সম্প্রীতি’র বড় দিন
রুহুল ইসলাম টিপু
বাংলার হিন্দু
বাংলার খৃষ্টান
বাংলার বৌদ্ধ
বাংলার মুসলমান
আমরা সবাই
বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের একটি পোস্টার। একসাথে আমরা সকল ধর্মের এদেশবাসী বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেই স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করি। এ শ্লোগানের বাণী আমরা হাজার বছর যাবত ধারণ, বহন এবং চর্চা করে আসছি। আমরা সকল ধর্মের মানব-মানবী গলায় গলা ধরে আত্মার আত্মীয় হয়ে বাঙালির সম্প্রীতি’র বন্ধন অটুট রেখেছি। ডিসেম্বর হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়, নব্বই এর স্বৈরশাসনের পতন, ক্রিসমাস বড় দিন। বছরের শেষ চাওয়া পাওয়া বা হারানো বেদনা’র মাসও। বছর হারানোর করুণতার সাথে ডিসেম্বর নতুন বছর পাবার উচ্ছ্বসিত আবেগ জাগিয়ে তোলে। ২৫ ডিসেম্বর খৃষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব, বড় দিন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এনজিও’তে কাজ করি গত শতাব্দীর শেষ দশক এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত। মেলামেশার সুযোগ ঘটে দেশের এবং দেশের বাইরের উন্নয়ন কর্মীদের সাথে। ক্রিসমাসের সাথে নতুন বছরের শুভেচ্ছা বিনিময় করি। গত এক দশক যাবত ক্রিসমাস উপলক্ষে একটি কেক পেয়ে থাকি। বড় দিনের উৎসবের আমিও হয়ে পড়ি অংশীজন। অফিসে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী সহকর্মীদের মাঝে মঙ্গল শুভাশীষ কামনা করে বিচিত্র ক্ষুদে বার্তা বিনিময় ঘটে। আমাদের এক সহকর্মী’র নাম রাসেল রায়। আমার ধারণা ছিল তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী হবেন। রাসেলকে একবার শারদীয় শুভেচ্ছা জানাই। তিনি বড় দিনের শুভেচ্ছা গ্রহণে আগ্রহী। এরপর হতে আমার আর ভুল হয়নি।
চার্চে খৃষ্টীয় ধর্মাবলম্বীদের সাথে অন্য সকলের সমাগম ঘটে। পোশাক, আলোকসজ্জা. খাবার, গীর্জার প্রার্থনালয় সর্বত্রই নতুনের সমারোহ ঘটে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে। রাজধানীর সড়ক হোটেল গীর্জা বাসাবাড়ি সর্বত্র দেখা যায় বড় দিনের আমেজের বহিঃপ্রকাশ। মানুষের মূল্যবোধ, যীশুর শিক্ষা ও আদর্শকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে ব্রতী হন খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী বোন এবং ভাইবৃন্দ। ২৫ ডিসেম্বর প্রভু যীশু খৃষ্টের জন্মদিন। স্মরণ করা হয় প্রভু যীশু ও মা মেরিকে। ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলনে প্রচলিত উৎসব উদযাপন করা হয়। শান্তা ক্লজ’র নিকট হতে উপহার গ্রহণ। এটি শিশুদের আনন্দের এক বিশাল অংশ। মেরি ক্রিসমাস উৎসবের নানাবিধ আয়োজনের অন্যতম হচ্ছে ক্রিসমাস ট্রি, প্রতীকি গোশালা নির্মাণ, বেলুন, বিচিত্র আলোর মেলা। বড় দিনকে কেন্দ্র করে ঘটে বানিজ্যেরও প্রসার। দেশের অর্থনৈতিক সূচককে করে সমৃদ্ধ।
গত বছর সীমিত আকারে ধর্মীয় উৎসব পালন করা হয়। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল কোভিড-১৯ নোবেল করোনা ভাইরাস। করোনার প্রকোপ এখন কম হলেও বিশ্ব পুনরায় ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্কিত। বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞায় সকল ধর্মের মানুষই উৎসব উদযাপন করেন সীমিত পরিসরে। এবার স্বাস্থ্যবিধিকে সাথে নিয়ে গীর্জায় সমাগম ঘটবে প্রার্থনার্থী নর-নারীর। করোনার কারণে অনেককে হারাতে হয়েছে। ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যের উপরও এসেছে আঘাত। কর্মক্ষেত্র এবং কর্মসংস্থানও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে। এ অবস্থায় এবারের বড় দিনের প্রার্থনা হচ্ছে চিরতরে নির্মূল হোক করোনা। ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে স্মরণীয় এবং বরণীয় আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধে খৃষ্টান বোন ভাইদের অবদানকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বিজ্ঞানী ও লেখক দ্বিজেন শর্মার একটি বই পড়েছিলাম। সেখানে তিনি তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঢাকা ছেড়ে গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জের নাগরীতে অবস্থানের বর্ণনা। খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ এবং অবদানের কথা। খৃষ্টান বোন ভাইদের প্রতি যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন দ্বিজেন শর্মা, তেমনি বাংলাদেশও তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। শাহরিয়ার কবির এর কিংবদন্তী লেখা গল্প একাত্তরের যীশু। এ গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। অনবদ্য অভিনয় দেখি হুমায়ুন ফরিদীর। ৯০ এর দশকে এ সিনেমা দেখি পিজি হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে। সাড়া জাগানো মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত মুভি। ডেসমন্ড দাদার ন্যায় খৃষ্টান সম্প্রদায়ের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ২০২১ সালের বাংলাদেশের ৫০ বছর এবং বড়দিন উপলক্ষে। বাংলাদেশের তরে আমরা যেমন বার বার স্মরণ করি ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং ২ লক্ষ মা বোনের সর্বোচ্চ বিনিময়কে। সম্প্রীতি নিয়েও আমরা হয়ে পড়ি আবেগময় এবং উল্লসিত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আঘাত তেমনি আমাদের ব্যথিতও করে। ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সংঘটিত চার্চ এবং হোটেলে বোমা হামলায় প্রায় ২৭০ জন নিহত হন। এতে শ্রীলংকার খৃষ্টান সম্প্রদায় ও স্থানীয় মানব-মানবী ছাড়াও বিদেশী নাগরিকবৃন্দও বোমা হামলার শিকার হন। দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, পর্তুগাল, ভারত, তুরস্ক, অষ্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড, জাপান, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, বাংলাদেশ, আমেরিকা এবং চীন। আমাদের দেশ থেকে যিনি নিহত হন, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকটতম আত্মীয় ছিলেন।
আমরা অসাম্প্রদায়িক এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ চাই। বড় দিন হোক অসুস্থ এবং অসহায় মানুষের রোগমুক্তি ও সহায়তার প্রার্থনা। এ উপলক্ষে মানবতা, লোভ থেকে দূরে থাকা, ত্যাগী, ক্ষমা প্রার্থনা, অবনমনতা এবং শান্তি কামনা করা হচ্ছে। আমরাও কামনা করি খৃষ্টান বোন এবং ভাই সকলে নিরাপদ, আনন্দ এবং শান্তিময় বড়দিন উদযাপন করুন। সম্প্রীতির বড় দিন হোক আমাদের গর্ব এবং অহংকারের দিবস।
কড়চা/ আর ই টি