হিরোশিমা দিবস আজ, বিশ্বশান্তির প্রত্যাশা / রুহুল ইসলাম টিপু

৭৫ বছর পূর্বে ১৯৪৫ সালের ০৬ এবং ০৯ আগস্ট আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল। পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের। একসঙ্গে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ নিহত হয়। হিরোশিমার ৩ লক্ষ ৫০ হাজার জনগণের মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার এবং নাগাসাকিতে কমপক্ষে ৭৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১৪ আগস্ট ১৯৪৫-এ জাপান আত্মসমর্থন করে। বাংলাদেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দপূর্ণ। জাপান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন এবং ২ লক্ষ মা বোন হয়েছেন বীরাঙ্গনা। যন্ত্রণা এবং শান্তির অনুভূতি দুই রকম, তবে ভাষা একই। শব্দ নিরব থাকলেও ফুটে উঠে। ঘটে তার প্রকাশ।

Hibakusha জাপানিজ শব্দ। ১৯৪৫ সালের আণবিক বোমায় যারা আক্রান্ত হয়ে বেঁচে ছিলেন তাদেরকে বলা হয় Hibakusha. বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো ছিলেন ভীতসন্ত্রস্ত। তারা বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়তা এবং মনোজাগতিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ব্রিটিশ ফটো সাংবাদিক লি কারেন স্টো ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন নারীকে নিয়ে তৈরি করেছেন এ প্রতিবেদন যেটি বিবিসিতে আপলোড করা হয় ০২ আগস্ট ২০২০। আমি উল্লেখযোগ্য অংশ ভাবানুবাদ করে এ লেখা প্রস্তুত করি। উদ্দেশ্য তখনকার সময়ের মানুষের মুখের কথা সরাসরি গ্রহণ করা; ৭৫ বছর হয়ে গিয়েছে; এই মানুষদের এরপর আর হয়ত বা পাওয়া যাবে না।

টেরুকো ইউনোঃ টেরুকো ০৬ আগস্ট ১৯৪৫-এ হিরোসিমার আণবিক বোমা হতে রক্ষা পেয়েছিলেন; তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। আণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সময় টেরুকো হিরোসিমা রেড ক্রস হসপিটালে দ্বিতীয় বর্ষের নার্সিং স্কুলের ছাত্রী।
আণবিক বোমার আঘাতে হসপিটালের ডরমিটরীতে আগুন ধরে যায়। আগুন ছিল ভয়াবহ। টেরুকো বন্ধুদের বাঁচানোর সাহায্য করেন। তবে তার অনেক বন্ধু আগুনে মারা যায়। টেরুকোর স্মৃতিতে আছে সপ্তাহ কাল ব্যাপী তিনি দিন রাত আহত নির্যাতিতদের সেবায় কাজ করছিলেন। এ সময় তার এবং তার সাথে অন্যান্যদের নিকট কোন খাবার ছিল না। পানি ছিল যৎসামান্য। টেরুকো গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে হাসপাতালেই কর্ম অব্যাহত রাখেন। তিনি রোগীদের চর্ম সংযোজন সংক্রান্ত অপারেশনে সহায়তা করতেন। রোগীদের শরীরের চর্ম এক স্থান থেকে কেটে অন্য স্থানে লাগানো এবং ক্ষত স্থান সারানোতে দায়িত্ব পালন করেন।

আণবিক বোমা হতে রক্ষা পাওয়া এমন একজনকে তিনি পরে বিয়ে করেন। যখন টেরুকোর প্রথম সন্তান গর্ভে এলো; এ সময় তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তার সন্তান স্বাস্থ্যসম্মত হবে কি-না এবং পৃথিবীতে এলেও বাঁচবে কি-না। টেরুকোর কন্যা টোমোকোর জন্ম হলো, মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী ছিল। এ মেয়েটি টেরুকো এবং তার পরিবারকে সাহসী করে তুলল। টেরুকো বলেন, তিনি সে সময় খুব বেশি খারাপ ছিলেন, সেটা নয়; বড় খারাপ ঘটনার আশঙ্খা তার ছিল। পুনরায় একটি বড় বিপদ ঘটার ভয় ছিল। জনগণ আণবিক বোমা নির্মূলে শক্ত অবস্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তার মনে আছে এ কাজটি স্থানীয় সরকারের নেতৃবৃন্দ শুরু করেছিলেন। এর পর জাতীয় সরকার এবং সারা বিশ্ব জেগে উঠেছিল।

অধিবাসীরা তখন ভেবেছিল আগামী ৭৫ বছর পর্যন্ত হিরোসিমায় কোন ঘাস এবং গাছপালা জন্মাবে না। কিন্তু হিরোশিমা এখন নদী বেষ্টিত একটি সুন্দর সবুজ শহর। এটি টেরুকো’র কন্যা টোমোকো’র কথা। আণবিক বোমায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা (the hibakusha) তেজস্ক্রিয়তায় ক্রমেই বিভিন্ন ধরনের শারীরিক যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। সময় চলে যাবার সাথে সাথে হিরোশিমা এবং নাগাসাকির মানুষের স্মৃতি থেকে কষ্টগুলো সরে যাচ্ছিল। এটি যাত্রাপথের অনেকটা বাঁক অতিক্রমের মতো। ভবিষ্যৎ হচ্ছে আমার হাতের মধ্যে। যেটি কাজ করেই সম্ভব। শান্তি সম্ভব যদি আমরা সেটা চিন্তা করতে পারি; অন্য মানুষের সাথে তুলনা করতে পারি। তাহলেই উত্তর পাওয়া যাবে। আমরা পারি, এখনই সেটা শুরু করতে হবে এবং ক্লান্তিহীনভাবে দিনের পর দিন কাজ করতে হবে, তবেই শান্তি নিয়ে আসতে পারবো। কথাগুলো টেরুকো’র নাতনী কুনিকো’র।

কুনিকো আরও বলেন, আমার যুদ্ধ বা আণবিক বোমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি জানি হিরোশিমা পুনরায় জন্মলাভ করেছে। আমি এটি কল্পনা করতে পারি। আণবিক বোমায় আক্রান্ত হয়েছেন (the hibakusha) এমন অন্যদের কথা শুনুন। আমি জেনেছি আণবিক বোমার সাক্ষ্যসহ প্রকৃত তথ্য। সেদিন এই শহরের সকল কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মানুষ, পাখি, ড্রাগনফ্লাইস, ঘাস, গাছপালা সব কিছু। নিকটতম আত্মীয়, বন্ধু, স্বজনদের উদ্ধারে যারা শহরে ঢুকেছিলেন তারাও মারা গিয়েছিলেন। যারা বেঁচে ছিলেন তারা দীর্ঘ রোগ যন্ত্রণা ভোগ করছিলেন।

আমি খুবই ক্লান্তহীনভাবে হিরোশিমা এবং নাগাসাকির আণবিক বোমায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের (the hibakusha) পাশে থেকে কাজ করি। একইভাবে আহত ইউরোনিয়াম মাইন শ্রমিকদেরও আমি সহযোগিতা করি। তাদের পাশে ছিলাম। আমি দেখেছি শ্রমিকরা মাইনের কত কাছাকাছি জীবন যাপন করে। তারা আণবিক বোমা প্রতিহত এবং জনগণের উন্নয়নে কিভাবে কাজ করে। প্রকারান্তে এই মানুষগুলো আবার দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার মধ্যে পতিত হয়।

এমিকো ওকাডঃ হিরোশিমায় যখন আণবিক বোমা নিক্ষেপিত হয়, তখন এমিকোর বয়স ৮ বছর। তার বড় বোন মেইকো এবং আরও ৪ জন আত্মীয় নিহত হয়। এমিকো এবং তার পরিবারের অনেক সদস্যের ছবি হারিয়ে গিয়েছে। যারা বাড়িতে থেকে বেঁচে ছিলেন, তাদের ছবি আছে এবং এর সাথে তার সেই নিহত বোনের ছবিও আছে।

আমার বোন সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলে, একটু পরেই তোমার সাথে দেখা হবে। তার বয়স ছিল ১২। এ বয়সে সে সব কিছু ভালোই বুঝতে পারত। সে আর ফিরে আসেনি। কেউ জানেও না, তার কি হয়েছিল।

আমার বাবা মা তাকে পাগলের মতো খুঁজেছিল। তারা তার দেহ খুঁজে পাননি। তাদের বিশ্বাস ছিল এবং বলত, সে কোথাও বেঁচে আছে। আমার মা, সে সময় গর্ভবতী ছিলেন। দুর্ভাগ্য তার গর্ভপাত ঘটে। আমাদের কারো কাছে কোন খাবার ছিল না। আমরা জানতাম না তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে। ভাল মন্দ না বুঝে যা পেতাম তাই মুখে দিতাম। সেটাই ছিল আমাদের খাবার। মানুষ চুরি করত, যার কাছে যা পেত তাই কেড়ে নিতো। খাবার ছিল বড় সমস্যা। পানি ছিল। মানুষ কত কষ্ট করে কিভাবে বেঁচে ছিল; এটা এখন ভুলে গিয়েছি।

আমার চুল পড়ে যাচ্ছিল। শরীরে ফোঁড়া হয়েছিল। সেখান থেকে রক্ত বের হতো। অসুস্থ অবস্থায় পরিবেশ অসহনীয় হয়ে পড়েছিল। বেশির ভাগ সময় আমি শুয়ে থাকতাম। তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে কোন ধারণা সে সময় ছিল না। ১২ বছর পরে আমার রোগ নির্ণয় হলো রক্তশুন্যতা জনিত ব্যাধি। প্রতি বছর কিছু সময়ের জন্য সূর্য অস্তের সময়কালে আকাশ প্রচন্ড লাল রং ধারণ করতো। এতে আমাদের সকলের মূখও লাল রং হয়ে যেতো এবং ভয় পেতাম। এ সময় আমি ছিলাম অসহায়, কাউকে সাহায্য করতে পারিনি। আমার ধারণা আণবিক বোমা নিক্ষেপের দিন সূর্য অস্তের সময় আকাশ প্রচন্ড লাল ছিল। তিন দিন তিন রাত শহর পুড়ছিল। আমি সূর্য অস্ত ঘৃণা করি। সূর্য অস্ত এখনও আমাকে দাউ দাউ জ¦লন্ত শহরকে মনে করিয়ে দেয়।

অনেক আণবিক বোমায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা (the hibakusha) মারা গিয়েছেন; তারা এসব কিছুই বলতে পারেননি; আণবিক বোমার যে যন্ত্রণা, সেটি তারা প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু আমি বলছি। অনেক মানুষ বলেন পৃথিবীর শান্তি। কিন্তু আমি চাই মানুষের অংশগ্রহণ। আমি চাই প্রত্যেক ব্যক্তি শান্তির কাজ শুরু করুন তিনি যতটুকু পারেন।

আমি যতটুকু পারি শান্তির জন্য কাজ করছি যেটি দেখবে আমার সন্তানরা এবং সন্তানদের সন্তানরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যারা আমাদের ভবিষ্যৎ; তারা এ বিশ্বে বাস করবে যেখানে তারা প্রতিদিন হাসতে পারবে।

রিয়েকো হাদাঃ ০৯ আগস্ট ১৯৪৫, সময় ১১.০২ মি. নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয়, এ সময় রিয়েকো হাদা’র বয়স ছিল ০৯ বছর। আকাশ হামলার পূর্ব সতর্ক বার্তা সকালেই পাওয়া যাচ্ছিল, এ সময় রিয়োকো ঘরেই ছিলেন।

যখন আকাশে বিমান চলাচলের শব্দ চলে যায়, পরিবেশ শান্ত ছিল। সে সময় তিনি কাছাকাছি একটি প্রার্থনালয়ে গিয়েছিলেন; তার সঙ্গে প্রতিবেশি শিশুরাও ছিল, তারা স্কুলে যায় নি, কারণ ঘন ঘন হামলার সকর্ত বার্তা আসছিল। এটি ছিল স্কুলের নির্দেশনা। ৪০ মিনিট প্রার্থনালয়ের ক্লাশ হয়। এরপর শিক্ষক ক্লাশ শেষ করেন। রিয়েকো বাড়িতে আসেন।

আমি বাড়িতে প্রবেশ করছি। আমার মনে আছে ভিতরের দরজায় পা রাখছি। তখনই ঘটনাটি ঘটল। আকাশে প্রচন্ড ধোঁয়াময় আলো দেখতে পাই। আলোর রং হলুদ, খাকি এবং কমলা মিশ্রিত। আমি তখনও তেমন আশ্চর্য হইনি। কী ঘটলো। আকাশ আবার সাদা হয়ে গেল। ঘর থেকে বাইরে বের হলাম। পর মুহূর্তে দেখি মানুষের তীব্র চিৎকার এবং আহাজারি। আমি অন্ধকারে ঢুকে গেলাম। আবার আমি বাড়িতে চলে আসি। আমাদের শিক্ষক শিখিয়েছিলেন আকাশে বিমান হামলার সময় জরুরী প্রয়োজনে আশ্রয় স্থানে চলে যাওয়ার জন্য। বাড়িতে মা’কে খুঁজছিলাম এবং আমরা প্রতিবেশিদের নিয়ে আকাশ হামলার আশ্রয় কেন্দ্রে যাই।

আমি কোন আঘাতই পাইনি। কোনপিরা পর্বত আমাকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু এটা পর্বতের অন্য প্রান্তের মানুষের জন্য কঠিন ছিল। তারা বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেল। কিছু ব্যক্তি কোনপিরা পর্বত পাড় হয়ে আমাদের কমিউনিটিতে চলে এলে। তাদের চোখ মুখ ছিল উদভ্রান্ত, বিভিন্ন দিকে ছুটাছুটি করে তারা আশ্রয় খুঁজছিল; বেশির মানুষের শরীরে কাপড় ছিল না। শরীর পুড়ে গিয়েছিল, শরীরের চামড়া ঝুলে পড়ছিল। আমার মা টাওয়াল এবং কাগজ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলেন, বিশেষ করে নারীদেরকে; যেগুলো বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল। একটি কমার্শিয়াল কলেজের অডিটোরিয়ামে যন্ত্রণাকাতর মানুষদের নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তারা শুয়ে পড়ল। তারা পানি চাচ্ছিল; তৃষ্ণার্ত ছিল। আমি তাদের পানি দিয়েছিলাম। আমি একটি ভাঙ্গা পাত্র পেলাম এবং চলে গেলাম নিকটবর্তী নদীতে এবং চামচ দিয়ে তাদের পানি দিয়েছিলাম। একটু পানি খেয়ে তারা মারা যাচ্ছিল। একের পর এক মানুষের মৃত্যু।

এটা বসন্তকাল ছিল। আবহাওয়া বেশ গরম। মৃত মানুষের হাত পা নেই, ঝুলন্ত খসে পড়া দেহের চামড়া; অস্বস্তিকর গন্ধ। দ্রুত মৃতদেহের সৎকার করতে হবে। মৃতদের কলেজের সুমিং পুলে রাখা হলো। খড় কুটা দিয়ে ভস্ম করা হলো। মৃত ব্যক্তিদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। তারা স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেনি।

আমার প্রত্যাশা আগামী প্রজন্ম কখনও এরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে না। আমরা আণবিক শক্তি আর ব্যবহার করতে দিবো না। মানুষই শান্তি সৃষ্টি করে। যদিও আমরা ভিন্ন দেশে বাস করি এবং ভিন্ন ভাষায় কথা বলি, আমার আবেদন শান্তি সমভাবে সবার মাঝে বিরাজ করুক।

আণবিক বোমা হামলার এতো বছর পরও শহর দুটোতে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগে ভুগছে বহু মানুষ। দিবসটি পালনে জাপান সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্বাভাবিক জন্ম এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রত্যাশার সাথে কামনা করি শান্তিময় পৃথিবী।

কড়চা/ আর আই টি

Facebook Comments Box
ভাগ