কোরবানি: আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা/ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

কোরবানি: আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

কোরবানি সম্পর্কিত একটি হাদিস হলো: “যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)। সামর্থ থাকার অর্থ আমার কাছে অস্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিমানযোগে বাংলাদেশে নেয়া কোটি টাকার ‘ব্রাহমা’ প্রজাতির গরু কিনে কোরবানি করা এক ধরনের সামর্থ। ঘুষ বা অবৈধ উপায়ে অর্জন করা অর্থে ৭০/৮০ লাখ টাকা মূল্যের গরু অথবা অনুরূপ মূল্যে উট ক্রয় করে কোরবানি করাও সামর্থ। এভাবে যদি হিসাব করা হয়, তাহলে তারাই “ঈদের মাঠে” যাওয়ার প্রথম যোগ্যতা সম্পন্ন মুসলিম। তাদের যোগ্যতার ধারেকাছেও আমি কখনো পৌছবো না। অতএব, কোরবানি করতে অসামর্থ ব্যক্তি হিসেবে ঈদের মাঠে যাওয়ার ও জামাতে অংশগ্রহণের সকল যোগ্যতা আমার ছিল।
কোরবানি করার প্রথম যোগ্যতাধারীরা ছাড়াও অনেকে কোরবানি করেন। তাদের সংখ্যাই বেশি। সামর্থ নেই, এমন লোকজনও কোরবানি করেন। আমি এই শেষোক্ত দলের। যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব, আমি তাদের দলে পড়ি না। আমার স্ত্রীর সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ নেই, আমিও সমমূল্যের কোনো মালের মালিক নই, অথবা চাষের কোনো জমিও নেই। তা সত্ত্বেও আমি দেশাচার, লোকাচার, “যারা গোশত দেবে, তাদের না দিলে কেমন দেখা যায়” মর্মে স্ত্রীর তাগিদ, বন্ধুবান্ধবের অনুরোধে বা চাপে বাংলাদেশে আমার কর্মজীবনে সহকর্মীদের সঙ্গে কোরবানি দিয়েছি। কখনো একটি গরুর সাত ভাগের একটি, কখনো দুটি নিয়ে।
ঘটনা এক:
এতেও ব্যত্যয় ঘটে একবার সাতজনের একজন, যার ওপর গরু কেনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল, ঈদের পর কোরবানির মোট ব্যয়ের মধ্যে প্রত্যেকের ভাগে কত অর্থ পড়েছে, তার বিস্তারিত হিসাব ধরিয়ে দেওয়ার পর। সেই হিসাবের মধ্যে গরু কিনতে যাওয়ার দিনের যাতায়াত ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, গরু পৌছে দেওয়ার জন্য দু’জন ব্যক্তির মজুরি, খড়ের দাম ইত্যাদি। সবই সঙ্গত ব্যয়। তবে ব্যয়ের মধ্যে ৯ টাকা মূল্যের একটি রেডলিফ বলপয়েন্ট কলমের উল্লেখ ছিল। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হলো, কলমটি ছিল তার ব্যবহৃত কলম এবং গরু কিনতে গিয়ে গাবতলীর গরুর হাটে সেটি হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তওবা করলাম। এহেন ব্যক্তির সঙ্গে কোরবানি নয়।
ঘটনা দুই:
কেউ আমাকে কোরবানিতে শরীক করবেন কিনা, আমি কখনো কাউকে বলিনি। সজ্জন ব্যক্তিবর্গ, যারা আমার দৃষ্টিতে “ফেরেশতা আদমি,” তারা আমাকে ডেকে তাদের সঙ্গে শরীক করলে আমি নিজেকে ধন্য বিবেচনা করেছি। একবার তেমন একজন, যিনি বাকি ছয়জনের ইমাম, তিনি পীড়াপীড়ি করায় আমি গরু কিনতে তার সহযোগী হলাম, যা ছিল জীবনে প্রথম ও শেষবার আমার গরুর হাটে গমণ। প্রথমে তিনি নিয়ে গেলেন শাহজাহানপুর গরুর হাটে। বাজার ভর্তি গরু, একটাও তার পছন্দ হয় না। আমি বলি, “একটা কিনে ফেলেন।” তিনি বলেন, “ভালো গরু কিনব।” আমি বলি, “কোনো বছরই তো কোরবানির হাটের কোনো গরু অবিক্রিত থাকে না। এত বাছবিচারের কি প্রয়োজন?” কে শোনে কার কথা।
তার ইমামতিতে কমলাপুর গরুর হাটে যাই। এটি আরো বড় হাট। আমার কাছে গরুর হাটে যাওয়া আর কিয়ামতের ময়দানের হাজির হওয়া সমান কথা। এত গরু, তবু তার পছন্দ হয় না। সেখান থেকে মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনের গরুর হাট। এটি আকারে ছোটো এবং গরুর সংখ্যা কম। বড় হাটেই যখন তার গরু পছন্দ হয়নি, ছোটো হাটে হবে না, এটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা সঠিক। ততক্ষণে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। “ইকতাদাইতু বেহাজাল ইমাম” নিয়ত বেঁধে ফেলেছি, পালাই কি করে। তার সঙ্গে যাই ফুলবাড়িয়া গরুর হাটে। ঘন্টা ছয়েক অতিক্রান্ত হয়েছে। প্যান্টের এখানেওখানে তাজা গোবরের ছোপ, গরুর চোনার ছিটা শার্ট পর্যন্ত উঠেছে। এখানেও তার গরু পছন্দ হলো না। স্থির হলো, পরদিন গরু কেনা হবে। আমি দুই হাত জোর করে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম এবং তওবা উচ্চারণ করলাম, ভবিষ্যতে কখনো “কোরবানির খাঁটি গরু” তালাশে নামবো না।
ঘটনা তিন:
ঈদের জামাত শেষে কোরবানি করতে এসেছি। সকলে উপস্থিত। রশি পেঁচিয়ে গরুকে মাটিতে ফেলা হলো। আমিও গরুকে ঠেসে ধরেছি। গরুর গলায় ছুরি চালিয়েছেন আমাদের এক মহা মুমিন মুত্তাকি সহকর্মী। ছুরি গলার চামড়া ভেদ করতেই আমাদের সকলের শক্তি তুচ্ছ করে গরু উঠে দাঁড়াল। আমরা বিপুল বিক্রমে পুনরায় গরুকে ধরাশায়ী করলাম। কিন্তু গরুর মাথা কিছুতেই স্থির রাখা যাচ্ছিল না। কিন্তু ছুরি হাতে গরুর গলা বিদীর্ণকারী সহকর্মী গরুর মাথা ঝাপটানোর মধ্যেই এমনভাবে ছুরি চালালেন, আমি তার দিকে তাকিয়ে নিজেই স্তম্ভিত হলাম। তার দৃষ্টিতে ভয়ানক ক্রুরতা, চোখ দিয়ে যেন প্রতিহিংসার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। নিরীহ একটি পশু মানুষের কল্যাণের জন্যে তার জীবন দিচ্ছে, সেই পশুকে এমন হিংস্রতায় হত্যা করা মেনে নিতে কষ্ট হলো। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোরবানি নয়। এখনো কোরবানির কথা মনে পড়লে প্রথমে চোখে ভাসে তার প্রাণঘাতী দৃষ্টি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন।
এরপরও দেশে থাকতে কয়েকবার কোরবানি দিতে হয়েছে। হারুণ ভাই (করোনায় মারা গেছেন) আমার অনেক সিনিয়র এবং আমার শ্রদ্ধাভাজন। তিনি ব্যবসা করতেন। একবার তিনি জানতে চাইলেন, কোরবানিতে কি করছি? আমি আমার অভিজ্ঞতাগুলোর বর্ণনা করলে তিনি আমাকে কোরবানির ফজিলত শোনান, যা আমিও কমবেশি জানি। তিনি যখন নাছোড়বান্দা, তখন তাকে শর্ত দিলাম, আমার ভূমিকা হবে কেবল টাকা দেওয়া পর্যন্ত। আপনার দায়িত্বে সব করবেন। গোশতের ওপরও আমার দাবি থাকবে না, যাকে খুশি দিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি আমাকে এত ভালোবাসতেন যে, নিজ দায়িত্বে কোরবানি দিয়ে কমলাপুর থেকে মিরপুর ১১ নম্বরে আমার বাড়িতে গোশত দিয়ে যেতেন। আল্লাহ হারুন ভাইকে জান্নাতবাসী করুন।
কড়চা/ এ এইচ এম
Facebook Comments Box
ভাগ