করোনা ভাইরাসের পর নতুন একটি ভাইরাসের আতঙ্ক!

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক না কাটতেই পৃথিবী আরেকটি ভয়ংকর ভাইরাসের মুখোমুখি। নতুন এই ভাইরাসটির নাম : G4 EA H1N1.

ছোট করে G4 Virus বলা হয়। এটি এক ধরনের ফ্লু ভাইরাস। এই ভাইরাসটি এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র Pig বা শূকরের দেহকে আক্রান্ত করে। China Agricultural University এর Prof. Liu Jinhua এ নিয়ে একটি গবেষণা পত্র আমেরিকান Proceedings of the National Academy of Sciences এর জার্নালে প্রকাশ করেন। করোনা ভাইরাস নিয়ে দেরি করে বিশ্বকে অবহিত করার কারণে সমালোচিত হওয়ায় এবার আর দেরি করলো না চীন।

চীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শূকরের দেশ। পঞ্চাশ মিলিয়নের বেশি শূকর আছে খামারে এবং গৃহপালিত অবস্থায়। সম্প্রতি কিছু শূকরের শরীরে G4 ভাইরাসটির প্রকোপ দেখা গেছে অধিক মাত্রায়। চীন সহ বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, যে কোনো সময় এই ভাইরাসটি মানুষের দেহে আক্রমণ করার উপযোগী হয়ে উঠতে পারে এবং করোনা ভাইরাসের মতো প্যান্ডেমিক অবস্থায় যেতে পারে। বলা হয়, এক প্যানডেমিকের পিছে পিছে আরেক প্যান্ডেমিক হাজির হওয়ার পথে আছে।

এমন বলার কারণ কি? চাইনিজ শূকরের দেহে পাওয়া G4 ভাইরাসের মধ্যে তিন ধরনের ভাইরাসের আংশিক জেনেটিক কোড পাওয়া গেছে।

1.H1N1

2. H5N1

3. Pig influenza virus

ভয়ের কারণ এখানেই । ২০০৯ সালে এই H1N1 ভাইরাসের নতুন একটি স্ট্রেইনের কারণে Swine Flu প্যান্ডেমিক হয়েছিল। মেক্সিকোতে প্রথম দেখা দেয়া সেই প্যানডেমিক ভাইরাসটির নাম ছিল A/H1N1pdm09. H1N1 এর এই সাবটাইপ স্ট্রেইনের আরেক নাম Swine Flu Virus. Swine মানে Pig! শূকরের দেহ থেকে একটি স্ট্রেইন মানুষকেও আক্রান্ত করেছিল। তখনকার হিসাব মতে ১৮ হাজার মানুষ Swine flu তে মারা গেলেও WHO এর আরেক গবেষণায় পরে দেখা গেছে যে, প্রায় আড়াই লক্ষ লোক এই ভাইরাসে পরবর্তী দুই বছরে মারা যায়। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯১৭ সালে Spanish flu প্যান্ডেমিকও এই H1N1 ভাইরাসটির আরেকটি স্ট্রেইন A/H1N1 এর কারণে হয়েছিল। সেই ভাইরাসে ২০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলো।

H5N1 হলো avian flu virus. Avian মানে Bird. তাই অনেকে একে বার্ড ফ্লু বলে। পাখির দেহে থাকে এবং মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

G4 ভাইরাসে H1N1 ভাইরাসের জেনেটিক কম্পোনেন্ট আছে। H1N1 ভাইরাসের একটি বৈশিষ্ট্য হলো এরা প্রাণীর একই দেহে মাল্টিপল স্ট্রেইনে ঢুকে জেনেটিক কোড বিনিময় করে নতুন একটি স্ট্রেইনে পরিণত হতে পারে এবং সেই প্রাণীগুলোর কাছে থাকা মানুষের শরীর উপযোগী মিউট্যান্ট হয়ে শরীরকেই আক্রমণ করে বসতে পারে। তারপর খুব সহজেই এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী শূকরের খামারে কাজ করা দুজন শ্রমিকের দেহে এই জীবাণু পাওয়া গেছে।

ভয়ের আরেকটি কারণ হলো, G4 এর মাঝে থাকা H5N1 – এর জেনেটিক কোড পাওয়া গেছে। Avian influenza virus নামে পরিচিত এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই।

ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু এর পেছনে ১০০-এর বেশি ভাইরাস দায়ী। এদের প্রধানত চার ভাগে ভাগ করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা A, B, C, D। প্রতিবছর লোকের যে ফ্লু হয় ফ্লু সিজনে, তার কারণ এই Type A & B influenza virus। টাইপ C দুর্বল ফ্লু ভাইরস, এবং এর কারণে মাইল্ড ফ্লু হয়। টাইপ D মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের হয়।

এ পর্যন্ত G4 -এ দুজন আক্রান্ত হয়ে অবস্থা মারাত্মক পর্যায় গেলেও তাদের থেকে অন্য কারো শরীরে ছড়ায় নি। কিন্তু অন্য দুটি ফ্লু ভাইরাসের কিছু স্ট্রেইনের বৈশিষ্ট থাকায় যে কোনো সময় তারা Pig থেকে মানুষের শরীরে ভিন্নরূপে আক্রমণ করে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ ওই দুটি ভাইরাসের স্ট্রেইন মানুষকে পূর্বে আক্রান্ত করেছিল। তাই বিজ্ঞানীরা এখনোই এই ভাইরাসকে চোখে চোখে রাখছে এবং ভাইরাসটির বিরুদ্ধে কাজের উপযোগী ভ্যাকসিনের পরীক্ষাও করছে। যেহেতু চীনে পঞ্চাশ মিলিয়নের বেশি খামারজাত শূকর আছে, শূকরগুলোর দেহেও ভ্যাকসিন প্রয়োগের চিন্তা ভাবনা চলছে।

বিশ্ব এখন অনেক বেশি সতর্ক । এই প্রজন্মের এক প্যান্ডেমিক অভিজ্ঞতা বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। সেই সাথে সাধারণ মানুষেরও এই নিয়ে শুরু থেকে অবগত এবং সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে।

সূত্র :
1. PNAS – Proceedings of the National Academy of Sciences
2. Science Journal
3. BBC Health News
4. CDC – Centers for Diseases Control and Prevention

অপূর্ব চৌধুরীঃ চিকিৎসক এবং লেখক। জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড। গ্রন্থ ৭। উল্লেখযোগ্য বই: অনুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত ।

Facebook Comments Box
ভাগ