আমি এবং একটি মৃত্যু/ রুহুল ইসলাম টিপু

প্রয়াত মিজানুর রহমান

জন্ম হলেই বাবা-মা পাওয়া যায়। একথা ঠিক। তবে ব্যতিক্রমও ঘটে। কোন কোন মানবসন্তান জন্মের পর বাবা-মা’ কাউকে পান না। কেউ শুধু বাবা, কেউ শুধু মা ছাড়াই বড় হন। আমার ছোট কাকার জন্ম হয়েছিল দাদার মৃত্যুর পর। তিনি জন্মের পর বাবাকে পাননি। যাদের বাবা মা নেই, তারা ছাড়া এ সম্পদের মূল্য বুঝার সক্ষমতা অর্জন সম্ভব নয়। বসা হাঁটা শেখার পর বোধ হয় একটু একটু করে বুঝতে শিখেছিলাম, আমি জন্মেছি। আমার বাবা মা আছেন। তাদের ঘরে আমি এসেছি। আমি তাদের সন্তান। তাদেরকে বাবা মা বলতে শুরু করি। পেলাম বন্ধু। আমার আরও দুই ছোট ভাই। একজন দুই বছরের, অন্যজন ছয় বছরের ছোট। এই একটু একটু জ্ঞান বৃদ্ধির মাঝেই মৃত্যু শব্দ কানে আসতে লাগল। আমার বড় বোন আমার জন্মের কিছু পূর্বে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল সাড়ে তিন। তার ব্যবহৃত জামা কাপড় স্মৃতিকে ধরে কাঁদতে দেখেছি মাকে। অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান এর বাড়িতে তার মৃত্যু হয়। তার ছেলে অধ্যাপক বাবুল এবং সেখানকার পাড়া প্রতিবেশিরা এখনও আমাকে টুকটুক এর ভাই হিসেবে চেনে। আমার বোন টুকটুক এখনো তাদের স্মৃতিতে রয়েছে। সেই ছোট্ট বয়স হতে জন্ম এবং মৃত্যু শব্দের অর্থ আমার নিকট অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে থাকে। দেখতে থাকি মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু। আমিও তিন কন্যার বাবা। সময় গড়িয়ে নানা এবং দাদা হবো।

বাবা মা উভয়ই বেঁচে আছেন। বয়সের ভার তাদের অনেক। ফেব্রুয়ারিতে দেখে এসেছিলাম। এরপর করোনা। জুলাই মাসের শেষে এসে পিছনে তাকাই। কতদিন তাদের দেখি না। ভয় এবং আতঙ্ক। এই বুঝি মোবাইল বেজে খবর দিবে। আর নেই। করোনা পৃথিবীকে দিলো একসাথে অসংখ্য মৃত্যুর বিরল অভিজ্ঞতা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ক্লান্তিহীন মানুষ বাঁচানোর সংগ্রাম করছেন। জীবন এবং জীবিকাকে একসঙ্গে বাঁচিয়ে রাখার বড় নিষ্ঠুর সময় এখন আমাদের। আমার কর্মক্ষেত্র বনানীতে। আট তলা ভবনের সাত তলায় আমাদের অফিস। ভবনটি দেখভালের জন্য বাড়ির মালিক কর্তৃপক্ষ একজন ব্যবস্থাপক নিয়োগ দিয়েছেন। নাম মিজানুর রহমান। বাড়ি চাঁদপুর, সদালাপী, সজ্জন এবং ধার্মিক।

প্রতিদিন চলার পথে মিজানুর রহমানের সাথে দেখা। ভাব, কুশলাদি এবং সালাম বিনিময়ের সম্পর্ক। মৃদু হাসি সবার থাকে না; মিজানুর রহমানের অনন্য এ দিকটি ছিল। পোষাক আশাকেও ছিল রুচির সমাহার। করোনার কান্নায় বেসামাল শ্রাবণ। মেঘের ছোট আকাশ। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। ভিজে ভিজে আকাশ ছোঁয়া; কাদা পানি একাকার হয়ে বুধবার সকালে অফিসের গেটে ঢুকি। খেলাম বড় ধাক্কা। শুনলাম মিজানুর রহমান মারা গেছেন। গত ২১ জুলাই ২০২০ এর সন্ধ্যায়। কী হারালাম, কাকে আর পাবো না, কে পৃথিবী ছেড়ে গেলো, আর আসবে না, চিরতর বিদায়, দেহাবসান, এটিই মানব মৃত্যু। কাজের ভিড়ে এটি নিয়ে তেমন আমল দিতে পারিনি; তবে একটি অন্ধকার দেখতে পেলাম।

সন্ধ্যায় বাসায় ফিরার পথে অজস্র ভাবনা এসে ভিড় করে। মিজানুর রহমানের স্ত্রী, সন্তান, তার আত্মীয় স্বজন। কিছু মানুষ ছিল তার উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। তাদের প্রস্তুতি থাকার কথা নয়। এক রাশ অনিশ্চয়তা। মৃত্যুর নিকট বড় অসহায় আমরা। ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত শান্তিময় বাংলাদেশ আমরা কামনা করি। এটির জন্য বড় প্রয়োজন মানুষকে নির্ভরতা এবং আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এ ফারাকটুকু দ্রুত পূরণ করতে হবে। তবেই না শান্তি।

আমি চলাচলের পথে একটি ক্যামেরা বহন করি। ব্যবহারের খুব যে সুযোগ থাকে তা নয়। তবে ইচ্ছে হলে শরীর-মন ক্লান্ত থাকলেও ছবি তুলি। মিজানুর রহমানের ছবি আমার ক্যামেরায়। অফিস ফেরার পথে বলেছিলাম, ভাই আসেন, একটি ছবি তুলি। তোলা হলো। তাকে দেখানো হয়নি। আজ সবাইকে দেখাচ্ছি, আমি দেখছি, হারিয়ে যাওয়া মিজানুর রহমানকে।

আমিও হারিয়ে যাবো এবং হবো একটি মৃত।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ