১৪ জুলাই, জন্মদিন, শ্রেয়া’র। সাল ১৯৯৮। ফরিদা ক্লিনিক, শান্তি নগর। রাত শেষ হওয়ার পথে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে পৃথিবী। উদিত আলোর সাথে, জীবনের দামী উপহার পেলাম, আমার স্ত্রীর গর্ভের সন্তান। আমাদের মেয়ে। আমার আনন্দের অংশীদার আকাশ, বাতাস, গাছপালা, প্রকৃতি। তারা অভিনন্দন জানাচ্ছে আমার মেয়েকে। মধুর আগমনী বার্তা। আমি বাবা। আমার সন্তান। আবেগময় আনন্দ। আষাঢ় শেষ হচ্ছে। সকালের আলো ঢেকে দিলো মেঘ। অঝোরে বৃষ্টি। নামল সারাদিন। আমার আনন্দাশ্রু বৃষ্টির সাথে একাকার। আমি, বৃষ্টি এবং আনন্দ। একজন বাবা হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা। এরপর আনন্দ যাত্রার সারা জীবনের সাথী আমার শ্রেয়া এবং তার মা। তিনে মিলে বিশ্ব জয়। এ অঙ্গীকারে সময় কাটছে। দিন গড়িয়ে মাস, মাস থেকে বছর। পার হলো শ্রেয়ার দ্বিতীয় জন্মদিন; প্রথম জন্মবার্ষিকী।
দিন যায়। দিন বদলায়। চলে যায় মাস ও বছর। শ্রেয়ার বয়স ১৮ মাস। তখনো দাঁত উঠেনি। যাওয়া হয় চিকিৎসকের নিকট। চিকিৎসকের অভয়, এটি কোন সমস্যা নয়। দাঁত উঠবে। শ্রেয়ার সাথে কথা বলেন চিকিৎসক। যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ। বাবা-মা হিসেবে আমরা অবুঝ। কানের পরীক্ষা। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে কোন সমস্যা নেই। ইঙ্গিত ভিন্ন সমস্যা। ক্রমেই পরিবেশ স্বাভাবিকতার উল্টোদিকে। ২০০০ সালে বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে ব্যাপক সম্যক ধারণা ছিল না; এখন যতটা হয়েছে। অধ্যাপক এম আর খান বরেণ্য চিকিৎসক আমাকে একটি চিঠি দিলেন, লিখেছেন তার বন্ধু অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আহমেদকে। তিনি কলকাতা, ভারতের চিকিৎসক। আমাকে বললেন, চিঠিটি তাকে দিবেন এবং শ্রেয়াকে তিনি দেখবেন, চিকিৎসা পাবেন। এ সময় মোবাইল যোগাযোগ মৃদু মৃদু করে উঁকি দিচ্ছে। ল্যান্ড ফোনই ভরসা। চলে গেলাম কলকাতায়। ১৮-১৯ ঘন্টার দীর্ঘ সময়ের বাস যাত্রা। কমলাপুর- কলকাতা-সল্টলেক; বেনাপোল বর্ডার ক্রস করে। বাসা ছেড়েছিলাম ভোর ৫ টায় ঢাকার কল্যাণপুর হতে। কলকাতার নিউ মার্কেট এলাকায় যখন পৌঁছি তখন রাত ১১টা। হোটেল খুঁজে বের এবং রাতের খাবার শেষ করি। এরপর ঘুম। রাতের ঘুম তখনও যেমন আমাদের জন্য আরামদায়ক ছিল না। এখনো সে কষ্ট দূর হয়নি। শ্রেয়া আমাদের ঘুমাতে দেয় না।
সকালে ল্যান্ড ফোনে অধ্যাপক রফিক উদ্দিন আহমেদ এর বাসায় কল করেই বিশাল একটা হোচট খেলাম; তিনি কলকাতায় নেই, সপ্তাহ খানেক পূর্বে ইংল্যান্ড চলে গেছেন। আসবেন দেরি করে। আমাদের ভরসার জায়গা হারিয়ে ফেলি। এরকম কিছু হতে পারে ভেবেই ঢাকা ছেড়েছিলাম। এদিনও ছিল মেঘ আর অঝোর বৃষ্টি। বিকল্প পথ বেছে নিলাম, যাই উইড ল্যান্ড হাসপাতালে; বিকেল বেলা। ট্যাক্সি হতে নামতেই শ্রেয়া পড়ে গেল। তাকে তুলে ধরি। বেশ কান্না করলো; আবার স্বাভাবিক হলো। একজন শিশু নিউরো বিশেষজ্ঞ এর সাক্ষাত গ্রহণের সুযোগ পাই। তিনি অটিস্টিক শিশুদেরও দেখেন। তবে আজ নয়। আসতে হবে পরের দিন সকাল ৯ টায়। শ্রেয়ার কান্না বেড়ে গেল। বিরামহীন কান্নার ভিতর দিয়ে শ্রেয়াকে নিয়ে আসি সায়েন্স সিটি এবং নিউ মার্কেট এ। যদি শ্রেয়ার ভালো লাগার কিছু ঘটে।
সকালে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হই। নারী চিকিৎসক। নাম ডাক্তার কৃষ্ণা; কথা প্রসঙ্গে জেনেছিলাম সম্ভবত: তার বাড়ি তামিল নাড়ুু। তিনি আমাদের বললেন কালীঘাটে বসেন ডাঃ নারায়ণ, অটিস্টিক বিশেষজ্ঞ, বাড়িতেই রোগী দেখেন, তাকে দেখালে ভালো হয়; যদি আমাদের সে সুযোগ থাকে। তিনি শ্রেয়াকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর আমাদের দুজনকে জানালেন, আকাশ ভাঙ্গা আর একটি বিপদের সংবাদ। শ্রেয়ার বাম হাত ভেঙ্গে গেছে। গতকাল বিকেলে ট্যাক্সি থেকে নেমে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে ঘটনা টি ঘটে।
বেশ সীমিত অর্থ নিয়ে বের হয়েছিলাম। বিদেশে, কেউ আমাদের চিনেন না। পকেটে যা টাকা ছিল, সিদ্ধান্ত নিলাম, করবো হাতের চিকিৎসা এবং উইড ল্যান্ড হাসপাতালেই; তাকে অজ্ঞান করে হাতের প্লাস্টার করাতে হবে। ২ বছরের শ্রেয়া ঢুকছে অপারেশন থিয়েটারে; আমি থিয়েটারের দরজার কাছাকাছি পর্যন্ত শ্রেয়াকে এগিয়ে দিতে যাই। পিছনে ফিরে চেয়ে দেখি, তার মা হাউমাউ করে কাঁদছে। আমার চোখেও পানি, শার্ট ভিজা; দীর্ঘ সময় আমরা কেঁদেছিলাম; এ বাধ ভাঙ্গা কান্নার কথা আজ তার জন্ম দিনে মনে পড়ছে। ভেবেছিলাম, শ্রেয়াকে আর পাব না। এই বুঝি অপারেশন থিয়েটার থেকে আসবে কোন এক নির্মম দুঃসংবাদ। এরই নাম আমার শ্রেয়ার প্রতি আমাদের ভালোবাসা।
ডাঃ কৃষ্ণা এবং ডাঃ নারায়ণ উভয়ই আমরা দেশে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, সেটা জেনে অধ্যাপক আনিসা জাহান এবং অটিজম কাউন্সিলর নারসির রহমানের কার্যক্রমগুলো প্রেসক্রিপশনে দেখে, তাদের খুবই প্রশংসা করলেন। আমার দেশের চিকিৎসকদের পারদর্শীতা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উচ্চ মনোভাব দেখে আজও বেশ আনন্দ অনুভব এবং গর্ব বোধ করি।
আজ শ্রেয়ার জন্ম দিন। অজস্র আনন্দ এবং বেদনার সমাহার রয়েছে আমার মাঝে। আমি একজন শ্রেয়া’র বাবা, অটিস্টিক কন্যার বাবা, অটিস্টিক কমিউনিটির সকল সন্তানের বাবা। আমার দায়িত্ব অনেক। শ্রেয়া’র জন্মদিনে রাষ্ট্র, সমাজ এবং দেশ সকলের নিকট আমাদের আকুতি, এগিয়ে আসুন শ্রেয়াদের সাথে। তাদের প্রতিভা ও মেধা লুকিয়ে রয়েছে। সেটি উম্মোচন করে তাদের সক্রিয় ও কর্মক্ষম রাখতে হবে। এর বিপরীত চিত্র কারো জন্য মঙ্গল হওয়ার নয়। বাংলাদেশের উন্নয়নের সাথে অটিস্টিক ব্যক্তিদের সামিল করতে না পারলে, দেশ স্থবির হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। শ্রেয়াদের সংখ্যাটিও বেশ দীর্ঘ। আসুন তাদের পাশে দাড়াই।
জন্মদিনে শ্রেয়া’কে অভিনন্দন!
কড়চা/ আর আই টি