শিশু সিনহা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার : বাকরুদ্ধ সমাজ/ রুহুল ইসলাম টিপু

শিশু সিনহা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার : বাকরুদ্ধ সমাজ

রুহুল ইসলাম টিপু

প্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কড়চা’য় ২২ মে এবং ২৬ মে শিশু সিনহা ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ঘটনাকে নিয়ে দু’টি সংবাদ প্রকাশিত হয়। একটির শিরোনাম ‘মানিকগঞ্জে গাছের সাথে বাধা স্কুল ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার।’ অন্যটি সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনা করে ফলোআপ হিসেবে প্রকাশিত যার শিরোনাম ‘মানিকগঞ্জে শিশু ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় কিশোর গ্রেপ্তার’। কড়চা অনলাইনে প্রতিদিন এ দু’টি সংবাদে সিনহা’র মিষ্টি মুখ এবং সুন্দর একটি ছবি দেখছি। আর চরম কষ্ট নিয়ে হাহাকার করছি। সিনহা’র বয়স ৬। সে শিমুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। গ্রাম পশ্চিম শানবান্দা। আমাদের গ্রাম মান্তা’র পূর্বদিকের বাসিন্দা। ধর্ষণ এবং হত্যার অভিযোগ এসেছে সিফাত হোসেন শাকিল নামের এক কিশোরের বিরুদ্ধে। আদালত কিশোর শাকিলকে টঙ্গীর সংশোধনাগারে পাঠান। যার বয়স ১৪। আমি নির্বাক। জাতীয় শিশু নীতি-২০১১ এ শিশুর সংজ্ঞায় বলা আছে, শিশু বলতে আঠারো বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিকে বুঝাবে। এ সংজ্ঞার বয়স বিবেচনায় শাকিল একজন শিশু। শিশু নীতিতে একটু বিস্তৃত করে কিশোর কিশোরীকেও সংজ্ঞায়িত করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, কিশোর কিশোরী বলতে ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে বুঝাবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এ ‘শিশু’ অনধিক ষোল বৎসরের কোন ব্যক্তি।

নারী শিশু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার পুরুষ শিশু দ্বারা। এটি একটি বিরল দুঃখজনক ঘটনা। গ্রাম বাংলার সমাজ জীবনের চিত্রের সাথে এ ঘটনাকে মিলাতে পারছি না। অথচ আমরা সভ্যতা সাফল্য জ্ঞান বিজ্ঞানের উত্তরণ নিয়ে রচনা করছি শত শত গীতমালা। আমার সন্তান আজ ধর্ষিতা। তাকে করা হচ্ছে হত্যা। সন্তানকে বাঁচাতে পারছি না। ঘরের বাইরে গেলে দেখতে হবে সন্তানের মৃত মুখ। আজকের সমাজ তো হাজার বছরের ফসল। বিশাল ইন্সটিটিউট। সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে রয়েছে মানবের গৌরব। সমাজের উপর আস্থা হারাতে চাই না। সকলে মিলেমিশে বাঁচতে চাই। শিশু দুর্বল। নারী শিশু হলে সে হবে ধর্ষিতা এবং হত্যা। এ কান্না শুধু সিনহা’র বাবা-মা’র নয়। আমাদের সকলের। সিনহা’র ধর্ষণ এবং হত্যা ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজের দুর্বল এবং অসুস্থ দিকগুলো। অপরাধের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে বিভিন্ন পন্থায়। এগুলো নির্মূল ছাড়া সমাজের পরিত্রাণ নেই।

সিনহা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি জাতীয় পত্রিকায়ও এসেছে। ২৭ মে প্রথম আলোয়। শিরোনাম ‘ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ’। সাথের অন্য সংবাদটি হচ্ছে কালিয়াকৈরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ ও মাথায় কাঠ দিয়ে আঘাত করে নিহতের ঘটনা। ৩০ মে ২০২১ প্রথম আলো’তে দু’টি ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়। একটির শিরোনাম ‘আবার চলন্ত বাসে তরুণীকে ধর্ষণ’ স্থান আশুলিয়া। অন্যটি ‘মেয়ে ধর্ষণ, বিচার চেয়ে মারধরের শিকার বাবা’ ঘটনাস্থল মাদারীপুর। ০৩ জুন ২০২১ প্রথম আলো’র আরও একটি শিরোনাম ‘ধর্ষণ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করলেন চেয়ারম্যান’ স্থান ঝিনাইদহ। আমি কড়চা’য় ০৫ আগস্ট ২০২০ এ লিখেছিলাম অসভ্য মানবের প্রতি ঘৃণা শিরোনামে একটি লেখা। ঘটনাটি ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখের, স্থান আশুলিয়া। এটি হচ্ছে সবচেয়ে কম বয়সী শিশু ধর্ষণে মৃত্যুর খবর। শিশুর বয়স ৬ মাস। এরূপ লোমহর্ষক এবং নির্মম ঘটনার সংখ্যা অনেক। খবরের কাগজ এবং মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরের অন্তরালেও থেকে যায় অনেক আহাজারির কান্না। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বরাতে দৈনিক ইত্তেফাক ০৩ জুন ২০২১ এ প্রকাশ করে মে মাসে ২৪০ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার। এর মধ্যে ১০৪ জন কন্যাশিশু। ধর্ষণের শিকার ৯৫ জন। এর মধ্যে ৪৫ জন কন্যাশিশু। ৫ জন কন্যাশিশু দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার। ৩ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ২ জন কন্যাশিশু। আরো জানা যায়, ৭ জন কন্যাশিশুসহ ১২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। ২ জন কন্যাশিশুসহ ৭ জন যৌননিপীড়নের শিকার। ৭ জন কন্যাশিশু অপহরণের শিকার। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯ জন। এর মধ্যে ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৯ জন কন্যাশিশুসহ ৩৬ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান জানুয়ারি হতে এপ্রিল অনুযায়ী শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮৭টি।

ধর্ষণের ন্যায় ন্যাক্করজনক ঘটনা শূন্যের অংকে থাকবে। এটির ব্যতিক্রম কেউ প্রত্যাশা করেন না। এ আলোকে ১৩ অক্টোবর ২০২০ এ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সাজা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডের সাথে মৃত্যুদন্ড সংযোজিত করে সংশোধন আনা হয়। উদ্দেশ্য সর্বোচ্চ শাস্তির মাধ্যমে ধর্ষণ নির্মূল এবং কমানো। এটা সঠিক যে ধর্ষণের পিছনে থাকে মনস্তত্ত্বিক কারণ। বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব থেকে জানা যায়, একটি শিশু জন্মের পর যে মনটি সে পায়, সংস্কৃতিই তার মনটি তৈরি করে দেয়। শিশু বেড়ে উঠবে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। কৃষ্টি সৃষ্টি সংস্কৃতি এসব হচ্ছে মন এবং মনন গঠনের সহায়ক উপাদান। প্রভাব পড়ে সমাজ জীবনে। সমাজের সমৃদ্ধি ঘটে। এক্ষেত্রে পুরুষের প্রভাব অনেক বেশি। সামাজিক ব্যবস্থা এখনো পুরুষতান্ত্রিক। সমাজ জীবনে নান্দনিক কাজগুলো অনেক কমে গিয়েছে। এটি হতাশাজনক। চিত্রকলা, গান-বাজনা, গল্প-কবিতা পাঠ, লেখা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধূলা, শরীরচর্চা আরও বাড়াতে হবে। মানুষ বেড়েছে। অথচ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড কম বা হারিয়ে যাচ্ছে। এটি মানসিক বিকাশ এবং উন্নয়নের সাথে সাংঘর্ষিক। সমাজকে যারা দেখভাল করেন, নেতৃত্ব দেন, সেই আপামর মানুষের হাতেই রয়েছে পরিবর্তনের চাবি। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, দল-মত ধর্মসহ সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলনে একত্রিত বন্ধনের পরিবেশই হচ্ছে চিত্তাকর্ষক বাংলাদেশ। আজ নিহতের বাবা আব্দুল হালিম ও সিনহার মা কান্নাকাটি করে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এরূপ শোক বিহ্বলতা থেকে সমাজ ও দেশকে বাঁচাতে হবে। নাগরিকসহ শিশুর অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের আন্দোলন হতে হবে আরো বেগবান। প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে হবে দৃশ্যমান।

জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ সালে গৃহীত হয়। এর ধারা-১ এ বলা আছে, বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সম মর্যাদা ও অধিকারাদি নিয়ে সকল মানুষই জন্ম গ্রহণ করে। বুদ্ধি ও বিবেক তাদের অর্পণ করা হয়েছে এবং ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে তাদের একে অন্যের প্রতি আচরণ করা উচিৎ। ১৯৮৯ সালে বিশ্ব সকল শিশুদের জন্য অতিরিক্ত আরও একটি অধিকার সনদ লাভ করে। এটি হচ্ছে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ। ধারা-৬ (২) এ বলা হয়েছে, শরীক রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের বেঁচে থাকা এবং বিকাশের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সর্বাধিক নিশ্চয়তা বিধান করবে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এ বলা আছে, নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না। নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ এবং বিচার লাভের ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের প্রচলিত এবং বিশেষত: আইনসমূহ। ০১ জুন ২০২১ এ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদ পাঁচ মাসেও জমা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদন। স্কুলছাত্রী ধর্ষণের পর হত্যা। সর্বশেষ গত ১৮ মে পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে আদালতের কাছে ৩০ দিন সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। ঘটনাটি রাজধানীর কলাবাগানে ইংরেজি মাধ্যমে অধ্যয়নরত স্কুলশিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা। ভয় সে জায়গায় যেখানে বাস করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সমাজে অপরাধ বাড়ছে। রয়েছে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা। এরূপ নেতিবাচক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে অপরাধ কমাতে হবে।

শিশু সিনহা খুবই সুশ্রী। অপূর্ব রূপসী প্রাণবন্ত প্রতিভার এক শিশুকে হারিয়েছি আমরা মানিকগঞ্জবাসী। সিনহা আমার তিন কন্যার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের সকল শিশু’র প্রতিবিম্ব। সিনহা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। ন্যায় বিচার আমাদের দাবী। আর কোন কিশোর যেন এরূপ অপরাধে জড়িত না হয় সেদিকে সমাজ আরো জাগ্রত হোক। সমাজ, গবেষক, বিজ্ঞানী, সকলের পরশে মানুষ হবে আরো বিকশিত এবং মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন। ভুক্তভোগী নির্যাতিত পরিবারই উপলব্ধি করতে পারেন এরূপ নিষ্ঠুর অমানবিক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি। তাদের সাথে সমব্যথী হয়ে সমবেদনা জানাই। শিশু সিনহা হোক একটি প্রতিবাদ। বাকরুদ্ধ সমাজ জেগে উঠুক। দূর হোক অন্ধকার। সিনহা’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক ধর্ষণমুক্ত সমাজ। সিনহাসহ সকল শিশু ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধা।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ