চলে গেলেন আরেক স্বজন আলোয়ার ভাই/ মধুসূদন সাহা

চলে গেলেন আরেক স্বজন আলোয়ার ভাই

মধুসূদন সাহা

পৃথিবীতে সব মানুষ যদি রাশভারী থাকত, ফরমাল আচার আচরণ করত তবে নিঃসন্দেহে সেই পৃথিবী বসবাসের অনুপোযোগী হত। কিছু মানুষ আছেন যাদের কর্মকাণ্ড এই পৃথিবীকে আনন্দময় ও বাসযোগ্য করে তোলে, তেমনি এক আনন্দময় মানুষ ছিলেন আমাদের আলোয়ার ভাই।

শ্রদ্ধেয় জাসদ নেতা আমাদের ইকবাল ভাইয়ের অগ্রজ হলেও তিনি নিজ কর্মকাণ্ড ও গুনে পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়াবিদ, সমাজসেবক, চিত্র শিল্পী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল এক সর্বজন পছন্দের ব্যক্তিত্ব। আর উনাদের পরিবারের সাথে আমার ছিল খুব কাছের সম্পর্ক। ইকবাল ভাইয়ের সাথে উনাদের গ্রামের বাড়ি আমি অনেক বার গিয়েছি। ফারিরচর, মাধবপুরে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছি। ইকবাল ভাইয়ের পলাতক জীবনের অনেক সময়ই সঙ্গী হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রাবাসের রুমে পলাতক জীবনে ইকবাল ভাই দীর্ঘদিন অফিসের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ইকবাল ভাইয়ের সাথে ছিল আমার শ্রদ্ধার সম্পর্ক। আর আলোয়ার ভাইয়ের স্নেহধন্য হলেও উনার সাথে ছিল আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। উনার সাথে আমার প্রবাস জীবন ও নানা কারণে প্রায় তিরিশ বছর দেখা নেই। সে এক দুঃসহ স্মৃতি। আশায় ছিলাম, ‘এ জীবনে যদি আর কোন দিন দেখা হয় দুজনার’। হলো না।

গত কয়েক বছর আগে উনি দেশে ফিরেছেন। আমিও বাংলাদেশে গিয়েছি। বড় আশা অন্তরে লালন করেছিলাম, এইবার দেখা ফিরায় কে! বিধিবাম উনি বরশাদ ভাইয়ের সাথে চিকিৎসার জন্য ভারতে। ট্রাজেডির ষোলকলা পূর্ণ হল উনি যেদিন বাংলাদেশ ফিরলেন, সেদিন আমি ভারত চলে গেলাম। তবুও প্রচেষ্টা থামাইনি। দিন কয়েক আগে আমাদের স্নেহাস্পদ উনার ভাইপো রাজুর কাছ থেকে উনার ফোন নং নিলাম। ৭ ডিসেম্বর বিকেলে দুই কিস্তিতে মন খুলে কথা বললাম। সেই শেষ কন্ঠস্বর। তারপর ১৯ ডিসেম্বর শেষ  আবার চেষ্টা করলাম। হল না। আজকে চূড়ান্ত খবর জানলাম।

তিনি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর দাশড়া আমাদের পাড়ায় রায়বাডড়ির পুকুরের কাছে একটা বাড়িতে সরোয়ার ভাই, আলোয়ার ভাই সহ কিছু মুক্তি যোদ্ধা একসাথে থাকতেন। চর মত্তের আনিস মাস্টারের ছেলেদের গ্যাং এর সাথে কি কারণে উনাদের বিবাদ হয়। একদিন হঠাৎ চরমত্তের ভাইয়েরা মুক্তি যোদ্ধা ক্যাম্পের সবাইকে রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে যায়। বিধ্বস্ত অবস্থায় ছেড়ে দেয় চরের আইলে। মানিকগঞ্জের তৎকালীন ইতিহাসে ওটা ছিল এক চাঞ্চল্য ঘটনা।

আলোয়ার ভাই শরীর চর্চা করতেন, ভাল ক্যারাম খেলতেন, সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি হকি খেলায় দক্ষ গোলকিপার ছিলেন।

সমাজ সেবায় মানিকগঞ্জে আলোয়ার ভাই ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আলোয়ার ভাইরা প্রায় দেড় দশক মানিকগঞ্জে ত্রান কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে একাধারে অনেক বছর ছিল নিত্যদিন। তিনি দীর্ঘদিন মানিকগঞ্জের অগ্রণী ত্রান সংগঠন বিবেকানন্দ জাগরণী সংঘের নেতৃস্থানীয় পদে ছিলেন। যে সংগঠন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে প্রায় দেড় দশক টর্নেডো, বন্যা, দুর্ভিক্ষ সহ সমস্ত দুর্যোগে ত্রান বিতরণ করে। অনেক সময় প্রশাসনকেও এরা ত্রান দিয়ে সাহায্য করেছে।

চিত্র শিল্পে আলোয়ার ভাইয়ের অসম্ভব দক্ষতা ছিল। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন তিনি জাসদের প্রচার সেলে। তৎকালীন সময়ে রাজনৈতিক প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার ছিল দেওয়াল লিখন বা চিকা মারা। এই কাজে উনার মত দক্ষ মানিকগঞ্জ মহুকুমায় কেউ ছিল না। কারুর যদি হাতের দশকের প্রথম দিককার কথা মনে থাকে তবে নিশ্চয়ই দেখেছেন দেবেন্দ্র কলেজের সামনে বিশাল দেওয়াল লিখন-‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। আলোয়ার ভাইয়ের লেখা। এবং এটাই মানিকগঞ্জের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে ব‌ড় দেওয়াল লিখন। উনার দেওয়াল লিখন ছিল শিল্পের পর্যায়ে। এটা ছিল রাতের কাজ। সহযোগিতায় ছিলাম আমরা অনেকেই। একটা ভ্যানে রঙ, ম‌ই সহ যাবতীয় থাকত। আর আমাদের ধরে থাকা ম‌ই বেয়ে উপরে উঠে তিনি লিখতেন। এর মধ্যে পুলিশ ও বিরোধী দের চোখ রাঙানি তো ছিলই।

অন্যদিকে তিনি ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ। নিজেও হাসতে পারতেন। আর মানুষকেও হাসাতে পারতেন। এই যুগপৎ চিত্র মত দিন বেঁচে থাকব ততদিন বয়ে বেড়াতে হবে। যা ভোলার নয়।

ভাল থাকবেন আলোয়ার ভাই।।

কড়চা/ এম এস

Facebook Comments Box
ভাগ