অনি এবং নিতা/ রুহুল ইসলাম টিপু

অনি এবং নিতা
রুহুল ইসলাম টিপু

নিতা ভেবেছিল, আজ অনির চিঠি আসবে। ডাক পিওন পাশের বাসার চিঠি দিয়েছেন। নিতার ছিল না। তাই নিতার মন খারাপ। অনির নিকট হতে সপ্তাহে কমপক্ষে দুটি চিঠি পায় নিতা। কখনও বেশিও আসে। সপ্তাহে পাঁচটি চিঠি পেয়েছে বেশ কয়েকবার, এটিও নিতার মনে আছে। এ চিঠিগুলো নিতার প্রাণ। অনির চিঠি’র মধ্যে থাকে বিচিত্র কর্মের ফিরিস্তি। কোথায় গিয়েছে, কি করেছে, কার সাথে দেখা হলো, নতুন বন্ধু, নানাবিধ বিষয়। নিতার এসব পড়তে খুব ভালো লাগে। নিতা পড়ে আর ভাবে, সে তো অনির সাথেই আছে। অনির কর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিতা। অনি লিখতে পারে। যেখানেই যাবে নিতাকে সে অভিজ্ঞতা জানাবে। অনির কাজ এবং নিতাকে লিখা এক ও অভিন্ন। চট করে লিখতে পারার গুণটি অনি বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। নিতা অনির চিঠি পড়ে। শুধু প্রয়োজনীয় অংশের উত্তর দিবে। কিছু প্রশ্ন করবে। অনির চিঠি তিন পৃষ্ঠা হলে, নিতার চিঠির উত্তর হবে অর্ধ পৃষ্ঠা। তবে নিতা কোন চিঠির উত্তর দেইনি। এমন ঘটে নি। অনির চিঠি পড়তে পড়তে নিতাও তার মতো করে বিষদ লেখার অনুশীলন শুরু করেছে। নিতার চিঠিতে থাকে আবেগ; অনির চিঠিতে থাকে বর্ণনা এবং দৃশ্যপটে ভরপুর। তিন বছর পার হলো অনি এবং নিতার চিঠি বিনিময়। বড় মধুর সম্পর্ক। চিঠি বন্ধু। অনি এবং নিতার চিঠি বন্ধুর সূত্র পত্র মিতালী নয়।

বছর তিনেক পূর্বে তাদের দেখা হয়েছিল। একটি পাঠাগার আয়োজিত দেশব্যাপী রচনা প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং সাহিত্য আসর। দেশের নামকরা লোক সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং লেখক এর সমাবেশ ঘটেছিল পাঠাগারে। অনি আয়োজকদের পক্ষের একজন কর্মী। নিতা পুরস্কার গ্রহণ করতে এসেছে ময়মনসিংহ হতে। সাথে তার বাবা। পাঠাগারটি মানিকগঞ্জ শহরের বাইরে। নদী পাড় এবং রিক্সা মিলে ঘন্টা খানিকের পথ। ভারী সুন্দর গ্রাম। পাঠাগার লাগোয়া একটি সবুজ খেলার পাঠ। গ্রামের মাঝে রাস্তার সাথে একটি ছোট্ট খাল, মিশেছে বড় আরেকটি খালে, গন্তব্য কালিগঙ্গা নদী। শীতকাল। তাই খালে পানি নেই। গ্রামের ভিতর বিভিন্ন পাড়ায় যাওয়ার কয়েকটি সাঁকো দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা মনে করিয়ে দেয়। অনির উপর দায়িত্ব পড়েছে, অংশগ্রহণকারীদের আপ্যায়ন এবং অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাওয়ার। আয়োজনকে কেন্দ্র করে গ্রামে একটি সাজ সাজ ভাব। এটি বাৎসরিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। অনি বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। আয়োজক পাঠাগারের বড় ভাই’রা তাকে এ কর্মটি না দিলেও পারতেন। বিশেষ করে অপরিচিত নারীদের সাথে কাজের ক্ষেত্রে। উত্তর পাড়ায় পিডিবি’র প্রকৌশলীর বাড়ি। সেখানে শীতকালীন পিঠা এবং সকালের নাস্তা করার পর যেতে হবে পাঠাগার চত্বরে। রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো পথ। অনিকে তাড়া দিচ্ছে দ্রুত নাস্তা শেষ করে সকলকে নিয়ে মঞ্চে যেতে হবে।

নিতা বলল, চলুন, মঞ্চের দিকে যাই। অনি এবং নিতা’র নাম পরিচয় ঘটে নাস্তার সময়। অনি জানাল, আসুন আমার সাথে। নিতার বাবা অতিথিদের সাথে পূর্বেই অনুষ্ঠানস্থলে চলে যায়। অতীব রূপসী, হলদে এবং লালের মিশ্রণের পোষাকে নিতা ছিল অপরূপ। অনি’র আড়ষ্টতা তেমন না কাটলেও এক ধরণের গর্ব অনুভূত হয়। সুন্দরী নারীর সাথে পথ চলা; এ এক অন্য রকম রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। এভাবেই দুই প্রান্তের নারী ও নরের যাত্রা। চিঠি আসে চিঠি যায়। জানা হলো। ঘনিষ্টতাও বেড়ে যায়। চিঠি যোগাযোগে নাম পরিবর্তন করে তারা নিতা এবং অনি রাখে। এটি তাদের নিজস্ব আবিষ্কার। অনি নিতাকে এবং নিতা অনিকে পেয়েছে। তাই বাবা মা’য়ের দেওয়া নাম কেমন যেন বেমানান। নিতা’র মাঝে অনি ঢুকে করে নিলো অনিতা। তিন অক্ষরের ভিতর দুই মানব মানবী। মধুময় সম্পর্ক। চিঠিতে একে অপরকে কাছে পাওয়া এবং রাখার অঙ্গীকার।

সময় গড়িয়ে যায়। নিতা’দের পরিবার ময়মনসিংহ থেকে চলে আসে কুমিল্লায়। নিতা এখন ভিক্টোরিয়া কলেজ, রানীর দিঘীর পাড় এলাকার পূর্ব পুরুষের বাড়িতে। অনিকে কুমিল্লায় আসার আমন্ত্রণ জানায় নিতা। অনি’র সময় ব্যস্ততায় ভরা। ভুলেই গিয়েছে নিতা’র চেহারা। বছর পাঁচেক পূর্বের এক ঝলক দেখে ঠিক মনে করতে পারছে না নিতাকে। কাছে এলে তাকে চিনতে অসুবিধা হবে না ঠিক। তবে এতো নিকটতম ভালবাসার মানুষের চেহারা ভুলে যাওয়া; এক ধরনের অপরাধবোধ অনিকে কষ্ট দেয়। নিতা’র কোন ছবিও অনি’র কাছে নেই। পাঠাগারের প্রোগ্রামের ছবিগুলোও বড় ভাইদের কাছ থেকে নেওয়া বা দেখা কোনটিই ঘটে নি অনির।

নিতা’রা চার বোন। নিতা বড়। লেখালেখি করার চর্চা স্কুল হতে। এখন স্থানীয় একটি পত্রিকায় মাসিক নারী বিষয়ক পাতা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। পড়াশুনার পাশে পত্রিকার সাথে সম্পর্ক নিতার। দেশ ও সমাজ পরিবর্তনের একজন অগ্রগামী কর্মী। অনি’র খুব ভালো লাগে। তার নিতা এগিয়ে যাচ্ছে দেশকে নিয়ে। অনি নিতা’র আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারে না।

ঠিক হলো মে মাসের ১০ তারিখ অনি কুমিল্লায় যাবে, শহরে নিতার পত্রিকা অফিসে। সেখানে নিতা থাকবে। এরপর নিতা বাসায় নিয়ে আসবে। মেঘনায় ব্রীজ নির্মাণ চলছে, সায়েদাবাদ থেকে বাসে শাসনগাছা কুমিল্লা। মাঝে ফেরি। সময় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। আবার ফিরে আসা। একই সময়। ক্ষণিকের দেখা। অনেকদিন পূর্বে পাঠাগারের গ্রামের পথে হাঁটার স্মৃতি। পুনরায় আজ দেখা হবে। সেটিও খুব বেশি সময়ের জন্য। অনি পত্রিকার অফিসে ঢুকে সকাল সাড়ে ১১ টায়। একটি ছাপাখানা। দুই রুম। একদিকে মেশিন এবং ছাপাখানার সরঞ্জামাদি। অন্যটির এক পাশে ছাপাখানার অফিস এবং অন্য পাশে পত্রিকার অফিস। বসার জায়গা খারাপ নয়। পত্রিকার অফিসের আদলে ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পরিসর বড় নয়। অফিসটি দোতলায়। অফিসে মাত্র একজন লোক বসা। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আপা আজ আসেননি। ফোনে জেনে নিন। আপা আসবেন কি-না। অনি পত্রিকা অফিসের ফোনের সহায়তা চাইলেন। লোকটি দেখালেন, তাদের ফোন তালা। ল্যান্ড ফোন সব জায়গায় পাওয়া যায় না। অনি এ শহরের কিছুই চিনে না। এতদূর এসে দেখা হবে না নিতার সাথে। আশা আকাঙ্খা স্বপ্ন মাটিতে মিশে যাবে। নিতাদের বাড়িও চিনে না অনি। পত্রের যোগাযোগ। অপরিচিত হয়ে কোন নারীর বাড়িতে যাওয়া বড় বিপদ। নিতাদের বাড়ির ফোন নম্বর জানে অনি। এটিই শেষ ভরসা।

পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে অনি পুলিশের একটি ব্যারাকে যায়। সেখানে স্থানীয় কলের জন্য অনি এক কর্মকর্তাকে অনুরোধ করে। অনুরোধে লাভ হয়। তিনি সুযোগ দেন একটি কল করার জন্য। অনি নিতাদের বাসার নম্বরে কল করে, অপর পাশ থেকে রিসিভার তুলে পুরুষ কন্ঠে হ্যালো বলায়, অনি ভয় পেয়ে যায়। অনি নিজের পরিচয় দিয়ে নিতাকে চায়। ভদ্রলোক বলেন, আমি টেলিফোনের লোক, লাইন নষ্ট, ঠিক করতে এসেছি। আপনি এক ঘন্টা পর কল করুন। তখন ঐ নম্বরের বাড়ির লোক ফোন ধরবে। এখন সম্ভব নয়। অনি জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থায় এসে পড়েছে। আরো এক ঘন্টা। কে তাকে ফোন করতে দিবে। পুলিশ ভাইকে বলে একটি কল করার সুযোগ দিয়েছে। আবার কি পুলিশ ভাই সুযোগ দিবে? বিকল্প আর কোন পথ না পেয়ে এক ঘন্টা অপেক্ষার পর অনি আবার ফোন করে; এবার নিতা’র কন্ঠ পাওয়া যায়। ভীষণ খুশি। অনি এই শহরে; বিশ্বাসই করতে পারছে না নিতা। অনিকে বলল, এক্ষুণি আসছে নিতা, পত্রিকা অফিসে অপেক্ষা করতে বলে, ছেড়ে দেয় ফোন।

অপেক্ষার পালা আর শেষ হয় না অনির। অবশেষে চলে এলো কাঙ্খিত নারী। এসেই বলেন, আমি নিতা নই, ওর ছোট বোন। আপা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, আমার সাথে যেতে বলেছেন। হায় কপাল, অনির। কোনভাবেই দেখা মিলছে না নিতার। দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পথ এবং বাধা যেন শেষই হচ্ছে না।

আমার সাথে রিক্সায় বসতে আপনার আপত্তি নেই তো, কথাগুলো নিতার ছোট বোনের। অনির কোন কিছুতেই আর আপত্তি নেই। শুধু নিতার সাথে দেখা হলেই চলবে। ভেবেই উঠে বসে রিক্সায়। ভাইয়া, আমাদের বাড়ি শহরের একটু বাইরে। আমি কয়েকটি কাজ করেই আপনাকে নিয়ে যাবো। অনি ভাবে আরো দেরি, আরো অপেক্ষা। এবার অনি আরো অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে গেলো।

নিতার বোন নিয়ে গেল ক্যাসেটের দোকানে। বাছাইকরা গান রেকর্ডিং এর ক্যাসেট নিবে। রিসিপ্ট নিয়ে আসেনি, দোকানীর সাথে তর্ক, কয়েকটি চেক করার পর পাওয়া গেল কাঙ্খিত রেকর্ডিং ক্যাসেট। এরপর ফুজি ফিল্ম এ ছবি প্রিন্ট এর অর্ডার, সেটিও নিল। সর্বশেষ টেইলারিং শপ হতে জামা কাপড় নেওয়া। রিসিপ্ট ছাড়া কিভাবে ছবি পোশাক নিচ্ছে অনি দেখছে, আর হাসছে। অন্যদিকে অনি’র অন্তরাত্মা কেঁদে যাচ্ছে, এই বুঝি আর দেখা হবে না নিতার সঙ্গে।

অবশেষে দুপুর গড়িয়ে তাদের বাড়ির সামনে রিক্সা থামে। অনি নেমে আসে, বসার ঘর খোলাই ছিল। নিতা দাঁড়িয়ে আছে পর্দার মাঝখানে। ঘরে ঢুকেই মুখোমুখি বসা। অনি তাকিয়ে আছে চোখ নীচু করে। লজ্জা, ভয়, উৎকন্ঠা এবং এক রাশ ক্লান্তি নিয়ে। চোখ তুলেই অনি দেখে মৃদু হেসে যাচ্ছে নিতা। এ হাসি এবং চোখাচোখি বলে দেয় তাদের গভীর ভালোবাসা।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ