সোনালুর হলুদাভ উষ্ণ অভ্যর্থনা
আব্দুর রাজ্জাক
গ্রীষ্মের ঝিম ধরা তপ্ত রোদে চার দিক খাঁ খাঁ করছে; প্রচন্ড গরমে জনজীবন ওষ্ঠাগত। এছাড়াও মহামারী করোনা আতংক আর লকডাউনে বাইরে মানুষজনের সংখ্যা খুবই কম। তাই বলে থেমে নেই প্রকৃতি। ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার পথে প্রান্তরে এখন দৃষ্টি মেললেই বর্ণিল ‘সোনালু’র হলুদ রঙের সমারোহ। এর অপরূপ শোভা যে কারো মনকে ছুঁয়ে যায় নিঃসন্দেহে।
একসময় গ্রাম-বাংলার পথে-প্রান্তরে সচরাচর সোনালু গাছের দেখা মিলত। প্রকৃতি ধ্বংসের উৎসবে এই শক্ত প্রাণের বৃক্ষটিও বুঝি বিলুপ্তির পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এখন বৃক্ষটি দেখতে চাইলে খুঁজে বের করতে হয়। উপজেলার ঘিওর থানার মোড়, উপজেলা পরিষদ চত্বর, বানিয়াজুরী, রাথুরা-তরা রাস্তা, জাবরা, বালিয়াখোড়া, সিংজুরী, তেরশ্রী রাস্তা, সরকারি ডিগ্রি কলেজের পেছনের রাস্তা, পঞ্চরাস্তা মোড়, বরটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সড়ক, নালী-কেল্লাই সড়কের দুপাশে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকা-পুখুরিয়া রাস্তা, বাষ্টিয়া খেলার মাঠ, পয়লা গ্রামীণ রাস্তা, ভোর বাজার, আশাপুর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় সোনালু গাছের অপরূপ সৌন্দর্যের দেখা মেলে। হলুদ রঙের বাহারি শোভা ছড়িয়ে ঝুলে থাকা ফুলের সৌন্দর্য পথচলতি যে কাউকে মোহিত করে। এসব গ্রামের সড়কের পাশে কিংবা পুকুর ধারে ফুটন্ত সোনালুর দোল দেখে মনে হয়- প্রকৃতির হলুদাভ উষ্ণ অভ্যর্থনা।
এ ফুল দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি তার নামের বাহার- সোনালু, সোনাইল, সোঁদাল, বান্দরলাঠি ইত্যাদি। গ্রীষ্ম রাঙানো মানিকগঞ্জে বাঁদর লাঠি নামেই বেশি পরিচিত। উদ্ভিদ বিষয়ক একাধিক জার্নাল মারফত জানা যায়, এর ইংরেজি নাম- Golden Shower Tree, বৈজ্ঞানিক নাম- Cassia fistula. এটি Caesalpiniaceae পরিবারের সদস্য। আদিনিবাস পূর্ব এশিয়া। তবে হাজার বছর আগেও এ গাছ আমাদের উপমহাদেশে ছিল। মহাকবি ব্যাস এর ভগবত কিংবা কালিদাস এর মেঘদূত-এ ফুলের গুন-কীর্তন করা দীর্ঘ মঞ্জুরিদণ্ডে ঝুলে থাকা ফুলগুলোর পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি। সবুজ রঙের একমাত্র গর্ভকেশরটি কাস্তের মতো বাঁকানো। এ গাছের ফল বেশ লম্বা, লাঠির মতো গোল। গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলো যৌগিক, মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। ফুল এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হয়।
ঘিওর উপজেলার জাবরা ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা কামরুন নাহার মুক্তা বলেন, গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে প্রাণের সজীবতা নিয়ে যেসব ফুল ফোটে তার মধ্যে সোনালু উল্লেখযোগ্য। কিশোরীর কানের দুলের মতো বৈশাখী হাওয়ায় দুলতে থাকে হলুদ-সোনালি রঙের থোকা থোকা ফুল। সোনালু গাছ সাধারণত যত্ন করে লাগানো হয় না বরং সে নিজেই বেড়ে ওঠে অবহেলায়। নিরবে বেড়ে ওঠে, থাকেও নিষ্প্রাণ নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে। যখন ফুল ফোটে তখন কারো সাধ্য নেই এ গাছকে দৃষ্টি না দিয়ে এড়িয়ে যাবার। বেড়ে ওঠার সময় তেমন দৃষ্টিতে না পড়লেও ফুল ফোটার পর দেখে সবার মন-প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে যায়।
সোনালু শুধু সৌন্দর্যের নাম নয়, এ গাছ ও ফুল মানুষের নানা উপকারে আসে। মানিকগঞ্জ সাধনা ঔষধালয়ের চিকিৎসক ডাঃ উত্তম কুমার পালিত বলেন, এ গাছের কাঠ জ্বালানি ছাড়াও অন্যান্য কাজে লাগে। ফলের শাঁস বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে। বাত, বমি ও রক্তস্রাব প্রতিরোধে উপকারী। বীজ সহজেই অঙ্কুরিত হয়, যদিও বৃদ্ধি মন্থর। এছাড়াও এ গাছের বাকল, রঙ ও ট্যানিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়।
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল রায় বলেন, গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে গ্রামে একসময় অনেক সোনালু গাছ চোখে পড়তো। এছাড়াও হাট, বাজার ও গঞ্জের চারপাশেও দেখা যেত হলুদিয়া সাজের সোনালুর উপস্থিতি। এখন হাতেগোনা কিছু গাছ দেখা যায় পথে প্রান্তরে। দিন দিন কমে আসছে সোনালুর সংখ্যা। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, এ গাছের কাঠ খুব একটা দামি নয় বলে কিংবা গাছটি খুব ধীরে বাড়ে বলেই কেউ আর তেমন উৎসাহ নিয়ে সোনালু গাছ রোপণ করেন না। প্রাকৃতিকভাবে যা হয়, তার ওপর ভর করেই হলুদ-সোনালি রঙের সৌন্দর্য বিতরণ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সোনালু। এক সারিতে বেশ কয়েকটি গাছে যদি ফুল ফোটে তাহলে সে দৃশ্য বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
কড়চা/ এ আর