আমাদের মোজাফফর : একসাথে অর্ধেক জীবন
মধুসূদন সাহা
জীবনের বার্ধক্য বেলায় পিছনে তাকালে অনেক স্মৃতির পাহাড় মনকে চনমনে করে দেয়। বেশিরভাগ অস্বীকার করলেও কিছু কিছুতেই পিছন ছাড়ে না। টেনে নিয়ে যায় অতল গহ্বরে। সেখানে হাবুডুবু খেয়ে উপরে উঠি, তখন নিজেকে আর এই সময়ের মনে হয় না। মনে না থাকা নানান ঘটনাও মনের কোনায় ভিড় করে। তেমনি দুই চারটা কথা নিয়ে উপরোক্ত শিরোনামে আমার কথকতা।
রক্তের সম্পর্ককে পিছনে ফেলে আমার জীবনে যে কিছু আত্ত্বিক সম্পর্কের বলয় গড়ে তুলেছিলাম যা আজীবন জীবনকে আলোড়িত করে যাচ্ছে তার অন্যতম হচ্ছে এই মোজাফফর রহমান চৌধুরী। শিরোনামটা এরকমও হতে পারত, আমার জীবন ও মোজাফফর রহমান চৌধুরী। কিন্তু একটু উঁচু মার্গের কমিউনিস্ট ফ্লেভার খুঁজত শিরোনামে অনেকেই। তাই কৌলিন্যহীন এই সাদা মাটা উপস্থাপনা। এখান থেকে আমি মোজাফফর রহমান চৌধুরীর বদলে শুধু জাফর ব্যবহার করব। যা ওর ও ওর পরিবারের প্রিয় সম্বোধন। অকাল প্রয়াণের পর ও এই নামেই এখনও বেঁচে আছে।
১৯৭৮/৭৯ সাল। দেবেন্দ্র কলেজে চুটিয়ে সম্মুখ সারির ছাত্র রাজনীতি করি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হলেও জাসদ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত ছিলাম। শিক্ষা জীবনের সহপাঠি ছাড়াও ঐ সময় থেকে প্রায় ২০০০ সন পর্যন্ত অনেক অনেক মানুষের সাথে রাজনীতি ও কর্মসূত্রে একটা বিরাট বলয় জীবনে গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। যা জীবনকে বিচিত্র ও জ্ঞান ভান্ডারকে সম্বৃদ্ধ করেছে। কিছু ভুলে গেলেও তাদের অনেকেই শেষ বেলায় স্মৃতির মনি কোঠায় উজ্জ্বল। কেউ আছেন, কেউ নেই। কারুর কারুর কাছে ভালবাসার ঋনে আকূন্ঠ নিমজ্জিত। সেরকম আমাদের/আমার জাফর।
১৯৭৯ সনে দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে নড়বড়ে অথচ ইস্পাত দৃঢ় ছাএ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মনোনয়নে আমি ও জাফর নিবীর-যীশু পরিষদে যথাক্রমে ক্রীড়াা সম্পাদক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি। নিশ্চিত হার জেনেও সাংগঠনিক দৃঢ়তা রক্ষায় আমাদের অংশগ্রহণ। জাফর সম্ভবত ইকবাল ভাইয়ের রিক্রুটিং ছিল। সেই পরিচয়ের সূত্রপাত।
সেই থেকে ওর মৃত্যু (২০১৭) পর্যন্ত সম্পর্কের গতি সরলরৈখিক না থাকলেও অন্তরের গভীরে দু’জনেই লালন করেছি। করে যাচ্ছি। সামনের আলোচনায় উঠে আসবে আমাদের সম্পর্ক কিভাবে এত আত্ত্বিক হয়েছে।
বয়সে ও ক্লাসে ও আমার এক বছরের ছোট। আপনি তুমির লৌকিক সম্পর্ক। সেটাই একসময় সমস্ত কিছু অতিক্রম করে সম্পর্কের ব্যাকরণকে অপ্রয়োজনীয় করেছে। দেবেন্দ্র কলেজে আমার শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক হলেও আমার অবস্থান ছিল প্রায় চার বছরের। দুই বছর উচ্চ মাধ্যমিক, একবছর বিএসসি ও একবছর ভবঘুরে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স ও মাস্টার্স লোকপ্রশাসনে। তো কলেজ জীবনেই ওর সাথে আমার চার বছরের সম্পর্ক। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নিয়মিত মানিকগঞ্জ জাসদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ আমার রুটিন ছিল। জাফরও আসত। অনেক সময় লোকজন নিয়ে।
তাই শান্ত স্বভাবের সুদর্শন জাফরের সাথে আমার আত্ত্বিক সম্পর্ক তৈরি হতে খুব সময় নেয়নি। এভাবেই চলতে ছিল। সম্পর্কের ষোলকলা পূর্ণ হয় ১৯৮৮ সনের দিকে। মানিকগঞ্জ এসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল সার্ভিস-ম্যাস এর কার্যালয়ে। খল্লী, ধানকোড়া, সাটুরিয়া। একটু বিস্তারিত বলা দরকার।
ম্যাস একটা এনজিও ছিল। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনায় ছিলেন সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক মজিবুর রহমান। তাছাড়া বাম রাজনীতির বলয়ে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা জাসদের সক্রিয় সাধারণ সম্পাদক। আর ছিল ম্যাসের মাধ্যমে একটা সমাজ সেবার বলয়। জ্ঞান ও কর্মে তিনি ছিলেন মহান। এক সময় রাজনীতির বলয়ের কর্মীদের তিনি ব্যাপক কর্মসংস্থান দিয়েছেন। পালন করেছেন অনেক সামাজিক দায়িত্ব। ভবিষৎ-এ অধ্যাপক মজিবুর রহমানের উপর বিস্তারিত উপস্থাপনার আশা রেখে জাফরের কথায় ফিরে আসি।

১৯৮৮ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নেওয়ার পর বাড়ি থেকে জীবিকার চাপ আসে। নিজের সেরকম কোন লক্ষ্য ছিল না। শিক্ষা জীবনের মোহ আমাকে আপ্লুত করে রেখেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দৈন্যদশা ও জীবিকার তাড়নায় স্যারের অনুরোধে ১৯৮৮ সনে ম্যাসে যোগদান করি। বাইসাইকেল চালিয়ে একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে। আমাদের ছন্নছাড়া জীবনের মত ম্যাসে নিয়োগে কোন আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। ধানকোড়া ম্যাস অফিসে গেলাম মাসিক সভায়। জাফর তখন ম্যাসের ক্যাম্প ইনচার্জ। স্যার দায়িত্ব দিলেন মানিকগঞ্জের বালিরটেকে খেয়া ঘাটের পাশে গুচ্ছগ্রাম তৈরির দায়িত্বে। বছরব্যপী সেখানে দায়িত্ব পালন করতাম আর ধানকোড়া অফিসে জাফরের সাথে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতাম। শুরুতেই ও আমাকে একদম হৃদয়ের মধ্যে ধারন করেছিল। সেখান থেকেই ওর ভালবাসার ঋন জমা হয় আমার জীবনে। সে চাকুরি আমাদের জীবনে কোন আর্থিক সুবাতাস বইয়ে দেয়নি সত্য, কিন্তু গ্রামীণ জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি সহ সমাজ জীবনের বৈচিত্রতার একটা বিরাট অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করতে পেরেছি বলেই আমার বিশ্বাস। আর এ বিষয়ে আমার পথপ্রদর্শক ছিল জাফর। দেখুন একজন এনজিও কর্মী যে পদেরই হোক, ধারণা অনুযায়ী তিনি একজন উন্নয়ন কর্মী। অবশ্যই সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। প্রয়োজন টার্গেট people এর সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা। আর motivation power/capacity. আমি নিশ্চিতভাবে জানি এর সমস্ত কিছুই জাফরের আত্মস্থ ছিল। যা একজন সমাজ বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেও বিরল। উপরোক্ত বিষয়ে আমার জীবনে ওর প্রভাব এখনও সুস্পষ্ট। যে জন্য মন সব সময় ওকে খুঁজে ফেরে।
ঐ সময় ম্যাসে জাফর, আমি ছাড়াও সাটুরিয়ার বাসিন্দা হিসাব রক্ষক মতিউর রহমান, মজিবুর মোল্লা, আওলাদ হোসেন প্রমুখেরা ছিল। আর ছিল শিউলি। মোটেও সাদামাটা না কিন্তু। জাফরের মত ও আমার ছোট বোন হিসেবে আর এক অর্জন। এখানে ওর উল্লেখে কিছুই বলা হবে না। ভবিষ্যত একটা পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় ওকে উপস্থাপনের আশা রাখি।
এরপর ম্যাসের কার্যক্রম ব্যপক বিস্তার লাভ করে। যোগ হয় জাসদ নেতা সামছুল আলম খান, হায়দার আলী, রতন দত্ত সহ প্রায় চল্লিশ জনের বাহিনী। এটা মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া, দৌলতপুর, শিবালয়, রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া আর টাংগাইলের নাগরপুর উপজেলায় বিস্তৃত হয়। প্রধান অফিস হয় শিবালয়ের টেপড়া। তিন জেলার পাঁচ উপজেলা। প্রতি উপজেলায় ছয়টি করে ইউনিয়ন। জাফর নাগরপুরে উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে ৬ জন কর্মী ও নিজস্ব অফিস ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ শুরু করে। টেপড়া প্রধান কার্যালয়ে থেকে পাঁচটা উপজেলায় কর্মসূচি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পড়ে আমার উপর সমন্বয়কারী (Field coordinator) হিসেবে। এই কাঠামো শুরু হয় ১৯৯০ সনে। ৫ বছরের প্রকল্প। হেড অফিসে প্রতিমাসে উন্নয়ন কর্মকর্তাগণ, আমি, হিসাব রক্ষক ও স্যার মিলে মাসিক সভা হত। এই অফিসে হিসাব রক্ষক ছাড়াও একজন অফিস অ্যাসিস্টেন্ট ও দুই জন পিয়ন ছিল।

তো এই গ্রকল্প বাস্তবায়নে আমার সাহায্যকারী ও পরামর্শদাতা ছিল অতীত অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ জাফর। অফিসের প্রশাসনিক কাঠামো আমাদের মধ্যে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমাদের দুই জনের সম্পর্ক ছিল ভাই, বন্ধু ও আত্মীয়ের মত। আমার মায়ের খুব প্রিয় পাত্র ছিল ও। তাছাড়া আমার সব পরিচিত ও আত্মীয় স্বজনের সাথে ওরও আত্মিক সম্পর্ক ছিল। যেমন ছিল আমার। ওর মামা বাড়ি যেমন আমার যাতায়াত ছিল ও তেমনি আমার মামা বাড়িও যেত। ওর ভাইদের সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। ওর মামাতো ভাই, বোনের সাথে আমারও আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ওর মামাতো বোন রাজধানীর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লাকীর সাথে এখনও আমার সুসম্পর্ক। মিস করি এখনও ওর বেহেশতবাসী আরেক মামাতো বোনকে। তার পিচ্ছি ছেলে দুটির সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। এরকম স্মৃতিচারণ একটা বই হয়ে যাবে।
একজন এনজিও কর্মকর্তা হিসেবে মোজাফফর এর যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। স্থানীয় প্রশাসন, এলিট, এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন এনজিও’র সাথে ওর ছিল খুবই সুসম্পর্ক। যা আমাদের দাযয়িত্বের মধ্যে পড়ত। পথঘাট চেনায় ওর জুড়ি মেলা ভার। যা গ্রামীণ অবকাঠামোয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ও ছিল ধামরাইয়ের ফুল তারার সম্ভ্রান্ত জোতদার পরিবারের ছেলে। টাকা পয়সার প্রতি খুব একটা মোহ ছিল না। নিজের ও আমার সম্মানের প্রতি খুব স্পর্শকাতর ছিল। এলাকায় আমাদের শিক্ষা, যোগ্যতা, বেতন ও অন্যান্য ব্যাপারে ওর গল্পের গরু গাছে চড়ত। এ বিষয়ে আগে থেকেই ও আমাকে সতর্ক করে রাখত। ব্র্যাক, প্রশিকার মত এনজিও যাদের ধারে কাছে আমরা ছিলাম না তারাও মোজাফফর এর উপস্থাপনায় আমাদের সমীহের চোখে দেখত।
নাগরপুরে আমার এক কাছের বন্ধু আছে। বর্তমানে সমাজসেবক ও স্থানীয় এমপি’র উপদেষ্টা, নাগরপুর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা স্বপন সাহা। সেজন্যই আমাদের প্রকল্পে নাগরপুর উপজেলা আমার নির্বাচন। প্রকল্পের অন্যন্য উপজেলায় আমার যাতায়াত রুটিন মাফিক ছিল। কিন্তু উপরোক্ত কারণে নাগরপুর যাতায়াত আমার কাছে জলভাত ছিল। শিক্ষা জীবন থেকেই। বর্ষায় নাগরপুর যেতে ররংগাইল থেকে সতেরটি খেয়া পার হতে হত। আজকে তো ৪০/৫০ মিনিটের পথ। তবুও কারণে অকারণে নাগরপুর যাওয়া থেকে বিরত হইনি। আমার আতিথেয়তা সেটা এই পটভূমিতে উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।
জাফর ছিল খুব উচ্চ মানের উন্নয়ন কর্মকর্তা। সুইডেনের দাতা সংস্থা ডিয়াকোনিয়ার থেকে আমরা ছিলাম প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রশিক্ষক। মোজাফফর খুব উচ্চ মানের প্রশিক্ষক ছিল। অন্য সংস্থার কর্মী ও উপকার ভোগীদেরও অনেক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অনেক বিদেশী টিমকে ফেস করেছে। নিজেও অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ওর সদা হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর মুখশ্রী ও উপস্থাপনা সবার মন জয় করে সমাজে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার জন্য জাফর সকলের প্রিয় ও মৃত্যুঞ্জয়ী।
এবার কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। প্রকল্প চলাকালীন আমরা দুইজনেই ছিলাম ব্যাচেলার। আর এ সম্পর্কিত সকল কিছু ওর আমার দ্বিপাক্ষিক হলেও কিছু শেয়ার করাই যায়।
আমার বিয়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক এর মিশেল। ওর কাজ ছিল এলাকায় হিন্দু মেয়ের খোঁজ পেলেই আমাকে মেয়ে বা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। গুনে বলা যাবে না। এর মধ্যে চায়ের দোকান করা পরিবার যেমন ছিল, তেমনি ইটখোলার মালিকের পরিবারও ছিল। প্রচুর পরিবারের সাথে এরকম যোগাযোগ। এরপর নাগরপুর একসময় আমার জন্য বিব্রতকর হয়ে গেল। তারপরও ও থেমে থাকেনি। আর যোগ্যতা, বেতন ও ম্যাস সম্পর্কে ওর গল্পের গরু গাছে চড়া সম্পর্কে তো আগেই বলেছি। সে হিসেবে ওরও একটা বিরাট চাহিদা ছিল অনেক মেয়ের অভিভাবকদের মনে। ওর প্রচেষ্টায় প্রাচীন কালের রাজপুত্রের মত অবস্থা হয়েছিল আমাদের দুজনের। এসমস্ত ক্ষেত্রে ওর motivation power এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সাধে কি আর গাঙ সাঁতরিয়ে আমি ওপার যেতাম। মানে সতেরটি খেয়া পার হয়ে নাগরপুর। তবে এটা ওর একদিক। অন্যদিকে ওর প্রকল্পের কাজ ছিল আমাদের পাঁচ উপজেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আগেই বলেছি এনজিও-তে ওর দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।
একবার মধুপুরে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকা। কিছু কান কথা নিয়ে সমস্যা বাঁধল। জাফর জানার পর বাইক নিয়ে সোজা মধুপুর কলেজের অধ্যাপকদের সাথে কথা বলল। মেয়েটা কলেজে পড়ত। এসে জানালো দাদা, বিপদজনক, এখানে হবেনা। এই হলো আমার জীবনে মোজাফফর। এরকম কত ব্যক্তিগত উপকারের ঋনে ও আমাকে আবদ্ধ করে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।
একবার সাটুরিয়ার চামুটিয়া, হান্দুলিয়া থেকে আমি আর জাফর মালসীর চক পার হয়ে বাইকে সড়কে উঠছি। গাড়ি ছিল নুতন জাপানি বাইক। চালক আমি নিজে। সড়কের ডাল উঠতে গিয়ে উল্টে গেলাম। গাড়ি পড়ল ওর পায়ে। প্রচন্ড ব্যথায় ও বলতে থাকলো দাদা, আমার পা নেই। তবে কোন রক্তপাত হয়নি। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওকে ধানকোড়া রেখে আসলাম আমাদের অফিসে। অনেক দিন ভূগেছিল। আমার মনে হয় আজীবন ওর ব্যথাটা ছিল। যার দায় আমার।
একবার আমি আর জাফর বালিয়াটির এক ছোট এনজিও’র স্টাফ প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। ৫/৭ দিন হবে হয়ত। বাইকে যাতায়াত করতাম। একদিন দু’জনে সন্ধ্যায় সাটুরিয়া আসলাম কাজে। কাজ শেষ করে সন্ধ্যা রাতের নির্জন রাস্তায় বাইকে জাফরকে নিয়ে বালিয়াটি রওনা দিলাম। খারাপ রাস্তা হলেও গাড়ির গতি বেশি ছিল। বালিয়াটি পৌঁছে দেখি পিছনে জাফর নেই। সাথে সাথেই গাড়ি ঘুরিয়ে একই রাস্তায় ছুটলাম। অনেকটা যাওয়ার পর দেখলাম খুড়িয়ে খুড়িয়ে আসছে। সামনে গেলে ও আমাকে বলল দাদা, আপনি একটা ভূদাই মানুষ। রেগে গেলে এটাই ওকে বেশি বলতে শুনতাম। আমি কোন কথা না বলে দু’জনে ফিরে এসে এক বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
এভাবেই আমরা কত দিন, মাস, বছর একসাথে কাটিয়েছি। কত ঘটনার জন্ম দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। আজকে পিছন ফিরলে স্বপ্নের মত মনে হয়। এ কিন্তু শুধু স্মৃতি চারণ নয়, একটা সময়ের ইতিহাস।

অবশেষে জাফর বিয়ের পিঁড়িতে বসল। তবে ওর স্ত্রী ভাগ্য প্রসংশনীয়। মানিকগঞ্জের বান্দুটিয়া ওর শ্বশুর বাড়ি। আমাদের বাড়ি মানিকগঞ্জ শহরে হলেও ওর শ্বশুর বাড়ির মত গুনী পরিবার আমি জানি না। ওর স্ত্রী পাপিয়া আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ওরা বেশ কয়েক বোন ও এক ভাই। বড় চার বোন আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরিরত ছিলেন। তার মধ্যে জাতিসংঘ, ইউএনডিপি, রেড ক্রিসেন্টের মত সংস্থাও আছে। ওর স্ত্রী পাপিয়া ও আর এক বোন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি চাকুরে। দুই বোন এনজিও-তে। সবচেয়ে গর্ব করার মত চাকরি করে পাপিয়ার একমাত্র ভাই। নাসার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
১৯৯৫-এ ম্যাসে আমাদের প্রকল্প শেষ হয়ে যায়। দাতা সংস্থা ডিয়াকোনিয়া তহবিলে অপারগতা প্রকাশ করায় প্রকল্প গুটিয়ে সবাই ছন্নছাড়া হয়ে যাই। আমরা অনেকেই অন্য পেশায় যুক্ত হই। জাফর পাপিয়ার কর্মস্থল ঢাকায় সেটেল হয়ে ময়মনসিংহে অন্য একটা এনজিও-তে যুক্ত হয়। আমিও প্রবাসী হই। তারপর প্রায় কুড়ি বছরের বিরতি। সম্প্রতি মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠে জাফরের জন্য। খোঁজা শুরু করে ওর বাড়ির কাছের একটা ছেলের ফোন নম্বর পাই। মোয়াজ্জেম, আমাদের দু’জনের খুব বিশ্বস্ত। কিন্তু ও যে খবর দিল তাতে রোদ ঝলমলে দিনে মাথায় আকাশ ভেঙে পরার মত।
বয়সের সাথে সাথে বন্ধু ও স্বজন শূন্য হচ্ছে পৃথিবী। এই ধারাবাহিকতায় আমিও যাব না একা কুম্ভ হয়ে বেদনার নীল সাগরে ডুবে থাকব, তাই সময় বলবে।
তবে আমি নিশ্চিত ও জন্ম মৃত্যুর মাঝপথে অপেক্ষা করছে। সেখানে হয়ত ওর সাথে দেখা হবে। সেটা এ জীবন না পর জীবন, জানি না।।
কড়চা/ এম এস