করোনা, বন্যা আর নদী ভাঙনে জর্জরিত মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ

আব্দুর রাজ্জাকঃ ‘চোখ মেলে চেয়ে থাকি নদীর দিকে, এক মুঠো চালের আশায়। চাল-ডাল নিয়ে কখন আসবে ত্রানের নৌকা? দিন যায় রাত আসে; কেউ আসে না চাল নিয়ে।’ এক বুক কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বললেন মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার দুর্গম যমুনা নদীবিধৌত চড় কাটারী এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ কাশেম মৃধা। প্রায় ২ সপ্তাহ ধরে চড় কাটারীর কাশেম মৃধার মতো চরের কয়েক হাজার পরিবার বন্যার পানির সঙ্গে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

হরিরামপুর উপজেলার দুর্গম পদ্মা নদীবেষ্টিত নটাখোলা চরের বাসিন্দা দিনমজুর জবেদ আলী। ১৫ দিন ধরে নটাখোলার জবেদ আলীর মতো ছলিমপুর ও ভগবানপুর চরের কয়েক হাজার পরিবার বন্যার পানির সঙ্গে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

মানবেতর জীবনযাপন করলেও কোনো জনপ্রতিনিধি দুর্গম এই চরগুলোতে একমুঠো চাল-ডাল কিংবা চিড়া-মুড়ি নিয়ে এখনো এগিয়ে আসেনি। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মানুষের চরাঞ্চলের দুঃখ-দুর্দশার কথা অকপটে স্বীকার করে বলেছেন তার এলাকায় একটি মানুষও এখনো কোনো ধরনের ত্রান সহায়তা পায়নি।

মানিকগঞ্জের ভূ-খণ্ড থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন বছরের ৩৬৫ দিনই পদ্মার সঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করে চলছে উপজেলার লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ। জেলা শহর কিংবা উপজেলা শহরে আসতে বছরজুড়েই পদ্মা নদীর প্রবল ঢেউ পাড়ি দিতে হয়।

একদিকে করোনা অঞ্চল, অন্যদিকে বন্যা পরিস্থিতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের মাঝে বেড়ে যাচ্ছে ভাঙন আতঙ্ক। গেল বছরের মতো এবারও শুরু হয়েছে ভাঙন। জেলার চরাঞ্চল এলাকার মধ্যে বর্তমানে দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ভাঙনের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।

দৌলতপুরের উত্তরখন্ড গ্রামে দেখা যায়, নদী ভাঙছে ভয়াবহতায়। স্থানীয়রা জানান, অনেক পরিবারের বসতভিটা আগেই নদীগর্ভে চলে গেছে। কোনো কোনো পরিবারের লোকজন ঘরবাড়ি ও মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ায় বসতভিটার অবশিষ্ট চিহ্নটুকু রয়ে গেছে।

চরকাটারী ইউনিয়নের বোর্ডঘর বাজার এলাকার আশপাশে দেখা যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী ছোট টিনের ঘর। দেখলে বোঝা যায়, অন্য স্থান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে বসানো হয়েছে। সেখানেই গাদাগাদি করে বসবাস করছে এসব পরিবার।

বাচামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ বলেন, এই ইউনিয়নে রয়েছে বাচামারা বড় বাজার, ইউনিয়ন পরিষদ, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ভূমি অফিস, একটি কলেজ, দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও খেলার মাঠসহ ফসলি জমি। প্রতিবছর নদীভাঙনে ইউনিয়নটি ছোট হয়ে আসছে। নদীর পূর্ব-উত্তর অংশে মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হলে এসব স্থাপনা ও জমি রক্ষা করা সম্ভব।

অসুস্থ হলে রক্ষা নেই। আর বর্ষা কিংবা বন্যা হলে চরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক, হাটবাজার আর ফসলি জমি সবই অথৈ পানিতে ভাসতে থাকে। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। হাজারো পরিবারের কষ্টের সীমা থাকে না। এবারের বন্যা তাদের আরো বেশি দুর্ভোগে ফেলেছে। ইউনিয়নে ১২ হাজার ভোটারের নির্বাচনী এলাকা ৬০ হাজার মানুষ পানির সঙ্গে হাবুডুবু খাচ্ছেন। প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা শুধুমাত্র পদ্মা নদীর প্রবল ঢেউ ডিঙিয়ে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের নটাখোলা, ভগবানপুর ও সলিমপুর চরে যেতে হয়। শুধু এই তিনটি চরই নয়, এই ইউনিয়নের ১৯ টি গ্রামের সবগুলো গ্রামই পদ্মা নদীবেষ্টিত। এখানে সারা বছরই মানুষজনের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। চরবাসী স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জেলা শহরে আসতে তাদের নদী ও সড়ক পথ পেরিয়ে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। সরেজমিন পদ্মার চরের লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি চর ঘুরে দেখা গেছে হাজারো পরিবার বন্যার পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে খাবারের অভাব। বন্যার আঘাতে বেকার হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। কাজকর্ম হারিয়ে এক ধরনের মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন পরিবারগুলো। প্রায় ২০ দিন ধরে তারা বন্যার পানির সঙ্গে লড়াই করে হাঁপিয়ে উঠেছে। কেউ তাদের খোঁজ নিচ্ছে না। প্রত্যেকটি বাড়ির উঠানে পানি। আর কারো কারো ঘরে কোমর পানি। তারই মধ্যে ঘরে মাচা করে কোনো রকম রাত পার করে দিচ্ছেন বানভাসি মানুষগুলো। এ ছাড়া অভাবের কারণে চুলোয় হাঁড়ি জ্বলছে না অনেকের ঘরেই। আর রান্না করার মতো বেশিরভাগ পরিবারের চাল-চুলো পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে নারীদের। গরু-বাছুর নিয়ে এই বন্যায় সবচেয়ে বিপাকে খামারিরা। কোরবানির গরু নিয়ে আতঙ্কে রয়েছে আরো বেশি। রাতে চোর ডাকাতের ভয়ে নির্ঘুমভাবে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন মানুষজন।

কথা হয় সিলামপুর চরের মানুষজনের সঙ্গে। গৃহিণী রুপালি বেগমকে দেখা গেল বাড়ির পাশে একটু উঁচু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে রান্না করতে। তার চারদিকে থৈ থৈ করছে পানিতে।

রুপালি বললেন, ‘প্রায় ১৫ দিন ধরে ঘর দুয়ারে এবং বাড়ির চারপাশে অথৈ পানির সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করে চলছি। বন্যার কারণে বাড়ির কর্তা বেকার হয়ে পড়ায় ছোট ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। এই বিপদের সময় কেউ কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। অথচ ভোটের সময় আমাদের কদর বেড়ে যায় তাদের কাছে।’ রুপালির এক চুলায় রান্নার জন্য অপেক্ষায় বসে আছেন প্রতিবেশী আঙুরি বেগম। বললেন, বাড়িঘর সবই পানি নিচে। কি যে কষ্ট করে পরিবার নিয়ে টিকে আছি তা আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন। আল্লাহ ছাড়া আমাদের এই দুরবস্থা দেখার কেউ নেই।

নটাখোলা চরের বাসিন্দাদেরও একই অবস্থা। সেখানের হাজারো পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। ত্রানের আশায় দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে পদ্মার দিকে। চরে কোনো নৌকা ঢুকলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠেন সেখানকার নারী, পুরুষ এমকি ছোট ছোট শিশুরাও। কিন্তু যখন দেখেন ট্রলারে কোনো ত্রান আসেনি তখন মনে কষ্ট পান তারা।

এই চরের অসুস্থ গৃহবধূ বিলকিস আক্তার সবেমাত্র পেটে অপারেশন হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অপারেশনে তার ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় অর্থকড়ি যা ছিল সবই ফুরিয়ে গেছে। ঘরে চাল নেই, স্বামী সন্তানদের মুখে কীভাবে খাবার তুলে দেবেন এ চিন্তায় তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বললেন, বন্যায় স্বামী (রিয়াজুল মিত্রি) বেকার হয়ে পড়েছে। যার কারণে খুবই কষ্টে আছি।

গরু নিয়ে বিপাকে: বর্ষা কিংবা বন্যায় এলাকাগুলো তলিয়ে যাওয়ায় এখানে চোর ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে যায়। দুর্বৃত্তরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে মাঝেমধ্যে হানা দেয়। যার ফলে এখানকার মানুষজন গরু বাছুর নিয়ে আতঙ্কে রাত পার করছেন। প্রতিটি বাড়ির সদস্যদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে গরু পাহারা দিতে গিয়ে।

চরাঞ্চলবেষ্টিত লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোনা মিয়া জানালেন, দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা কোনো ধরনের ত্রান সহায়তা চরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। ৬০ হাজার মানুষের এই ইউনিয়ন এখন পানির সঙ্গে খাদ্য সংকটে ভুগছেন বলে অকপটে স্বীকার করেছেন চেয়ারম্যান সোনা মিয়া। তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের নামের তালিকা শুরু করেছি। হয়তো ঈদের আগে তাদের কাছে কিছু খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিতে পারবো।

কড়চা/ এ আর

Facebook Comments Box
ভাগ