স্মৃতিতে চৈত্র সংক্রান্তি এবং বাংলা নববর্ষ
রুহুল ইসলাম টিপু
বারো মাসে তেরো পার্বণ। আমাদের উৎসবের শেষ নেই। আমার দুই মামা। মা মেঝো। বাবা ও চার ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। চৈত্র সংক্রান্তিতে মামারা বাসায় আসতেন। আমরা বাস করতাম মানিকগঞ্জ মহকুমা শহরের বেউথা সরকারি কোয়াটারে। গ্রাম থেকে নিয়ে আসতেন কাসুন্দি, নতুন গামছা, পায়রা’র ছাতু, খেজুড়ের ঝোলা গুড় এসব। কদাচিত মা’র জন্য শাড়ি। টাকা পয়সা’র অভাব ছিল সেটি এখন বুঝতে পারি। কখনও পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়িতে। বেউথা নদী নৌকায় পার হলেই মানিকগঞ্জ। মামা বাড়ি ঝিটকা। চৈত্র সংক্রান্তিতে ভাই আসবে বোনের বাড়িতে, গামছা থাকতেই হবে। বোনের আয়ু বাড়াতে। সুখ এবং সমৃদ্ধি’র আশির্বাদ জানাতে। এটি রেওয়াজ। তখন বুঝি নি এর মর্ম। আজ অনুভব করছি। আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধির স্তর। অনেক রং এবং অর্থনৈতিক চাকচিক্যের মাঝে এ ভালোবাসার আজ বড় অভাব।
আমরা তিন ভাই। আমাদের বড় এক বোন ছিল। ছোট বেলায় মারা যায়। আমার বোন বেঁচে থাকলে, তার বিয়ে সংসার হলে, আমরা তিন ভাই নিশ্চয়ই বোনের বাড়িতে গামছা ছাতু গুড় নিয়ে বেড়াতে যেতাম। যেমন আমার মামারা প্রতি চৈত্র সংক্রান্তিতে চলে আসতেন আমাদের বাসায়। বোন থাকলে তার বাড়িতে ভাই যাবে। ভাই ভাইয়ের বাড়িতে আসা নিষেধ নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু চর্চার বড় অভাব। চৈত্রের রোদের ন্যায় লাল এবং বিচিত্র রংয়ের ঝলমলে পোশাকে আজ আমরা আচ্ছাদিত। ভাই-বোন বা ভাই-ভাই সম্পর্কের ভালোবাসার চৈত্র সংক্রান্তির সংস্কৃতি আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
বাবা ছিলেন মেলা পাগল একটা মানুষ। বাবা’র হাত ধরে মানিকগঞ্জের সকল মেলায় যাওয়া ছিল আমাদের তিন ভাইয়ের রেওয়াজ। মানিগঞ্জের রথ মেলা, বেতিলার রাস মেলা, মান্তার গরু-ঘোড়া দৌড়ের মেলা, হেলাচিয়ার নৌকা বাইচ, আর বালিরটেকের বৈশাখী মেলা। মসলাপাতি কেনা হতো রথ মেলা হতে, বালিসের তুলা আসতো বালিরটেক হতে। সাথে ঘোড়া, হাতি, কদমা’র বাতাসা। বাবার সাইকেল আর হ্যান্ডেলের দুই পাশে দু’টি ব্যাগ নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাসায় ফিরতেন। আমার বাবার সাইকেলের তিনকোণা ফ্রেমের মাঝে কাপড়ে বানানো আরও একটি ব্যাগ ছিল। সেটিও ভর্তি করে নিয়ে আসতেন কত কি! হয়তো মাছ কেনার খালই, চাল ঝাড়ার কুলা, চাল মাপার সের, বেতের ধামা, বোতল রাখার রঙিন শিখে। এসব অতীত। প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।
বাংলা নববর্ষ মানে হাল খাতা। লাল রংয়ের লম্বা নতুন হিসাবের ব্যবস্থা। বাবা’র আয় রোজগার ছিল কম। কেরানি’র চাকুরির মাসিক সামান্য বেতন। দোকানে বাকি থাকা স্বাভাবিক। বাবা নিয়ে যেতেন মানিকগঞ্জের বাজারের নানা দোকানে। অনেকের নাম ভুলে গিয়েছি। কার্তিক কাকা’র বাবার নাম নাগর সাহা। কার্তিক কাকা বাবার বন্ধু। তার দোকানের বাঙ্গি, গুড়, সাদা রসগোল্লা। অনেক সময় স্বর্ণালঙ্কার রেখেও সংসার চালাতে হতো। সেই কাকা’র নাম মনে নেই। তার পাওনার কিছু অংশ বাবা এদিন পরিশোধ করতেন। হাল খাতা’র সংস্কৃতির মধ্যে ছিল এক মধুর সম্পর্ক। আন্তরিক আপ্যায়ন। বাকিতে কেনা-কাটা বা দেনা-পাওনার মাঝে আমার লজ্জাবোধ থাকে। বাংলা নববর্ষের হাল খাতার আপ্যায়নে ছিল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং আস্থার সম্পর্ক; আমি কোন লজ্জা এবং অসৌজন্যতা খুঁজে পাইনি। মিষ্টি, ফল খাওয়ার পর দোকানীরা বলতেন, ভাই আরেক ছেলেকে কেন নিয়ে আসেন নি, ভাবিকেও আনতে পারতেন। এ আন্তরিকতার সীমানা আকাশসম।
বাংলাদেশের অর্থনীতির আজ বিশাল আয়তন। কিন্তু সংস্কৃতির অনেক কিছু আজ হারিয়ে যাচ্ছে। ঠেকিছাটা সর্ষের কাসুন্দি যেমন খুঁজে ফিরি। চৈত্র সংক্রান্তির গামছা-ছাতু; বৈশাখীর হাল-খাতার রস গোল্লা, কাকা-মামাদের ভালোবাসা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। চৈত্র সংক্রান্তি এবং বাংলা নববর্ষে আমরা হই উজ্জ্বীবিত এবং প্রাণবন্ত। বাঙালীর বৈশাখী ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক প্রকৃতির প্রতিটি আনাচে কানাচে। অশুভ এবং প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে সুখের আনন্দে জেগে উঠুক সকল মানব-মানবী।
কড়চা/ আর ই টি