আব্দুর রাজ্জাক : ঘিওর উপজেলার গোয়ালডাঙ্গী গ্রামের মোঃ চুন্নু মিয়া একজন নির্মাণ শ্রমিক। ব্যাগ ভর্তি যন্ত্রপাতি নিয়ে সকাল বেলায় এসেছেন কাজে। সাথে দুইজন সহকারী মিস্ত্রী। সিমেন্ট আর বালুর মিশ্রণ কাজে ব্যস্ত তারা। চলতি পথে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করার পর জিজ্ঞেস করলাম, মে দিবসে সব বন্ধ থাকে, এটা শ্রমিকদের দিবস, আজ কাজ করতে এসেছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু মিয়া বলেন, ভাইজান, মে দিবস কি আমাগো খাইবার দিবো? কাজ না করলে পরিবার নিয়ে খামু কি? চারদিকে মহামারী, রাস্তাঘাট বন্ধ, কাম কাজ নাই বললেই চলে। বউ পুলাপান নিয়া কেমনে যে সংসার চালামু, চিন্তা করতে পারি না। কাজ করুম, টাকা নিয়া চাল কিনা খামু। আমাগো আবার মে দিবস কি?
শনিবার (১লা মে) কথা হয় ঢাকা আরিচা মহাসড়কের ঘিওর উপজেলাধীন জোকা এলাকায় এনএনবি ইটভাটার শ্রমিক নাজমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘ইটভাটায় কাজ করা আর জাহান্নামের আগুনে পুড়া সমান কথা। ১০ বছর আগে পাষন্ড স্বামী দুইজন পোলাপান আমার ঘাড়ে দিয়া আরেকটা বিয়া করছে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাইয়া আগুনে পুড়ে কাজ করতে অয়।’ শ্রম দিবস কি এ সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। শুধু জানালেন, এক দিন কাজ বন্ধ থাকলে সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। কোটরাগত চোখে একরাশ শূণ্যতা। এরপর একটি দীর্ঘশ্বাস; আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আবার কোদালের হাতল ধরে লেগে গেলেন কাজে।
শনিবার দুপুর। প্রচন্ড গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। বানিয়াজুরী-ঘিওর সড়কের বালিয়াখোড়া রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে বসে অছেন মিনি ট্রাক চালক মোঃ আসলাম মিয়া। ঢাকার কাওরান বাজারে লেবুর ট্রিপ ধরেছেন তিনি। তিনি বলেন, মে দিবস আছে জানি, কিন্তু ওই দিন কি হয়, কেন হয়? তা জানেন না। শুধু জানি, একদিন যদি গাড়ির চাকা না নড়ে, তাহলে আমাদের পেটেও টান পরে। করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাউন চলছে। কোন কামাই রোজগার নেই। গাড়ির কিস্তি দিতে হিমশিম খাচ্ছি। পরিবার পরিজন নিয়ে কিভাবে যে চলছি, তা একমাত্র অল্লাহ জানে।
এরকম চুন্নু, নাজমা কিংবা আসলামদের মতো প্রত্যন্ত এলাকার এসব মানিকগঞ্জের হাজারো শ্রমিকরা জানেন না মে দিবস কাকে বলে? জানেন না তারা এই দিবসের পটভূমি, কর্মসূচি ও অধিকার। তারা বোঝে একদিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে। জীবন-জীবিকার টানে কেউ মাটি কাটছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গড়ে তুলছেন সুউচ্চ অট্টালিকা আবার কেউ ইটভাটার আগুনের সঙ্গে সংগ্রাম করছে। এরকম নানা কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শ্রমিকরা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের অক্লান্ত শ্রম। লক্ষ্য একটাই, সারা দিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর একমুঠো চাল ডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা।
কথা হয় ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী-বাঠুইমুড়ি বেড়িবাঁধের ওপর বসবাসরত মাটি কাটার নারী শ্রমিক শেফালি সরকার, গীতা রানী সরকার ও ঝর্না সরকারের সঙ্গে। এরা তিনজনই বিধবা। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের লালন পালন করতে কেউ ২০ বছর, কেউ ১০ কিংবা ৮ বছর ধরে মাটি কাটার কাজ করে যাচ্ছেন। তিনজনই জানালেন, জীবন সংগ্রাম করে অনেকটা পথ পার করতে হয়েছে তাদের। জীবনের শেষদিকে এসেও কষ্ট তাদের পিছু ছাড়ছে না। আর শ্রম দিবস নিয়ে তাদের নেই কোন মাথাব্যথা। তাদের কথা একটাই, একদিন কাজ না করলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
অবার অনেকের কাছে মে দিবস মানে এক যন্ত্রণার গল্পগাঁথা। ঘিওর উপজেলা সদরের নির্মাণ শ্রমিক মোঃ আলতাফ। দীর্ঘ এক যুগ ধরে তিনি এ পেশায় জড়িত। কাজ করার সময় দোতলা থেকে পড়ে একটি পা ভেঙ্গে যায়। বন্ধ হয়ে যায় উপার্জনের পথ। এরপর তার মা, ২ সন্তান ও স্ত্রী নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাকে। কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনার শিকার হলেও ওই মালিক কিংবা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোন সহায়তা পান নি তিনি। আজ থেকে ঠিক ৫ বছর আগের মে দিবসেই তিনি এ দুর্ঘটনার শিকার হন। তাই তার কাছে মে দিবস মানেই এক বিভিষিকাময় কষ্টের উপাখ্যান।
তিন বছর আগে মে দিবসেই আরেক বৈদ্যুতিক মিস্ত্রী শ্রমিক রেজাউল করিম ঘিওরের রাধাকান্তপুর গ্রামে এক বাড়িতে কাজ করার সময় বিদ্যুস্পৃষ্টে মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অকাল মৃত্যুতে ওই পরিবারে নেমে আসে দু:খের কালো ছায়া। মে দিবস ওই পরিবার আয়োজন করে নিহতের দোয়া অনুষ্ঠানের। তাদের কাছে মে দিবস এক কষ্টের দিবস।
কিন্তু যে শ্রমিকটি প্রচন্ড রোদে অগণিত ঘণ্টা ধরে গাধার খাটুনি খেটে চলেছে, খুব ভোরে উঠে যার দিন শুরু, আবার রাতে সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে যার ঘুমোনোর সময়, তার জন্য কোনো আট ঘণ্টার মহান মে দিবস নেই। সে জানেও না আট ঘণ্টা মানে কত ঘণ্টা? ট্যানারির নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে যাওয়া গন্ধময় পরিবেশে যে শ্রমিকরা কাজ করছে, তাদের সাথে যে শিশু শ্রমিকরা নোংরা ময়লা ঘেটে জীবনের সুকুমার শৈশবকে মাটি চাপা দিচ্ছে, কাঁচা ইট জ্বালানো কিলিংয়ের আগুনের উপর দাঁড়ানো যে শ্রমিকটির মুখ সারাক্ষণই লাল হয়ে জ্বলছে, ভাটায় মায়ের সাথে ইট কাটছে যে কচি শিশুটি তার কাছেও মে দিবস কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সে জানে, তার হাতে ধরা ফর্মা বেসামাল হলেই আর এক হাতে পুড়বে! চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবে।
মানিকগঞ্জ নির্মাণ শ্রমিক কল্যান সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, যে সকল শ্রমিকদের পরিশ্রমের ফলে এই দেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সেই শ্রমিকদের দৈনিক ৮ঘন্টা কাজের পারিশ্রমিকে যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর করতে হবে। তিনি আরো বলেন, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের টাকায় উর্ধতন কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর মেহনতি শ্রমিকেরাই করছে মানবেতর জীবন যাপন।
ঘিওর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। পাশাপাশি তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এরকম মানিকগঞ্জে হাজার হাজার শ্রমিক রোদে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। তাদের এই কষ্টের মূল্য কেউ দিচ্ছে না। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মাটি কাটা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, মে দিবসে তাদের কাছে কোন গুরুত্বপূর্ণ দিন নয়। এ দিবসের তাৎপর্য কি তা বেশিরভাগ নারী শ্রমিকই জানেন না। তাই তো মে দিবসেও তারা পেটের তাগিদে কাজ করে থাকেন। তাদের ভাষ্য, একদিন কাজ না করলে ঘরে ছেলে সন্তান নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
পুখুরিয়া এলাকার ইছাক ব্রীকসের নারী শ্রমিক ফুলজান বেগম। বয়স ৫৫ বছর। তিনি অন্যান্য শ্রমিকদের রান্না করে খাওয়ান। সদর উপজেলার উকিয়ারা গ্রামের শহিদ উদ্দিনের মেয়ে ফুলজান। স্বামী হাকিম উদ্দিন ১৫ বছর আগে দুর্ঘটনায় মারা যান। রেখে যান ৪ সন্তান। স্বামীর মৃত্যুর পর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সন্তানদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। কখনও মাটি কাটার কাজ, কখনও ইটভাটায় কয়লা ভাঙার কাজ আবার কখনও রাজমিস্ত্রীর জোগান দিয়েছেন। ফুলজানের চেহারা রোদ ও আগুনের তাপে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। কথা বলার এক ফাকে দু’চোখের কোণে পানি টলমল করছিল। বার বার কাপড়ের আঁচল দিয়ে পানি মোছার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে। শুধু বলেন, ‘আমাগোর মতো মানুষের কষ্টের কথা আপনে লেইখ্যা কি করবেন।’
কড়চা/ এ আর