনি অনুমতি দিলেন। বিপত্তি পড়লো বাথরুম ব্যবহার। আমি তো দৌড় ঝাঁপ দিয়ে বাইরে থেকে সেরে আসি। মা’কে বাথরুম নেওয়াও বিপদ। আমি ছেলেমানুষ। ফিমেল ওয়ার্ড এর বাথরুম ব্যবহার করেন সকল নারী।
তবু তো মা। মা আছেন বলেই আমার জগৎ এতো আলোময়। ডাঃ কছিমুদ্দিন এ সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। বাবা’কে বললাম। একটু দেখা করতে পারেন। মানিকগঞ্জের মানুষ। মা’র তলপেটের টিউমার অপারেশন দ্রুত এবং একজন ভালো চিকিৎসক দ্বারা করাতে তিনি সাহায্য করতে পারেন। রাজ্জাক ভাইয়ের চাচাত ভাই জহিরুল হক। তিনি এখন পাবলিক সার্ভিস কমিশন এর পরিচালক। সে সময় জহির ভাই এক নারী ডাক্তারকে পাঠালেন মা’য়ের নিকট। তিনি বেশ উঁচুমাপের চিকিৎসক মালিহা রশিদ। তাঁর স্বামী রশিদ সাহেবের সাথে জহির ভাইয়ের বেশ ঘনিষ্টতা। এ সুবাদে বেশ সহযোগিতা পাওয়া গেল। মা’য়ের অপারেশন সফল হলো। টিউমার নিয়ে এলিফ্যান্ট রোডে যাই। কোনরূপ খারাপ তথ্য আর পাওয়া গেল না। আবারও পেয়ে যাই রাজ্জাক ভাইয়ের সহযোগিতা। তাঁর ড্রাইভার মন্টু এবং গাড়ি। মানিকগঞ্জ বাড়িতে পৌঁছে দেন। রাজ্জাক ভাইয়ের প্রতি আমরা ঋণী। মা’য়ের চিকিৎসায় বিরল সহযোগিতা প্রদানের জন্য। এবার মা’কে দেখভাল করার আর লোকজন পাই না। বাবা’র অফিস। আমাদের কাজকর্ম। প্রতিবেশিরা বলেন, বিয়ে করতে। চাকুরি বাকুরি ছাড়া বিয়ে। এটি সম্ভব নয়। বাবা’র ঐকান্তিক চেষ্টা এবং প্রতিবেশিদের সহায়তায় সে যাত্রায় মা আরোগ্য লাভ করেন।
সময় থেমে থাকে না। এগিয়ে যায়। সফলতা আসে। আবার হারিয়েও যায়। ইপুকে বলি কক্সবাজার হতে মা’য়ের কয়েকটি ছবি পাঠাতে। ছবিতে মা’য়ের সেই হাসি আর নেই। মা বেঁচে থাক। এটি আমার কামনা। মা, হাসি তো আর সব সময় থাকে না। সমুদ্র আপনাকে হাসাতে পারলো না। ছোট ছেলে চেষ্টা করেছে। এটিই পৃথিবীর কয়জন করতে পারে। আপনি ধন্য আপনার এরূপ পুত্রত্রয় রয়েছে। ইপু’র মেয়ে গতকাল ফোনে মেসেস করে জানায়, দাদু এয়ারপোর্টে এসে খুব খুশি। আবহাওয়ার কারণে প্লেন উড়তে দেরি হবে। বেশ সময় পাচ্ছে। তবে আকাশে উড়তে দাদু’র ভয় করছে। ভয় জয় করে মা এখন কক্সবাজার। এ আনন্দ রাখি কোথায়। মা কক্সবাজারের আনন্দ স্মৃতি নিয়ে মানিকগঞ্জে ফিরে আসুন। সমুদ্র ভ্রমণ গল্প শুনার প্রতীক্ষায় রয়েছে আপনার প্রিয় মূখগুলো। মা গল্প বলবেন। আর একটু একটু হাসবেন। এ হাসি ছড়িয়ে পড়–ক সর্বত্র। হাসি ছড়ানোর কার্যক্রম বেশি বেশি করতে চাই। পৃথিবীর সকল বাবা মা হাসুক সন্তানদের উদ্দেশ্যে। মানুষের জন্য। গড়ে উঠুক শান্তির বাংলাদেশ।
কড়চা/ আর ই টি