২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস
রুহুল ইসলাম টিপু
২ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অটিজম সচেতনতা দিবস। ২০০৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতি বছর ২ এপ্রিল অটিজম সচেতনতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর পরের বছর বিশ্বে প্রথম অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হয় ২ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে। আমি অটিজমের সাথে পরিচিতি লাভ করি ২০০০ সালে। সে সময় ২ বছর বয়সী আমার বড় মেয়ে শ্রেয়ার অটিজমের উপসর্গ ধরা পড়ে এবং অটিস্টিক ব্যক্তি হিসেবে সনাক্তকরণ নিশ্চিত করা হয়। শ্রেয়া এখন ২৩ বছর বয়সী একজন পরিপূর্ণ নারী মানুষ।
জাতীয় শিশু নীতি অনুসারে শিশুর সংজ্ঞায় ১৮ বছরের কম বয়সী বাংলাদেশের সকল ব্যক্তিকে বুঝাবে। কিশোর কিশোরী বলতে ১৪ বছর থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে বুঝাবে। বয়সের হিসেবে শ্রেয়া আর শিশু নয়। জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনায় শ্রেয়ার মানসিক বয়স আমার ৫ম শ্রেণিতে পড়ুয়া সৃষার থেকেও কম। অটিজমে আক্রান্ত ২৩ বছর বয়সের শ্রেয়া শিশু না পরিপূর্ণ মানুষ সেটি আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। সচেতনতা দিবসে অটিজমে আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তিদের অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমরা অভিভাবক, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদের জন্য কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? তাদের অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আগামীতে আমরা বাস্তবিক কি নিদর্শন রেখে যাচ্ছি? এটি আমার নিত্য ভাবনা, চিন্তা এবং আতঙ্কের বিষয়। প্রশ্ন দু’টি আমাকে করা হলে উত্তর দিবো, আমি একজন ব্যর্থ বাবা। ব্যর্থতার লম্বা ইতিবৃত্তের সাথে আমরা বাংলাদেশবাসী সকলেই পরিচিত। অটিস্টিক সন্তানের বাবা হিসেবে অন্ধকারে ডুবে থাকতে আর ইচ্ছে করে না। সকলের নিকট তাই এখনো খুঁজে বেড়াই সহযোগিতার আলো।
অটিস্টিক পরিবারের সদস্য হিসেবে আজ ২০০৮ সালের প্রথম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসকে স্মরণ করছি। এর পূর্বের বছর ২০০৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট কর্তৃক আয়োজিত অটিজম এন্ড বিহ্যাবিয়ার ম্যানেজমেন্ট এর উপর সার্টিফিকেট কোর্সের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী বৃন্দ মিলে একটি স্মরণিকা প্রকাশ করেছিলাম। প্রচ্ছদে মানব মস্তিষ্কের ছবি ছাপানো ছিল। এটি একটি প্রতীকী ছবি। আমার দ্বিতীয় মেয়ে স্নেহা মস্তিষ্কের ছবি দেখিয়ে বড় বোন শ্রেয়াকে পরিচয় করিয়ে দিতো তার বন্ধুদের সাথে। বিষয়টি সঠিক কি-না আমি নিশ্চিত নই, তারপর আমরা এবং ছোট্ট স্নেহা বুঝেছিলাম অটিজমের জন্য মস্তিষ্কের বিশেষ একটি কোষ দায়ী। স্নেহার বয়স তখন ২ বছর ৬ মাস। অটিজমের জন্য দায়ী জীন, মস্তিষ্কের কোষ বা অন্য কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে নানাবিধ মতামত রয়েছে। এক সময় সুনির্দিষ্টভাবে অটিজম সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা যেমন জানা যাবে, একইভাবে এর সমাধানও পৃথিবী দেখতে পাবে।
অটিস্টিক বা শ্রেয়াকে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ খুব সীমিত। কারণ শ্রেয়াদের বড় সমস্যা আচরণগত। আচরণ বিজ্ঞান নামক একটি বিজ্ঞান রয়েছে। আচরণ বিজ্ঞানের ক্ষেত্র অনেক বড়। আচরণ বিজ্ঞান হচ্ছে আচরণ, মনোবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের সম্মিলিত বিদ্যা। আচরণ বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে প্রাণিবিদ্যা, ফার্মাকোলোজি, ফিজিওলোজি এবং নিউরোলোজি। এ বিদ্যার পরিপূর্ণতার সাথে যুক্ত রয়েছে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভূগোল এবং ইতিহাস। ২০০০ সালের কথা বলতে পারি অনেক নাম করা চিকিৎসক অটিস্টিক বা অটিজম ইংরেজি বানান ভুল করে লিখে দিচ্ছেন শ্রেয়ার প্রেসক্রিপশনে। আমরা সাধারণ ব্যক্তিরা জেনেছিলাম চিকিৎসা বিজ্ঞানে অটিজম বিষয়কে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তি এসেছে অনেক পরে।
অটিজম বা অটিস্টিক ব্যক্তিদের নিয়ে কার্যক্রমের বাংলাদেশের সাফল্যকে সাধুবাদ জানাই। অটিজম বিশেষজ্ঞ ডাঃ লিডি হকের পুত্র আদিল মিসরীয় সভ্যতাকে রং তুলিতে প্রকাশ করছেন। এটি আদিলের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিরল প্রতিভার নিদর্শন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পেশাল র্যাপোটিয়ার। তিনি ২৫ জুলাই ২০১১-এ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অটিস্টিক কার্যক্রমের সম্মেলন আয়োজন করে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ঢাকায় একত্রিত করেছিলেন। ঢাকা ঘোষণা ছিল অটিস্টিক কমিউনিটির জন্য একটি যুগান্তকারী অর্জন।
এত কিছুর পরও আমি দেখি, আমার শ্রেয়া বড় অসহায়। আমি শ্রেয়াকে ভালোবাসি। শ্রেয়ার দুই বোন স্নেহা ও সৃষা এবং তাদের মা শ্রেয়াকে যেভাবে আগলে রাখে; এটি আমার নিকট বিস্ময়। আমি স্নেহা, সৃষা এবং তাদের মায়ের নিকট কৃতজ্ঞ। আমার মৃত্যুর পর তারা শ্রেয়াকে একইভাবে লালন পালন করবে। এটি হচ্ছে একটি অটিস্টিক পরিবার। এ পরিবারের বাইরে প্রতিবেশি বলুন, সমাজ এবং রাষ্ট্র কেউ এগিয়ে আসেনি আমার শ্রেয়ার পাশে। আমার নিকটতম ভাইদ্বয় এবং তাদের পরিবারও। বাবা কিছু দিন পূর্বে গত হয়েছেন। মা আছেন। আমি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি না। বিশ্বাস করুন, কেউ বিন্দু মাত্র খোঁজ খবর পর্যন্ত নেন না। একটি অটিস্টিক পরিবার একজন অবুঝ মানুষের পিছনে বছরের পর বছর কিভাবে সময় কাটান, বাইরে থেকে কেউ কল্পনা করতে পারবেন না।
ছোট বেলায় গ্রামে দেখেছি যে কৃষক মাথায় বড় বোঝা নিয়ে হেঁটে যান, তাকে সাহায্য করার জন্য অন্য যে কেউ এগিয়ে আসেন। সমাজ বা রাষ্ট্রের সম্পদ তো শ্রেয়াকে করতে পারলাম না। দায় বা বোঝা বহন করা একার পক্ষে সত্যিই বড় কঠিন। অথচ এই আমরাই মুখে বলি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের কথা; সেখানে ৩ নম্বরে বলা আছে সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ: সকল বয়সী সকল মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ। ৪ নম্বরে রয়েছে, গুণগত শিক্ষা : সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবন ব্যাপী শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টি। ৫ নম্বরে আছে, জেন্ডার সমতা: জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের সময়সীমা ২০৩০ সাল। সে বছর আমার শ্রেয়ার বয়স হবে ৩২ বছর। তখনও তিনি থাকবেন অবুঝ জ্ঞানহীন, শিক্ষাহীন অপরিণত মানুষ অথবা জ্ঞানের ক্ষেত্র বিবেচনায় ছোট্ট শিশু। বাবা হিসেবে বিশ্ব অটিজম দিবসে এ সত্য গ্রহণ করার মধ্যে যে কষ্ট এবং লুকায়িত দুঃখ বিরাজ করছে, সেটি ঘুচানোর কোন পন্থা আমার জানা নেই। আমি তো আর একজন নই। সমাজে অটিজমে আক্রান্ত আরও মানব মানবী রয়েছে।
জাতীয় শিশু নীতিতে তাদের জন্য বলা হয়েছে, ‘অটিস্টিক শিশুদের অধিকাংশই স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ও সমাজের মূলধারায় একীভূত রাখা এবং শিক্ষাসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অটিস্টিক শিশুদের জন্য প্রয়োজনবোধে সুনির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা পদ্ধতি এবং উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। অটিস্টিক শিশুদের যেহেতু সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা থাকে, সেহেতু তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করার জন্য পরিবার বা তার বাবা মাকে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের জন্য যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। দুর্যোগ ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে অটিস্টিক শিশুদের বিশেষ চাহিদার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হবে।
জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এর মূলনীতি হচ্ছে : বাংলাদেশের সংবিধান, শিশু আইন ও আন্তর্জাতিক সনদসমূহের আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ। শিশু দারিদ্র বিমোচন। শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ। কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ। শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে শিশুদের অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণ।
আমি বিশ্বাস করি, নীতিসমূহ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সক্ষমতার কোন ঘাটতি নেই। শ্রেয়া পর্যন্ত সে সুফল কেন আসবে না সেটি শুধুমাত্র একজন অটিস্টিক পিতার ভাবনা বা চিন্তার বিষয় নয়। সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও এ বিষয়ে আরো বেশি করে এবং পরিপূর্ণভাবে ভাবতে হবে। কারণ বাংলাদেশের উপর সকল নাগরিকের আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে।
বিশ্ব অটিজম দিবস ২০২১-এ অটিস্টিক ব্যক্তি ও পরিবারের সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক আরো নিবিড় এবং ঘনিষ্ঠ হোক, একজন অটিজমে আক্রান্ত কন্যার পিতা এ প্রত্যাশা করছেন।