আবুল ইসলাম শিকদার
বাসার একজনের করোনা পজিটিভের জন্য লক ডাউনের মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে। এরমধ্যে সংক্রমিত সহ আমরা সকলেই ঝরঝরে হয়ে উঠেছি। কিন্তু ওই ১৪ দিনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, যেগুলো গর্তের সাপের মত গর্তের ভেতরেই ছিল। এমন পরিস্থিতি না হলে হয়তো তা কখনোই আবিষ্কৃত হতো না। সম্পর্কগুলোর উপরে প্রলেপ লাগিয়ে যেভাবে চলছিলাম সেভাবেই চলে যেত।
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন, যাকে বলে রক্তের সম্পর্ক, তাদেরও দু’একজন ফোন পর্যন্ত করেননি। আমি কখনোই কারো কাছ থেকে খুব দয়া, আহ্লাদ ইত্যাদি প্রত্যাশা করিনি। তারপরও একটা বিশেষ অবস্থায় যারা একটু হ্যালো বলে খোঁজ খবর নেয়, তারা কিন্তু মনের মধ্যে অনেকক্ষণ বাসা করে থাকে। ঠিক তেমনি, যাদের কাছে প্রত্যাশা করা যায় বা প্রত্যাশা করা অনুচিত নয়, তারা যদি অন্য গ্রহের মানুষের মত নিস্পৃহ থাকে সেটিও মনে এক ধরনের দাগ কেটে যায়।
বাসা লকডাউনের পর থেকেই আমরা নিজের গরজেই আমাদের বাসায় যে মেয়েটি কাজ করে তাকে ফোন করে আসতে বারন করেছি, যে দুধ দেয় তাকে সাবধান করেছি, উপরের ভাড়াটিয়া গ্রামের বাড়িতে ছিল তাকেও সতর্ক করে খবরটি পৌঁছে দিয়েছি। অর্থাৎ আমরা কোনোভাবেই অনেকের মতো পরিস্থিতিটাকে গোপন করতে চাইনি। কেননা এটি কোন গোপনীয়তার বিষয় নয়, এটি কোন সামাজিক অপরাধও নয়, এটি একটি ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নয়।
সমস্যা হল যে ছেলেটি বাসা থেকে ময়লা নিয়ে যায় তাকে নিয়ে। ময়লা তো আর বাসায় জমানো যাবে না। আমি নিজেই বাইরে নিয়ে ফেলে আসতে পারি কিন্তু লক ডাউনের নিয়ম মেনে সেটি সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটু গভীর রাতে না হয় একটু নিয়ম ভঙ্গ করে নিজেই ফেলে দিয়ে আসবো।
কিন্তু আশ্চর্য পরের দিন ছেলেটি এসে যথানিয়মে কলিং বেল টিপে ময়লা দেয়ার তাগাদা দিচ্ছে। আমি কিছুটা ইতস্তত করছিলাম। আমার স্ত্রী বলল, ওর কোন অসুবিধা নেই। কেননা পাশের লোক যারা আমাদের বিশেষ শুভানুধ্যায়ী, তারা ছেলেটাকে নানাভাবে নিষেধ করেছিল আমাদের বাসা থেকে ময়লা নিতে এবং করোনার বিভীষিকা সম্পর্কে ছেলেটাকে নানান ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন। ছেলেটি উল্টো তাদেরকে দু’কথা শুনিয়ে দিয়েছে। সে বলেছে, যদি এই পরিস্থিতিতে আমি তাদের ময়লা না নেই তাহলে বাসার পরিবেশ তো আরো নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং আমাকে আপনারা যাই বলেন আমার ওই বাসা থেকে ময়লা নিতেই হবে।
আমি কথাটি শুনে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। যেখানে সামান্য কান কথায় মানুষ মানুষের প্রতি কতটাই না অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, সেখানে প্রকাশ্যে একাধিক লোকে তাকে কান মন্ত্র আর সাবধান করেও থামাতে পারেনি। আমি মনে করি ছেলেটি এক্ষেত্রে শুধু যে তার কর্তব্য পালন করেছে তা নয়, তার ভেতরে একটি মানবিকতা বোধ দারুণভাবে কাজ করেছে। কেননা আমি তাকে আইনত আমার বাসা থেকে ময়লা নিতে বলতে পারিনা। বরং সে যদি এ মাসে ময়লা না-ও নেয় তবুও তার বেতন সে প্রাপ্য। অথচ ছেলেটি নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে আমার বাসা থেকে একদিন পরপর ময়লা নিয়ে গেছে। আমি পরে ছেলেটির সুবিধার জন্য ময়লার ব্যাগটা বাসার নিচে নামিয়ে দিয়েছি। তার চোখে মুখে আমি কখনোই ভীতি কিংবা সামান্য বিরুপ দৃষ্টি দেখিনি।
ছেলেটি বয়সে হয়তো আমার অনেক ছোটই হবে, তবুও এক ধরনের শ্রদ্ধায় আমি অবনত হয়েছি। আমি নিজে হলেই এটি পারতাম না। অথচ লেখাপড়া না জানা একটি ছেলে তার নিজস্ব যুক্তিবোধ এবং মানবিকতাবোধ থেকেই তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
আমরা অনেক সময়ই দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং নিম্নবিত্তের মানুষদের অকারণেই এড়িয়ে চলি। তাদের সম্পর্কে আমাদের কোনো আগ্রহ থাকে না এবং আমাদের সম্মোধন কথাবার্তা কিছুতেই তুই-তোকারির উপরে উঠতে চায় না। কিন্তু আমরা যদি প্রতিটি মানুষকেই একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সত্তা হিসেবে চিন্তা করি তাহলে সহজেই বোঝা যায় মানবিকতা সততা নিষ্ঠা ইত্যাদি কোন শ্রেণী বিশেষের একান্ত সম্পদ নয়। সকলের মধ্যেই এগুলো বিরাজ করে, শুধু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রকাশের ভিন্নতা থাকে। আমরা মধ্যবিত্ত, উচ্চ বিত্তবানরা যেমন করে সেগুলো ধুমধামে প্রচার করে বেড়াই, এইসব অবহেলিত মানুষেরা তা করেনা। তারা ঐ প্রচার বিমুখ ছেলেটির মতোই নিরবে সমাজের ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করে যায়। অথচ আমরা নিজেরাই সমাজের ময়লা আবর্জনা হয়ে সমাজটাকে সমানে নষ্ট করে চলছি।
স্নেহ ভাজন পরিচ্ছন্ন কর্মী ছোট ভাই, তোমাকে আবারো ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আবুল ইসলাম শিকদারঃ সভাপতি, জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, মানিকগঞ্জ এবং সাবেক অধ্যক্ষ, মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।