লেখালেখির ক্ষেত্রে আমার বংশের প্রথম প্রজন্মের প্রথম আমি। আমার জানামতে আমার ত্রিকুলের (পিতৃকুল, মাতৃকুল ও শ্বশুরকুল) বিয়াল্লিশ গোষ্ঠীতে (৩ x ১৪=৪২ গোষ্ঠী) কোনো লেখক নেই। তবে আমার কেন এ ভাবের উদয়? কেন লিখি? অনেকের এমন প্রশ্নের উত্তরে বলব, চাপে লিখি। এ কেমন উত্তর? সঙ্গত জিজ্ঞাসা, কার চাপ? কিসের চাপ? উত্তরে বলব, ভাবনার বেদনা বা অপ্রকাশিত চিন্তার প্রকাশ পাবার তীব্র চাপ। তেমন অবস্থায় খেতেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না। সত্যিই, সে এক বিষম জ্বালা। অবস্থাটা এমন, না যায় কারো কাছে বলা না যায় নিরবে সওয়া। শোনার লোকই বা কোথায়? আবার দয়া করে কেউ শুনলেও ভাবের লেন-দেনের নিশ্চয়তা কোথায়?
আশির দশকের গোড়াতে এভাবেই পথ চলা শুরু। মনের আকিবুকি কাগজের পাতায় টুকে লুকিয়ে রাখতাম। এসব প্রকাশ করা যায়, পত্রিকায় ও বইতে নিজের কথা ছাপানো যায় তখনো বুঝতাম না। সময় চলে যায়। লিখতে থাকি। একটু একটু সাহস বাড়তে থাকে। দৈনিক পত্রিকা পড়তে শুরু করি। সেখানে অন্যের ছাপানো লেখা পড়ি। সেসব লেখকের নামের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি ওরে বাবা! কত কি যে ভাবি।
একসময় স্থানীয় পত্রিকা ভীরুমনে লেখা পাঠাই। ছাপা হয়। অনেকের নজরে পড়ে। কেউ কেউ রাস্তায় লেখক বলে সম্বোধন করেন। অসম্ভব পুলকিত হই। সুখে নিঃশ্বাস বেড়ে যায়। কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হয় না। ফটোকপি করে পত্রিকার পাতা অনেকের কাছেই পৌছে দেই। বারবার কথা বলেও তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি। ওনারা যে অনেক ব্যস্ত ও নামী মানুষ! সেসব কথা মনে এলে এখন হাসি পায়। কী পাগলামীই না করেছি! কেউ কেউ আবার বলতে থাকেন, স্থানীয় পত্রিকায় সবার লেখাই ছাপা হয় (যদিও তাদের কোনো লেখাই ছাপা হয়নি)। এতে মন খারাপ হয়। তাদের ভাষ্যমতে জাতীয় পত্রিকায় (আসলে জাতীয় পত্রিকা বলে কিছু নেই) লেখা ছাপা না হলে সে কোনো লেখকই নয়। ভাবতে থাকি এ নিয়ে। লিখতে থাকি।
দুঃসাহস করে একদিন লেখা পাঠাই দৈনিক ভোরের কাগজে। ছাপা হওয়ার কয়েকদিন পরে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি ও আমার অন্যতম প্রেরণাদাতা সুরুয খানের মাধ্যমে তা জানতে পেরে খুশিতে প্রায়ই পাগল হয়ে যাই। সমালোচকদের কথা ভেবে মনে হয় এবার বুঝি সত্যিই লেখক হয়েছি। একই পত্রিকা সহ সমকাল, সংবাদ, মানবকন্ঠ, ভোরেরকন্ঠ, সাপ্তাহিক স্বদেশ খবর, সাপ্তাহিক একতা, সাপ্তাহিক গণচেতনা, দৈনিক গণচেতনা, সাপ্তাহিক কড়চা ও দৈনিক মানিকগঞ্জের কাগজে আমার লেখা ছাপা হতে থাকে। লেখা ছাপা হতে থাকে অনলাইন পত্রিকা দৈনিক শিক্ষা ডট কম, বিচ্ছুরন ডট কম, বর্তমান নিউজ, একুশ শতক, সচিত্র বাংলাদেশ (ডিএফপি) ও জিরো পয়েন্ট অনলাইনে (ভারত)। এছাড়াও লেখা ছাপা হয় ইস্পাত, শারদাঞ্জলি, প্রগতি, অন্তরবাদ্যি, দুর্মর, বর্ণপ্রদীপ, সবনর কাজলং, গিরিকানন, উন্মেষ এবং ভারতের উড়িশ্যা রাজ্যের ইন্দিরা গান্ধী মহিলা কলেজের জার্নালে।
আইএসবিএন ধারী ছোট-খাট পাঁচটি বই বের হয় (তিনটি সৃজনশীল বই নিজ খরচে, দু’টি একাডেমিক বই ঢাকাস্থ পুথিনিলয় প্রকাশনা সংস্থা হতে, নির্বাচিত কলাম নামে ষষ্ঠ বইটি প্রকাশের অপেক্ষায়)। এতে সুখ বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে সাহসও বেড়ে যায়। বয়স বাড়তে থাকে।
চলে আসে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের ২৭ তারিখ। দিনটি অন্য দিনের মতোই ছিল। বিকেলে হঠ্যাৎ আবিষ্কার করি আমার নামে আসা একটি চিঠি (আমাদের বারান্দায়)। হাতে নিয়ে দেখি, রীতিমতো হুমকির চিঠি। আমাকে এক মাসের মধ্যে লেখালেখি বন্ধের পাশাপাশি টিভি চ্যানেল ও ইউটিউবে সাক্ষাৎকার প্রদান বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় হুমকিদাতা তৌহিদি জনতা লেখালেখির সাথে সাথে আমার জীবনও থামিয়ে দেবে। লেখালেখির কারণে বিশেষ করে “অর্পিত সম্পত্তি (খ তফসিল) ও নামজারি” নিয়ে লেখার কারণে এর আগে টেলিফোনে হুমকি (২০১৪) পেয়েছি এবং “ফাঁকিবাজ জিন্দাবাদ” নামের একটি প্রবন্ধের কারণে মানহানির মামলা (২০১০) খাওয়ার ধমকি পেয়েছিলাম। সে মামলার জন্য অপেক্ষায় থেকেও মামলা পাইনি। সে দুঃখ সম্ভবত জীবনে যাবে না। যা হোক, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক লেখালেখির কারণে এবার পত্র প্রাপ্তি (২০১৮)। পরিবারের কাউকেই বলতে পারিনি। নিজ কর্মক্ষেত্রে, নিজ লেখক সংগঠনে এবং স্থানীয় কয়েকজন লেখককে জানাই। সবার পরামর্শে ২৮ নভেম্বর থানায় জিডি করি (যার নম্বর ১৩৯২, তারিখ: ২৮/১১/২০১৮, সাথে অনেকের যাওয়ার কথা থাকলেও নানান অজুহাতে পালালেন)। বাড়িতে পুলিশ এলেন। পড়শিদের সাথে পুলিশ কথা বললেন। সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়ে যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশ লোকাল থানার সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে গেল।
শুরু হলো চারপাশে ফুসফাস। আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউ থানা পুলিশ কোর্ট-কাচারি করেননি। আর আমার বাড়িতে একদল পুলিশ। এরই মাঝে ইওেফাক, দৈনিক টেলিগ্রাম ও সাপ্তাহিক কড়চায় নিউজ হয়ে গেছে (শেষের দু’টিতে ছবি সহ)। ছবি সহ নিউজ হয়েছে অনলাইন পত্রিকা একুশ শতক, দৈনিক টেলিগ্রামের অনলাইন সংস্করণে। এছাড়া বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটি আমাকে হুমকির প্রতিবাদ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ড. গোলাম কিবরিয়া পিনু ও সাধারণ সম্পাদক কবি শাখাওয়াত টিপু মোবাইল করে সাহস যুগিয়েছেন। মোবাইল করে সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি বন্ধুবর জয়দেব কুমার ভদ্র। প্রতিবাদ সভা করেছে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ, মানিকগঞ্জ জেলা কমিটি। লেখক ও সাংবাদিক দীপঙ্কর গৌতম আমার ব্যাপারে পত্রিকায় লিখেছেন। আর খুলনার পাইকগাছার অনির্বাণ লাইব্রেরীর পক্ষ হতে সাধারণ সম্পাদক প্রভাত দেবনাথ প্রতিবাদ করে ফেসবুকে বিবৃতি দিয়েছেন। অন্যদিকে আমার ফেসবুক বন্ধু নিখিল বর্মন ইত্তেফাকে প্রকাশিত নিউজ সহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাকে ট্যাগ করেছেন।
আর পারা গেল না। এ পর্যায়ে বাড়ির সদস্যরা (মা ছাড়া) এবং বোনেরা জেনে গেল। জেনে গেল শ্বশুর বাড়ি। শুরু হলো রীতিমতো হৈচৈ। অনেকেই আমার দিকে কেমন করে যেন তাঁকাতে থাকেন। যেন আমি ভিন্ন কোনো প্রাণি। বা কোনো অপরাধী। পরিবারের সদস্যদের (কাছের ও অন্যদেরও) একটিই কথা। লেখা বন্ধ করতে হবে। এসব আমাদের কাজ না। আমরা অতি সাধারণ মানুষ। একটা কিছু ঘটে গেলে কি হবে। ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি অনেকটাই ভ্যাবাচ্যাকা বনে যাই। আপনজনদের কথা দেই, লেখক সংগঠন হতে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেব এবং লেখালেখির বিপজ্জনক কাজ আর করব না।
পুলিশ প্রশাসন ও শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শে দু’মাস লেখালেখি পুরোপুরি বন্ধ রাখি। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কথা হয় নজরুল গবেষক ও লেখক পীযূষ ভট্টাচার্য্যরে সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রীধারী আমার এক সুপরামশর্ দাতাকে (যিনি আমাকে লেখালেখি নামের বাজে কাজ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন) তিনি কুলাংগার হিসেবে আখ্যায়িত করে আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। কবি আতোয়ার রহমানও আমাকে উৎসাহ দিয়ে সাহস যুগিয়েছেন। আরো অনেকেই এমন কথা বলেন। আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে লিখতে অনুরোধ করে।
আবার টুকটাক লিখতে থাকি। চলতে থাকে সময়। চলে আসছে ২৭ নভেম্বর ২০২০। প্রায় দু’বছর হতে চললো। আমি এখনো বেঁচে আছি। প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ঝুট-ঝামেলা সাধ্যমতো মিটিয়ে মনের খোরাকের জন্য লিখে চলেছি। (পত্রিকায় প্রকাশিত কলামের সংখ্যা দু’শতাধিক)। কতদিন পারবো জানি না। ভাবনা গুলো যখন শোল মাছের পোনার মতো মাথায় কিলবিল করে তখন সত্যিই ভীষণ অসহায় বোধ করি। একমাত্র কলমই তখন আমাকে মুক্তি দেয়। আবার নতুন চিন্তা ডাক দেয়। কয়েকদিন চুপচাপ থাকি। কিন্তু ওরা বড় নাছোড়বান্দা। ডাকতেই থাকে . . . . . . ডাক শুনি দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত আমার অগ্রজ-অনুজ লেখকদের (বাংলাদেশের লেখক গ্রন্থ-২০১৪ ভূক্ত ২২৯৯ জন লেখক)। বিচ্ছেদের যাতনা অনুভব করি। স্বজনদের আকুতি আর সহযাত্রীদের মুখগুলো আমাকে বিভ্রান্ত করতে চায়। আমার লেখালেখির দীর্ঘ চলার পথে যাঁরা আমাকে নানান ভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের সবার কাছেই কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে যাঁরা আমাকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যাঁরা দেননি এবং কোনোদিন দিবেনও না তাঁদের কাছে আমি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। কারণ, এতে আমি নিজের সাথে বোঝাপড়া করতে পেরেছি। ঋনী আমি আমার পরিবারের সদস্যদের কাছেও। কৃতজ্ঞ আমি তারেক, উজ্জল, রনি, রাব্বি, সুফল ও মিলনের কাছে। এরা পরম যত্নে আমার চিন্তাগুলোকে কম্পোজ করে অক্ষরবন্দী করেছে।
অনেকটা সময় এ পথে কাটাতে গিয়ে বন্ধু-শক্র সবই পেয়েছি। তবে শক্রর সংখ্যাই বেশি হবে বলে মনে হয়। এলোমেলো ভাবনাগুলোকে গোছানো, শব্দে রূপ দেয়া, এডিট করা ইত্যাদি অত্যন্ত যন্ত্রণার। হাজার হাজার কর্মঘন্টা, সৎ পথে উপার্জিত হাজার হাজার টাকা লেখালেখির পেছনে ব্যয় করেছি। কারণ, আমাকে যে লেখক হতেই হবে!!! কতটুকু হতে পেরেছি তা পাঠকরাই জানেন। তবে লিখে সামান্য সম্মানী ও অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আপ্রান চেষ্টা করেছি, সাধনা করেছি। ভেবেছিলাম আমার ভালো লাগার পাশাপাশি সমাজের ও রাষ্ট্রের হয়তো ছিটেফোটা পরিবর্তন হবে। কিছু কি হয়েছে? আমার পাঠকরা অনেক দাবি নিয়ে আমাকে লিখতে বলেন। চিঠি পাঠান। তাঁদের সব কথা লিখতে পারি না। কারণ, একজন লেখক হিসেবে কিছু নীতিমালা অবশ্যই মেনে চলতে হয়। আশা করি এজন্য তাঁরা আমাকে ভুল বুঝবেন না।
লেখার ভাবনা, পাঠকের প্রতিক্রিয়া, পারিবারিক, পেশাগত, শারীরিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক করোনা মহামারির পরিবেশ পরিস্থিতিতে আজ আমি অনেকটাই ক্লান্ত। কিছুদিন লেখার পাতায় আমাকে নতুন করে আর পাবেন না। প্রিয় পাঠকদের আমার কিছু কথা জানালাম। আমার বিশ্বাস সংবেদশীল পাঠকরা আমাকে বুঝবেন। বংশের ঐতিহ্য অনুযায়ী গত দু’পুরুষে সবার ছোটরা সবার আগে যে বয়সে চলে গেছেন আমিও ঠিক সেখানেই অবস্থান করছি। আপনারা আমার ভুল ক্রটি ক্ষমা করে আমার জন্য প্রার্থনা করবেন যেন আমি অন্তত পাঁচটি বছর সুন্থ ভাবে বেঁচে থাকি। এবার আমাকে একটু থামতে হবে, একটু দম নিতে হবে। ভাবনার পোনাগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সবাই সুস্থ থাকুন- ভালো থাকুন।
শ্যামল কুমার সরকার : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ প্রগ্রেসিভ রাইটার্স এসোসিয়েশন, মানিকগঞ্জ জেলা শাখা।