আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ও এবারের প্রতিপাদ্য/ ড. দিলীপ কুমার সাহা

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস ও এবারের প্রতিপাদ্য

ড. দিলীপ কুমার সাহা

জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবছর ১ অক্টোবর প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৯০ সালে। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয়। সাধারণত এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাগরিকদের জন্য ৬০ বছর ও তদুর্ধ্ব এবং উন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৬৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের কারণে মৃত্যু হার যেমন হ্রাস পেয়েছে পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্বে প্রবীণের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের কথায়, জীবনের সাথে আমাদের অতিরিক্ত বছর যোগ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাড়তি এই বছরগুলোতে জীবনের স্পন্দন যোগ করতে পারিনি।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণ সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ হবেন, যা ঐ সময়ের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। তবে ঐ সময় শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ অর্থাৎ বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে এক শতাংশ বেশি। ইউনিসেফ আভাস দিয়েছে আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিণত হবে। ইউনিসেফ এর একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৯৭৮ সাল থেকে মোট জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের হার বাড়তে থাকে, জনসংখ্যা থেকে উন্নয়নের সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) পাওয়ার সুযোগ তখন থেকেই শুরু হয়। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬২ ভাগ কর্মক্ষম যুবক, যা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে। ২০৩৩ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যার (Active Population) হার দ্রুত কমতে শুরু করবে, বাংলাদেশ আর মাত্র ১২ বছর এই সুবিধা পাবে। ফলে তখন আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সমূহ সম্ভবনা আছে। জনসংখ্যার হারকে বিবেচনায় নিয়ে কোনো দেশ বা সমাজকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি মানুষ বয়স্ক হলে সেটি হবে প্রবীণ প্রবণ সমাজ (এজিং সোসাইটি)। আর মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ বা তার বেশি বয়স্ক মানুষ হলে সেটি প্রবীণ প্রধানসমাজ (এজড সোসাইটি)। তাই বাংলাদেশ এখন প্রবীণ প্রবণ সমাজে অবস্থান করছে এবং দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে প্রবীণ প্রধান সমাজে পরিণত হবে আর এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার সেটা থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে।

তদুপরী পরিবার ও সমাজে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে পুরুষের তুলনায় প্রবীণ নারীদের ভোগান্তি, অসহায়ত্ব, একাকিত্ব সর্বোপরি জটিলতা বহুমাত্রিক। আমাদের সমাজে অনেক প্রবীণ নারীর ছোট বেলার পুতুল খেলার মাঝেও বিয়ে হয়েছে, কারো বা হয়েছে কিশোরী কিংবা যুবতী অবস্থায়, সে মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ির সম্পর্ক। জন্মের পর থেকে ঐ মা শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক সকল ক্ষেত্রে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন যাতে তার সন্তানরা নাগরিক হিসাবে বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। একই সাথে সর্বশক্তি বিলিয়ে দেয়া মা ক্রমান্বয়ে হতে থাকেন প্রবীণা। কালের বিবর্তনে মায়ের উপর সন্তানের নির্ভরশীলতা যখন হ্রাস পেতে থাকে, মায়ের নির্ভরশীলতা সন্তানের উপর ততই বাড়তে থাকে। সন্তান যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, মা তখন বয়সের ভাড়ে ন্যূজ, শারীরিক ও মানসিকভাবে দূর্বল, ক্ষমতাহীন, পরমুখাপেক্ষী। লিঙ্গ বৈষম্য আবার এই মাত্রাকে আরও তীব্রতর করে। কোভিড-১৯ মহামারী বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত তিন বছরে বয়ষ্ক ব্যক্তিদের জীবনে, বিশেষ করে প্রবীণ মহিলাদের আর্থ-সামাজিক, পরিবেশগত, স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু সম্পর্কিত প্রভাব এঁদের জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করেছে।

তদুপরী আমাদের সমাজে সাধারণত স্ত্রীদের বয়স থেকে স্বামীদের বয়স গড়ে ৫-৬ বছর বেশি থাকে। খেয়ালি প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে নারীরা বাঁচেনও আবার বেশি। যেখানে বাংলাদেশের পুরুষের গড় আয়ু ৭২.৬, অপরদিকে নারীর গড় আয়ু- প্রায় ৭৬ বছর। জীবন পরিক্রমার শেষ প্রান্তে নারীদের ৭/৮ বছর বেশি বাঁচতে হয় বিধবা হিসাবে, ক্ষমতাহীন ও পরমূখাপেক্ষি হয়ে। আবার প্রবীণা নারীর পক্ষে তখন বয়স্ক স্বামীর সেবা-শুশ্রুষা করাই হয়ে দাড়ায় চ্যালেঞ্জের- পর্বতসম কষ্টের। তাছাড়াও বিভিন্ন কারণে বিধবা প্রবীণ নারীকে সুনিপুনভাবে শুধু লিঙ্গ বৈষম্যের জোড়ে স্বামী, ভাই, পুত্র অতি ঘনিষ্টজনেরা রাখে নিঃস্ব ও একাকিত্বে সর্বোপরি ক্ষমতাহীন করে। কিন্তু ঐ প্রবীণ নারীর স্বামী, পরিবার ও সমাজের প্রতি নিঃস্বার্থভাবে সারাজীবন বিলিয়ে দিয়ে চিরভাস্কর স্বাক্ষর রাখে তাঁদের সহনশীলতা ও অবদানের।

প্রতি বছর ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’-এ দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “বয়স্ক মহিলাদের সহনশীলতা এবং অবদান।” বয়স্ক প্রবীণাদের অত্যাবশ্যক অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া এবং স্থানীয়, জাতীয় সকল ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ এবং বিপর্যয় গুলোকে একত্রিত করে যৌক্তিক নীতি তৈরি করা যাতে তাঁদের কন্ঠস্বর, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্তর্ভূক্তি প্রতিফলিত হয়। ফলশ্রুতিতে প্রবীণ নারীরা যেন বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করার পাশাপাশি সহনশীলতা ও দৃঢ়তার সকল প্রতিকুলতা সমাধানে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতিসংঘ বয়স্কব্যক্তি ও বার্ধক্য সম্পর্ক নেতিবাচক স্টেরিওটাইপ এবং কুসংস্কারচ্ছন্ন ভুল ধারণা প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ জন্য এবং প্রবীণ নারীর মাঝে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে পরিবার ও সমাজ যাতে উপলব্ধি করে তার জন্য এবারের এ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো- ১) পরিবেশগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আজীবন বৈষম্যের মধ্যে প্রবীণ নারীর সহনশীলতা তুলে ধরা; ২) বিশ্বব্যপী প্রবীণ মহিলাদের প্রতি বয়স্ক ও লিঙ্গ বৈষম্যের তথ্য সংগ্রহের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। ৩) লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতে সমস্ত নীতির কেন্দ্রে প্রবীণ মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সদস্য দেশগুলো, জাতিসংঘের সংস্থাগুলো, ইউএন উইমেন এবং সুশীল সমাজের প্রতি আহ্বান। ফলে চিরবঞ্চিত এই প্রবীণ নারীদের যেন সমাজে অন্য সকলের ন্যায় তাঁদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত হয়। এর মাধ্যমে তাঁদের সারাজীবন সহনশীলতা ও অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সম্ভব হবে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক- এবার আমাদের প্রবীণ বান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের যুক্ত করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং বলেন, লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০% নারীর প্রতিটি সেক্টরে অংশগ্রহণ নিশ্চিতে তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আজকের মেয়ে শিশু তথা ভবিষ্যতের প্রবীণ নারীর সমস্যা আমরা যদি সঠিকভাবে চিহ্নিত করি এবং তা দূর করার জন্য পারিবারিক, সামাজিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সাংস্কৃতিক, চেতনাগত, দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে উদ্যোগ নেই, তবেই লিঙ্গ ও বয়স বৈষম্যহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে যুব সমাজের সোচ্চার ভূমিকার পাশাপাশি সরকার, রাষ্ট্রপ্রশাসন, নীতি নির্ধারক, আইনজ্ঞ, প্রচারকসহ সচেতন সবাইকে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে লিঙ্গ ও বয়স বৈষম্যহীন প্রবীণ নারীর প্রতি পূর্ণ মানবিকতার প্রতিষ্ঠা এবং সেই সাথে স্বীকৃতি পাবে এবারের আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের যথার্থতা।

ড. দিলীপ কুমার সাহা : জেরেন্টোলজিস্ট ও প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ, মহাখালী, ঢাকা। মোবাইল : ০১৯১৩০৫৫০১১। Email ID: dilipsaha1966@gmail.com

Facebook Comments Box
ভাগ