ইতিহাসের অলিগলি

আবুল ইসলাম শিকদার

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩/৪ তারিখ হবে হয়তো। তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুল বন্ধ হয়েছে মার্চ মাসের ২৫ তারিখের পর থেকেই। যদিও আমাদের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান সাহেব স্কুল চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি গিয়ে তা পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেল।

চারিদিকে যুদ্ধের আতঙ্ক, মৃত্যুর ভয় এবং দুশ্চিন্তা মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ হেমন্ত পাড়ি দিয়ে শীতে এসে ঠেকেছে। প্রতিটি ঋতুতে যুদ্ধের কৌশল এবং প্রকৃতি যেমন আলাদা হয়েছে, আমাদের আত্মরক্ষার কৌশলও তেমনি পরিবর্তিত হয়েছে। সারাটা বর্ষায় ঘাটের নৌকায় দিগ্বিদিক আমরা ছুটে বেড়িয়েছি। আজ এ আত্মীয়ের বাড়ী, কাল আর এক আত্মীয়র বাড়িতে। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনরাও খুব নিরাপদে ছিলেন না। তবে আমাদের দু তিন ঘর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটু নিরাপদেই ছিলেন। বেশ কিছুদিন সেসব বাড়িতে কাটিয়ে শুকনো মৌসুমে আমরা মরি-বাঁচি করে সবাই বাড়িতেই আশ্রয় গ্রহণ করলাম। যদিও বাড়ির কাছে বালিরটেক বাজারে পাক মিলিটারি ক্যাম্প থাকায় আমরা প্রায় প্রতিদিনই একবার করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছি, আবার ফিরে এসেছি। এমনি করেই ভয় আতঙ্ক দ্বিধা এবং মৃত্যুর সাথে লড়াই করে করে ডিসেম্বর মাসে চারদিকে কিছুটা স্বস্তির আভাস পেলাম।

এইযে ভয়-ভীতি, এরমধ্যেই আমাদের হাল খামার, শস্য উৎপাদন, গরু বাছুর পালন, কোন কিছুই কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বাড়ির রাখাল চাকর যারা ছিল তারাও আমাদের বিপদের বন্ধু হয়ে সবসময়ই সাথে থেকেছে। আজকাল হয়তো অমন করে কেউ জীবন মরণের সঙ্গী হবে না।

আমাদের বাড়িতে গৃহস্থালি ছিল একটু বড় ধরনেরই। বেশ কয়েকটি গাভী ছিল। সেগুলোর দুধ আমরা বাজারে বিক্রি করতাম। আমরা তিন ভাই বলতে গেলে একসাথেই বড় হয়েছি। আমার আব্বা হাট-বাজার একটু কম করতেন। মূলত আমার দাদাই হাট-বাজার করতেন। আর সেই বৃদ্ধকে যোগান দিতে হতো আমাদের তিন ভাইয়ের।

এসব কাজকর্ম আমরা যে সবসময়ই খুব হাসি মুখে করতাম তা নয়। মাঝে মাঝে সেই বৃদ্ধের সাথে আমাদের অনেক তর্ক-বিতর্ক,ঝগড়াঝাটি হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা কেউ না কেউ তার সঙ্গী হতে বাধ্য হয়েছি। কারণ সে ছিল আমাদের ছাতার মতো। আমাদের অন্নবস্ত্র,আমাদের চিকিৎসা, লেখাপড়া সবকিছুর যোগান আসতো এই বৃদ্ধের স্যুটকেস থেকেই। বাইরে বাইরে আমাদের দাদাজান ছিলেন খুবই রাগী মানুষ, কিন্তু তার ভেতরটা ছিল শামুকের মতই নরম। আমাদের জন্য যা কিছু করা সম্ভব সবই তিনি করেছেন। কাজেই তার হুকুম অমান্য করা আমাদের পক্ষে অনেক সময়ই সম্ভব হয়নি।

দুধ বিক্রির দায়িত্ব আমরা ভাইয়েরা পালাক্রমে পালন করতাম। এখনকার মতো তখন এসব কাজ আমাদেরকে অতটা প্রেস্টিজ বোধে আক্রান্ত করেনি। যদিও বাজারে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হয়েছে, তথাপি এর জন্য আমরা খুব বেশী লজ্জা বোধ করিনি। কেননা তখন প্রায় সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরই ঘরে বাইরে কিছু না কিছু কাজকর্ম করতে হতো।

যাহোক সেদিন দুধ বিক্রির দায়িত্ব ছিল আমার। মাটির পাত্র যেটাকে আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় দোনা। দু-তিনটি দোনায় দুধ নিয়ে বাজারে গিয়েছি। বাজারে তো কেবল একটাই আলোচনা। যুদ্ধের আলোচনা। তখনও ভারত স্বীকৃতি দেয়নি। তবে যুদ্ধের অবস্থা যে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে তা সবার আলোচনা থেকে বুঝতে পারছিলাম।

জটলা পাকিয়ে পাকিয়ে মানুষ আলোচনা করছে। বাজারে গিয়ে কখনোই বেচাকেনায় খুব বেশি দেরি করার অভ্যেস আমার ছোটবেলা থেকেই নেই। তাড়াতাড়ি দুধ বিক্রি করে ঘুরে ঘুরে মানুষের এসব আলোচনা শুনছিলাম এবং গিলছিলাম।

এক জায়গায় একজন বলছে,পাকিস্তানের আর্মি যার নাম, এরা কোনদিনই হারবে না। এরপর সে বলল,পাকিস্তানের ক্যাম্পে মাটির নিচে নাকি এক ধরনের সৈন্য আছে,তারা কোন ভাষা বোঝে না,তারা শুধু মানুষ মারা জানে। তাদেরকে কখনো বাইরে বের করা হয় না,যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদেরকে বের করা হবে। এসব কথা শুনে ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সত্যি যদি এরকম মানুষ মারা বর্বর আর্মি বেরিয়ে আসে তাহলে তো আর কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না।

আরেকজন বলছিলেন, আরে দেখো না,এই ভারত আসলো বলে। পাকিস্তানের বারোটা বাজাইয়া দিব্যানে।

তখন আবার মনে কিছুটা সাহস হল। মনে হল কালকের সূর্যটাও হয়তো দেখব। এমনি করেই এলোমেলো আলোচনা অনেকক্ষণ ধরে শুনছিলাম।

হঠাৎ করেই আমার চোখের সামনে বিদ্যুতের মতো একটি ঘটনা ঘটে গেল। বাজারের ভেতরে মূলত মাঝখান দিয়ে রাস্তা রেখে দুই পাশে লোকজন দুধ মাছ শাকসবজি ইত্যাদি নিয়ে বসে। মাঝখান দিয়ে ক্রেতাদের আসা যাওয়া, কেনাকাটার জন্য ফাঁকা রাখা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই বিদ্যুৎ গতিতে রাস্তার দুই পাশে সরে যেতে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি প্রথম কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তা পিছন দিক করে। রাস্তার দিকে তাকাতেই দেখি ১০/১২ জন মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার মাঝখান দিয়ে। তাদের পরনে লুঙ্গি। সে লুঙ্গি আবার উল্টিয়ে গেরো দিয়ে খাটো করে পড়া। গায়ের চাদর কোমরে প্যাঁচানো। হাতে পায়ে কাদা মাটি লেগে আছে। সবাই প্রায় খালি পায়ে। তখন তো আর পাকা রাস্তা ঘাট ছিল না, মানুষ খালি পায়েই বেশি চলতো।তাদের সবার কাঁধে অস্ত্র। সবাই হাঁসফাঁস করে বলছে, মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা।

বিস্ময়ে আমার শরীর কাঁপছিল। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের চার পাশেই আছে সে কথা সকলেই জানি। কিন্তু এমনি করেই অস্ত্র হাতে আমারই চোখের সামনে সেই মুক্তিযুদ্ধাদের দেখতে পাবো এমন কথা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। তারা বিদ্যুৎ গতিতে বাজার অতিক্রম করছিল।

কিন্তু আমার জন্য যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তা কে জানত। আমি সেই সারিবদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ করেই আমার দৃষ্টি পড়ল মাঝখানের একজনের উপর। কে সে? সে আর কেউ নয়, সে আমারই মিয়া ভাই। কোমরে চাদর পেঁচানো,কাঁধে রাইফেল এক গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা আমার মিয়া ভাই। মিয়া ভাইয়ের কথা শুনেছি, সে রাতে রাতে ট্রেনিং করে কিন্তু তাকে এই বেশে দেখবো তা ভাবতে পারিনি। আমার ঘোর আর বিস্ময়ের মাত্রা কাটে না।
মিয়া ভাই আমাকে দেখেনি। দেখার কথাও নয়। সে কে? আর আমি কে? তিনি হচ্ছেন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গে অনুপ্রাণিত এক গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা,আর আমি হচ্ছি সামান্য একজন দুধ বিক্রেতা। কোথায় মিয়া ভাই আর কোথায় আমি। একবার গলা ছেড়ে ডাকতে চাইলাম, কিন্তু আমার কন্ঠ কে যেন চেপে ধরল। কিছুতেই ডাকতে পারলাম না। মিয়া ভাইয়ের সাথে আমার কোন কথাই হল না, কিন্তু গর্বে, অহংকারে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার নিজের অজান্তেই অঝোর ধারায় আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।

আমি জানিনা সেখানে আর কারো মিয়াভাই ছিল কিনা। থাকলে তারাও হয়তো আমার মতই কেঁদেছেন। বিস্ময় গর্ব এবং ঘটনার আকস্মিকতা, সব মিলিয়ে আমি যেন কেমন উন্মাদনা বোধ করছিলাম। অনেকটা টলতে-টলতে বাড়ি ফিরে এলাম।

মিয়া ভাই তার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট হারিয়ে ফেলেছেন। এজন্য দীর্ঘদিন তার তেমন কোন দুঃখ ছিল না। দুঃখ করেন ইদানিং। যখন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের ধারে পাশে না গিয়েও সার্টিফিকেট নিয়ে অনেক সুবিধা রাষ্ট্র এবং সমাজের কাছ থেকে পাচ্ছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মিয়া ভাই অনেক চেষ্টা-তদবির করেও পরে আর মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট তুলতে পারেননি। ইদানিং ওসব নিয়ে দুঃখ করাও ছেড়ে দিয়েছেন।

আবুল ইসলাম শিকদারঃ সভাপতি, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, মানিকগঞ্জ এবং সাবেক অধ্যক্ষ, মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।

Facebook Comments Box
ভাগ