মুনীর ভাই আমাকে সাহস দিয়েছেন
শ্যামল কুমার সরকার
খন্দকার মুনীরুজ্জামান। বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের প্রাচীনতম, বাংলাদেশের মুখপত্র ও অন্যতম প্রগতিশীল দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। অনেক আগে থেকেই আমি ‘সংবাদ’ এর সাথে বিশেষভাবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ষোলোআনা বিশ্বাসী, সাধারণ মানুষের ভরসা ও প্রগতির চেতনায় বহমান ‘সংবাদ’ এর গুনগান অনেক শুনেছি। এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামানকে টেলিভিশনের টক শোতে অনেক দেখেছি ও তাঁর কথা শুনে প্রাণ পেয়েছি। মোবাইল ফোনেও কথা হয়েছে। কিন্তু ততদিন সাক্ষাতে দেখা হয়নি। তবে দেখা করার ইচ্ছে আমার প্রবল। আবার দ্বিধা এমন স্বনামধন্য পত্রিকার বিখ্যাত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সাথে হঠাৎ দেখা করা কি আমার ঠিক হবে?
অবশেষে সব সংকোচ কাটিয়ে বছর তিনেক আগের এক সকালে পুরানা পল্টনের সংবাদ অফিসে যাই। মনে তখনো কিছুটা সংশয়। উনাকে পাব কিনা, পেলেও দেখা করতে পারব কিনা। আবার দেখা করতে পারলেও আমার সাথে খোলাভাবে কথা বলবেন কিনা ইত্যাদি। আমার সব সংশয় নিমিষেই কর্পুরের মত উবে গেল ‘সংবাদ’ কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কক্ষে ঢুকে। আদাব দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেই আমার পরিচয় দিলাম। বললাম, মানিকগঞ্জ হতে এসেছি আপনার সাথে দেখা করতে। উনি এতে বেশ খুশি হলেন। স্বস্তি পেয়ে জানালাম আমি ‘সংবাদে’ এর উপ-সম্পাদকীয় পাতায় লিখি। আমার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ সেখানে প্রকাশিত হয়েছে। আমার নাম অমুক। উনার তাৎক্ষনিক জিজ্ঞাসা আপনিই তাহলে সেই লেখক? আচ্ছা বলতেই চা এসে গেল। চা খেতে খেতে মুনীর ভাইয়ের সাথে লেখালেখি ও দেশের তৎকালীন অবস্থা নিয়ে অনেকটা সময় কথা হল। উনি মন দিয়ে লিখে যেতে বললেন। সাধারণ মানুষদের নিয়ে লিখতে বললেন। আহ্বান জানালেন যে কোনো অশুভ শক্তির সাথে হাত না মেলাতে, আপস না করতে। প্রগতির রাস্তায় চিরদিন হাটতে বললেন। সংবাদ শিল্পের বিরাজমান আর্থিক মন্দা নিয়েও কথা বললেন তিনি। বললেন এক সময় একতায় নিয়মিত লিখতেন। বললাম, আমিও একতায় লিখি। মুনীর ভাই যে আরেকটু আনন্দ পেলেন। অন্য একটি আলোচনা থাকায় তিনি আমাকে আর সময় দিতে পারলেন না। মানিকগঞ্জে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করে আমাকে বিদায় জানালেন।
এরপর ‘সংবাদে’ এর বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কর্মীদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলাম। এরপর চলে এলাম। সবই আজ স্মৃতি।
কিছুদিন আগে হঠাৎ ফেসবুকে দেখি আমার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় মানুষ মুনীর ভাই করোনায় আক্রান্ত। মনটা বিষাদে ভরে গেল। তবুও ফেসবুকে মুনীর ভাইয়ের জন্য কিছু কথা লিখলাম। এর কয়েকদিন পরেইআবার ফেসবুকে দেখি তিনি (৭২) নেই-চলে গেছেন (২৪ নভেম্বর ২০২০) চিরতরে। হঠাৎই সব থেমে গেছে। অনেকেই মুনীর ভাইকে নিয়ে সংবাদে লিখছেন। আমিও দ’ুটি কথা লিখলাম। আসলে কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। মুনীর ভাইরা কখনো বিগত হন না। উনারা সব সময়ই বর্তমান। তিনি আছেন, থাকবেন। মুনীর ভাইআমাকে সাহস দিয়েছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বাড়িয়েছেন আমার আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার নিজস্ব সীমাবন্ধতার কারণে উনার অনেক কথাই যেন মেনে চলতে পারছিনা। তবে শত বাঁধার মধ্যেও আমি চেষ্টা করে চলেছি। এক সময় শুনতাম ‘সংবাদ’-এ লেখা প্রকাশ না হলে কেউ লেখক হন না। কারণ ‘সংবাদ’ যে লেখক বানানোর কারখানা। আর এখন আমি বলি লেখক হওয়ার জন্য একজন মুনীর ভাইয়ের সান্নিধ্য লাভ করাও জরুরী। আপনার কর্মের মাধ্যমে, আপনার হাজার হাজার অনুরাগীর ভেতরে আপনি থাকবেন বহমান। আমি আপনাকে ভুলবনা, মুনীর ভাই। আপনি বাস করবেন আমার চেতনার জমিনে। ভালো থাকবেন ওপারে!
শ্যামল কুমার সরকার : সভাপতি, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মানিকগঞ্জ জেলাশাখা।