স্বাগতম বাঙলা নববর্ষ ১৪২৯!/ রুহুল ইসলাম টিপু

স্বাগতম বাঙলা নববর্ষ ১৪২৯!

রুহুল ইসলাম টিপু

আমরা বাঙালী। ভাষা বাংলা। দেশ বাংলাদেশ। বাঙলা বর্ষ। ১৪২৮ পেরিয়ে ১৪২৯! ১৪২৮ এর শেষদিনে উদযাপন করি চৈত্র-সংক্রান্তি। সূর্যাস্তে জ্ঞাপন করি পুরোনো বর্ষের বিদায়ী অভিবাদন। রাত পোহালেই জেগে উঠি। দেখি আলোর আবির। ভোরের প্রহর। নতুন এক রবি। এসেছে বৈশাখ। বিসর্জিত বিষাদ-আঁধার। চলি সম্মুখপানে। নতুন আলোর পথে। নতুন দিন। নতুন গান। নতুন সুর। মিলনের বাণী। দেখি আগামীর স্বপ্ন। ফিরে পাই নবপ্রাণ। বিচরণ উর্ধাকাশে। ধর্ম বর্ণ জাতি লিঙ্গের ভেদাভেদহীন আমাদের দেশে। হাজার বছরের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও কৃষ্টির সাথে বাঙালী। বৈশাখী অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ নব অঙ্গীকারে আবদ্ধ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পাড়ি দিবো পুরো বছর। সারা জীবন।

দুই বছর করোনাকালে ঘরবন্দী বৈশাখ উদযাপনে আমরা ছিলাম ভারাক্রান্ত মনে। করোনা এখনও নির্মূল হয়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সারা দেশ উদযাপন করছে চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরনের নানাবিধ বিচিত্র আয়োজন। আবেগে আমরা রমনা বটতলা, চারুকলা, মুক্ত মাঠসহ দেশব্যাপী মেলা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মসূচিতে উম্মুক্ত বাতাসে ভাসবো। ভুলে যাবো না মুসলিম সম্প্রদায় পালন করছে ধর্মীয় মাস রমজান। সিয়াম সালাতসহ ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনে আমরা থাকবো সচেষ্ট। শ্রদ্ধা থাকবে সকল ধর্মের মানুষের প্রতি। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। বৈশাখ বাঙলা নববর্ষ সার্বজনীন উৎসব। আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট সড়ক দ্বীপ হতে টিএসসি পর্যন্ত মঙ্গলশোভাযাত্রার আয়োজন করে। এতে শিল্পী শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রী সর্বসাধারণ অংশগ্রহণ করেন।

বাঙালির চৈত্র-সংক্রান্তি এবং বৈশাখী সংস্কৃতির কলেবরের গভীরতা ও ব্যাপকতা আজ বিশ^কে স্মম্ভিত বিস্মিত করছে। ১৯৬৭ সাল হতে ছায়ানট রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সময় সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৈরী পরিবেশের কারণে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়নি। ২০০১ সালে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতেও থেমে যায়নি বা কমতি ঘটেনি ছায়ানট এর বর্ষবরণ আয়োজনের আবেদন ও এর উৎকর্ষতা। ছায়ানটের বৈশাখী আয়োজনের সাথে আরও ব্যাপকভাবে সর্বসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়তেই থাকে। বাঙালী সংস্কৃতি হচ্ছে এদেশের মানুষের মনন ও জীবন।

সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী আমরা চৈত্র সংক্রান্তি এবং বৈশাখী আয়োজনে অংশগ্রহণ করি। একইসাথে প্রাণপণ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করি। কৃষি অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। আমরা কৃষি পরিবারের সন্তান। কৃষি এবং কৃষকের সাথে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কৃষির উপর বিনির্মিত। এখনও খাজনা ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয় বৈশাখ- চৈত্র বছর হিসাব করে। হালখাতা শুরু হয় পয়লা বৈশাখ। আজও হাট বাজার গঞ্জ শহরে লাল লম্বা হাল মানে নতুন খাতার প্রচলন রয়েছে। হাসিমুখে দোকানদার আপ্যায়ন করেন ক্রেতা দেনাদারদেরকে। পাওনাদার দোকানদার থেকে কতটুকু পেলেন বা না পেলেন সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। সম্পর্ক এবং আতিথেয়তা এখানে মূখ্য উপজীব্য। এটি বাঙালীয়ানার ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ঈর্ষনীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের নেপথ্যে বৈশাখীর এ বাজারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এবার করোনার পর বৈশাখী অর্থনীতির পালে বেশ হাওয়া লাগিয়েছে- এটি আমরা উপলব্ধি করছি। ফ্যাশন প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ফ্যাশন উদ্যোক্তা সমিতি (এফইএবি বা ফ্যাশন উদ্যোগ) ২০১২ সালে একটি জরিপ করে। সে তথ্য অনুযায়ী দেশের ফ্যাশন হাউসে সারা বছর ৬ হাজার কোটি টাকার বেচাকানা হয়। এর মধ্যে ৫০ শতাংশই হয় রোজার ঈদে। ২৫ শতাংশ হয় পয়লা বৈশাখ। বাকিটা সারা বছর। ১০ বছরে এ সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ১৩ এপ্রিল ২০২২ এর প্রথম আলো হতে এ খবরটি পাওয়া যায়। এ বছর বৈশাখ এবং রোজার ঈদ প্রায় একই সময়ে হচ্ছে। সঙ্গত:কারণেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ আশাবাদী। করোনাকালীন সময়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন। মৃৎশিল্পীদের জন্যও আশা জাগানিয়া হবে এবারের পয়লা বৈশাখ এবং ঈদ।

আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায় মিলেমিশে প্রিয় বাংলাদেশে বাস করি। চৈত্র-সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দু’বছর পর কোথাও কোথাও আবার হতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী চরক পূজা। মানুষ চরকে ঘুরেন। পিঠে বর্শি বেঁধে। চলে পূজা অর্চনা। সাথে মেলা। চৈত্রে পূণ্য স্নানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলার আয়োজন করা হয়। মানিকগঞ্জের আরিচায় ঐতিহ্যবাহী পূণ্য স্নানকে কেন্দ্র করে মেলা হয়। বেউথায় কালিগঙ্গা নদীতে পূণ্য স্নানের অন্যতম একটি বাৎসরিক নিয়মিত আয়োজন সম্পন্ন হয়। পাহাড়ী আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী কর্তৃক বৈসাবি উৎসবের আয়োজন হয়। বৈসাবি আয়োজনকে কেন্দ্র করে পর্যটন বিকাশেও সমৃদ্ধি ঘটে। ঘুড্ডি মেলাও এ সময় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। মানিকগঞ্জের ঝিটকার পোদ্দার বাড়িতে নিয়মিত এ আয়োজন হয়ে থাকে। এর উদ্যোক্তা প্রয়াত সাংস্কৃতিক যোদ্ধা শিক্ষক রঞ্জন সাহাকে স্মরণ করি।

টমটম টেপা পুতুলের মন খারাপ কিছুটা কমেছে। দুই বছর বিক্রি হয়নি। আশা করা যাচ্ছে টমটম টেপা পুতুলের হাত বদল হবে। কুমার পাড়ায় ব্যস্ততা বাড়বে। দেশবাসী এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাবৃন্দের মুখে হাসি দেখতে পাবেন। শখের হাঁড়ির পোড়া কপালের ভাগ্য প্রসন্ন হবে এবছর। হাঁড়ির সাথে রয়েছে পঞ্চসাঞ্জি, দৃষ্টি নন্দন মাটির পুতুল। কেনা বেঁচা বৃদ্ধিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। বাঙালীর জীবন, আনন্দ-বেদনা এবং চিন্তা চেতনার সাথে শখের পুতুলসহ এসব তৈজসপত্র একাকার হয়ে মিশে আছে।

খাগড়াছড়িতে সাংগ্রাইং উৎসবে মাতোয়ারা মারমারা। বঙ্গাব্দের একদিন পর থেকে মঘাব্দ গণনা করা হয়। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন শেষে বের করা হয় শোভাযাত্রা। মারমা সম্প্রদায় ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের সঙ্গে সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সাংগ্রাইং উৎসবে জলকেলীতে অংশগ্রহণ করেন মারমা সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ। জলকেলির মাধ্যমে পুরনো বছরের দুঃখ, কষ্টকে মুছে দিয়ে নতুন বছর সুন্দরভাবে শুরু করা হয়। এ সম্প্রদায়ের মানুষ সারা বছর দিনটির জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। সাংগ্রাইং মারমা’র ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। এখন এটি আনন্দঘন সামাজিক উৎসবে রূপ গ্রহণ করেছে। ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায়ও নববর্ষের উৎসবে সামিল হোন। পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। গিলা খেলার উৎসবে এ সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকের ঘরে বিভিন্ন রকমের সবজি (পাঁচন) একসঙ্গে রান্না করা হয়। একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করেন। নতুন করে ঘর সাজানো হয়। যার যার সংস্কৃতি অনুযায়ী নতুন পোশাক পরার প্রচলন রয়েছে। লালমাই পাহাড়ে বর্ণিল বৈসু উৎসব। কুমিল্লার লালমাই পাহাড় এলাকায় ত্রিপুরা সম্প্রদায় এ উৎসবে মেতে উঠে বৈশাখীকে কেন্দ্র করে। হরেক রকম পোশাক পরে নিজেদের সাজিয়ে বৈসু উৎসবে অংশ নেন এ সম্প্রদায়। চৈত্রের শেষ দিন ফুল ভাসিয়ে, আনন্দ র‌্যালি, গান নুপুরের ছন্দে নেচে নেচে তরুণ তরুণীরা মেতে উঠেন। আপ্যায়নে রাখেন লুচি ও নানান রকমের মিষ্টিজাতীয় খাবার। দিন কাটে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। ঘরে ঘরে নারায়ন পূজার আয়োজন করা হয়। রাঙ্গামাটিতে চাকমা সম্প্রদায় আয়োজন করে বিজু উৎসব। এর মধ্য দিয়ে বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হয়। অতীতের গ্লানি মুছা, সবার মাঝে শান্তি বিরাজের প্রার্থনা করা হয়। কাপ্তাই হ্রদে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ফুল ভাসাতে জড়ো হন পাহাড়ের তরুণ-তরুণীরা। ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয় নতুন বছরকে। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মানিকগঞ্জ জেলা সংসদ; জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ এবং খেলাঘর ‘জাগো বাঙালির সংস্কৃতি-রুখে দাঁড়াও সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক মঙ্গল শোভাযাত্রা ও প্রতিবাদী সমাবেশ পয়লা বৈশাখ প্রেসক্লাব চত্বর মানিকগঞ্জ শহরে আয়োজন করা হয়।

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে বিগত বাংলা বর্ষে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়। ১৪২৮ বঙ্গাব্দে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজায় হতাহতের ঘটনা সংঘটিত হয়। ০১ এপ্রিল পুলিশ সদস্য একজন শিক্ষিকার টিপ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের ঘটনাটি ছিল ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজে যাওয়ার দিকে সেজান পয়েন্টের সামনে। এ ঘটনা অবিশ্বাস্য, অগ্রহণযোগ্য, বে-আইনি এবং আধুনিক চিন্তা ভাবনার পরিপন্থী। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল ১৯ দিন পর জামিনে মুক্তি পান। এসব ঘটনা সংবাদপত্র মিডিয়াতে চলে আসছে হর হামেশাই। অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন মহান সংবিধান পরিপন্থী ঘটনাসমূহ আজ নাগরিক সমাজকে বিচলিত করছে। দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত।

বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খৃষ্টান, বাংলার মুসলমান মুক্তিযুদ্ধে যে বাংলাদেশ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। আমরা এ জায়গায় আজ বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করছি। শিক্ষা এবং সার্বজনীন সংস্কৃতির বড়ই অভাব। বিভিন্নমূখী শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার বেশ তারতম্য; এমন কি ঘাটতিও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এদিকে সকলকে জোরালো দৃষ্টি দিতে হবে। ইতিহাস ঐহিত্যকে তৃণমূল পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বস্তরে শিশুদের মাঝে চর্চার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

অভিনয় শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী এবং তাঁর মায়ের সিদুঁর পড়া ও কপালে টিপের ঘটনা দেশবাসী দেখেছেন। ১১ মে ২০২১ প্রথম আলো, ‘হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের প্রোফাইল পিকচার বদলে গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে চঞ্চল চৌধুরী ও তাঁর মায়ের ছবি। মা দিবসে প্রকাশ। ওই পোস্টের কমেন্ট বক্সে কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারী সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন। পরে চঞ্চল চৌধুরী সেসব মন্তব্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন, ভাই ও বোনেরা, আমি কোন ধর্মের, তাতে কী আসে যায়? সবারই সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে ‘মানুষ’। ধর্ম নিয়ে সব রুচিহীন প্রশ্ন ও বিব্রতকর আলোচনা বন্ধ হোক। আসুন, সবাই মানুষ হই।’

চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখীর অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন চেতনার শিক্ষা হোক- আমরা মানুষ। স্বাগতম বাঙলা নববর্ষ ১৪২৯!

ছবিঃ আব্দুর রাজ্জাক

কড়চা/ আর আই টি

 

 

 

Facebook Comments Box
ভাগ