ডা. অপূর্ব চৗধুরী
মূল কথা:
নতুন করোনা ভাইরাস সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করে না। সবাই সমানভাবে আক্রান্ত হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, রক্তের গ্ৰুপ যাদের O, তারা সবচেয়ে কম আক্রান্ত হয় এবং যাদের গ্ৰুপ A, তারা সবচেয়ে বেশি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়।
বিশ্লেষণ:
নতুন করোনা ভাইরাসে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে যে, জন্মগত ভাবে পাওয়া রক্তের কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে একেকজনের উপর ভাইরাসের আক্রমন একেক ধরনের। এ নিয়ে বিশ্লেষণ করার আগে রক্ত নিয়ে কিছু ধারণা দেয়া যেতে পারে।
ইতিহাস:
রক্ত শরীরের ভিতর প্রবহমান একটি জলীয় উপাদান। ১৬১৬ সালে ইংরেজ ডাক্তার উইলিয়াম হার্ভে প্রথম মানুষের শরীরে রক্ত চলাচলের একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাপ প্রকাশ করেন। তারপর থেকে চিকিৎসকরা রক্তের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
ডাক্তাররা একজনের রক্ত আরেকজনের শরীরে, এমনকি কখনো কখনো চিকিৎসার প্রয়োজনে অন্য প্রাণীদের রক্ত মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখতে পান যে তাতে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে এবং রোগী মারা যায়। প্রায় ৩০০ বছর পর ১৯০০ সালে আমেরিকান এক ডাক্তার Karl Landsteiner এমন দুর্ঘটনার কারণ জানতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন যে, মানুষের শরীরে একেক জনের রক্তের ধরন একেক রকমের। নাম দেন: Blood Group.
রক্তের ভেতর থাকা কিছু রাসায়নিক উপাদানের ভিত্তিতে তিনি রক্তকে তিনটি গ্ৰুপে ভাগ করেন। A, B, C. পরবর্তীতে এই C কে নাম দেন O. এই O-কে কোনো কোনো দেশে Zero বা শূন্য বলা হয়। তবে বেশিরভাগ দেশে ইংরেজি বর্ণমালার O বলা হয়। এই O নেয়া হয়েছে জার্মান শব্দ ‘Ohne’ থেকে, যার অর্থ Null or Zero. পুরো পদ্ধতিকে সংক্ষেপে ABO Blood Group বলা হয়। Karl Landsteiner-কে এই কারণে ১৯৩০ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।
গত একশো বছরে মানুষের শরীরে রক্তের গ্ৰুপ নির্ধারণ করতে এই ABO ছাড়াও আরো অনেকগুলো পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। রক্তের ভিতর ৩৪৬ ধরনের রাসায়নিক উপাদানের ভিত্তিতে বর্তমানে ৩৬ ধরনের Blood Group System আছে। ABO সিস্টেম তার একটিমাত্র, বহুল ব্যবহৃত, এবং জনশ্রুত।
ABO ব্লাড গ্ৰুপ:
রক্ত দুটি উপাদান নিয়ে তৈরী। কিছু কোষ, কিছু জল। RBC, WBC, Platelets নামের তিন ধরনের কোষ থাকে। জলের অংশটাকে বলে প্লাসমা। এই প্লাজমার ৯৫% জল আর বাকি অংশে প্রোটিন, লিপিড এবং কার্বোহাইড্রেড জাতীয় কিছু রাসায়নিক উপাদান থাকে।
ABO পদ্ধতি ভাগ করা হয় রক্তের ভেতর দুটো উপাদান দিয়ে। একটিকে বলে Antigen, আরেকটিকে বলে Antibody. antigen হলো বাহির থেকে কোনো কিছু শরীরে ঢুকে শরীরকে আক্রমণ করার যোগ্য কিছু। antibody হলো সেই antigen এর প্রতিক্রিয়ায় শরীরের নিজের কোনো কেমিক্যাল যা সেই antigen কে মেরে ফেলে। রক্তের এই এন্টিজেন এবং এন্টিবডি দুটোই জন্মগতভাবে পিতা-মাতা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে এবং জন্মের পর থেকে রক্তে তারা ঘুরে বেড়ায়। এই জন্যে যার যে ধরনের এন্টিজেন এন্টিবডি, তার রক্তের ধরন সেই ধরনের।
এই এন্টিজেন হতে পারে প্রোটিন, লিপিড কিংবা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় কিছু। এরা মূলত RBC কোষের আবরণে থাকে। দুই ধরনের এন্টিজেন থাকে। Antigen A এবং Antigen B.
এন্টিবডি থাকে জলের অংশ প্লাসমাতে। দুই ধরনের এন্টিবডি থাকে। Antibody A এবং Antibody B.
ABO পদ্ধতিতে রক্তের মধ্যে এই দুই ধরনের এন্টিজেন থাকা এবং না থাকার উপর ভিত্তি করে চার ধরনের রক্তের গ্ৰুপ করা হয়।
1. Blood Group A: যার রক্তে এন্টিজেন A আছে।
2. Blood Group B: যার রক্তে এন্টিজেন B আছে।
3. Blood Group AB: যার রক্তে এন্টিজেন A এবং B দুটোই আছে।
4. Blood Group O: যার রক্তে দুটো এন্টিজেনের একটাও নেই।
চার ধরনের এই ব্লাড গ্ৰুপে এন্টিবডিগুলো ঠিক এন্টিজেনের বিপরীত থাকে।
1. Blood Group A: এন্টিজেন A থাকে, কিন্তু এন্টিবডি থাকে B.
2. Blood Group B: এন্টিজেন B থাকে, কিন্তু এন্টিবডি থাকে A.
3. Blood Group AB: এন্টিজেন A এবং B দুটোই থাকে, কিন্তু কোনো এন্টিবডি থাকে না।
4. Blood Group O: কোনো এন্টিজেন থাকে না, কিন্তু এন্টিবডি থাকে দুটোই, A এবং B.
এমন এন্টিজেন এন্টিবডির বিপরীত থাকার কারণে কার শরীরে কি ধরনের রক্ত ঢোকানো যাবে তা ঠিক করতে সহজ হয়। কারণ যার শরীরে এন্টিজেন A আছে তার শরীরে যদি একই জাতীয় এন্টিবডি A ঢোকানো হয় তাহলে রক্তের কোষগুলো একটার সাথে আরেকটা আঠার মতো লেগে যাবে, তাতে রক্ত চলাচল উল্টো বন্ধ হয়ে যাবে। তখন এই গ্ৰুপের মধ্যে দিয়ে দেখা হয় কার রক্তে কোন এন্টিজেন এন্টিবডি আছে এবং কার রক্ত কার শরীরে ঢোকানো যাবে।
ব্লাডের এই ধরনের গ্ৰুপের কারণে কে কাকে রক্ত দিতে পারবে এবং কে কোন ধরনের রক্ত নিতে পারবে, তার কতগুলো স্বতঃসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য ধরা হয়। এই অংশটি নিজের প্রয়োজনে মনে রাখতে অথবা সংরক্ষণ করে রাখলে কাজে লাগবে।
1. যাদের রক্তের গ্ৰুপ A: তারা রক্ত নিতে পারবে শুধুমাত্র যাদের রক্তের গ্ৰুপ A অথবা গ্ৰুপ O. কিন্তু রক্ত দিতে পারবে যাদের রক্তের গ্ৰুপ A অথবা যাদের গ্ৰুপ AB.
2. যাদের রক্তের গ্ৰুপ B: তারা রক্ত নিতে পারবে শুধুমাত্র যাদের রক্তের গ্ৰুপ B অথবা গ্ৰুপ O. কিন্তু রক্ত দিতে পারবে যাদের রক্তের গ্ৰুপ B অথবা গ্ৰুপ AB.
3. যাদের রক্তের গ্ৰুপ AB: তারা রক্ত নিতে পারবে যে কেউ থেকে – গ্ৰুপ A, B, O এবং AB সবার কাছ থেকেই। কিন্তু রক্ত দিতে পারবে শুধুমাত্র যাদের গ্ৰুপ AB.
4. যাদের রক্তের গ্ৰুপ O: তারা রক্ত নিতে পারবে শুধুমাত্র যাদের রক্তের গ্ৰুপ O. অন্য কোনো গ্ৰুপের রক্ত তারা নিতে পারবে না। কিন্তু তারা রক্ত দিতে পারবে সবগুলো গ্ৰুপের কেউকে – A, B, AB অথবা O যে কেউকে।
উপরের এই রক্ত দেয়া নেয়ার বিষয়টিকে দুটি উপসংহারে বলে অনেকে।
1. AB গ্ৰুপকে বলে Universal Recipients বা সার্বজনীন গ্রহীতা। মানে যে কারো রক্ত নিতে পারবে তারা ।
2. O গ্ৰুপকে বলে Universal Donors বা সার্বজনীন দাতা। মানে যে কেউকে রক্ত দিতে পারবে তারা।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের রক্তের গ্ৰুপ:
ইউরোপের দুটি দেশ ইতালি এবং স্পেনের সমন্বয়ে সাতটি হসপিটালের ১৯৮০ জন কোভিড-১৯ রোগীদের উপর পরিচালিত এক গবেষণাপত্র গতমাসে New England Journal of Medicine এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় তারা দেখতে পান যে-
1. যাদের রক্তের গ্ৰুপ A: তাদের করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার এবং সমস্যা মারাত্মক দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। শতকরা হিসাবে যা ৪৫% বেশি সম্ভাবনা অন্য রক্তের গ্ৰুপের চেয়ে ।
2. যাদের রক্তের গ্ৰুপ O: তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার এবং সমস্যা মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। শতকরা হিসাবে যা অন্য গ্ৰুপ গুলোর চেয়ে ৩৫% কম।
সতর্কতা : উপরের মীমাংসার মানে এই নয় যে, A গ্ৰুপের লোকদের কোভিড ১৯ বেশি হবে, আর O গ্ৰুপের কম হবে। নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া এবং আক্রান্তের পর মারাত্মক দিকে যাওয়া অনেকগুলো শারীরির পূর্বতন সমস্যা, বয়স, ইমিউনিটি, পরিবেশ, এমনকি ভাইরাসের স্ট্রেনটির উপর নির্ভর করে, সাথে রক্তের গ্ৰুপ একটি কম গুরুপ্তপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। এর অর্থ O গ্ৰুপের লোকেরাও কোভিড আক্রান্ত হতে পারে এবং মারা যেতে পারে। A গ্ৰুপের লোকেরাও আক্রান্ত নাও হতে পারে এবং হলেও সমস্যা মারাত্মক দিকে নাও যেতে পারে।
কিভাবে গবেষকদল সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন:
রক্তের গ্ৰুপ পরীক্ষা করে নয়, বরং আক্রান্তদের জেনেটিক এনালাইসিস করতে গিয়ে দেখতে পেলেন রক্তের গ্ৰুপের জন্যে যে জেনেটিক কোড গুলো দায়ী, কোনো কোনো রোগীদের তার প্রাধান্য সুস্পষ্ট এবং অন্য অনেকের তা কম।
ABO Blood Grouping এ মূলত ক্রমোজোম ৩ এবং ক্রমোজোম ৯ দায়ী। কোভিড আক্রান্তদের জেনেটিক এনালাইসিস করে দেখতে পেলেন যে সেই ক্রমোজোমের মধ্যে তিন নম্বরে 3p21.31 এবং নয় নম্বরে 9q34.2 দুটো জেনেটিক লোকাসের প্রাধান্য দেখা গেছে। যেটির বিভিন্ন বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে A গ্ৰুপের রোগীদের সমস্যা মারাত্মকের দিকে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি এবং O গ্ৰুপের কম।
ইতালি এবং স্পেনের বাহিরে চীন এবং আমেরিকাতেও দুটো গবেষণা হয়েছে রক্তের গ্ৰুপের সাথে কোভিড আক্রান্তদের সম্পর্ক নিয়ে। সেখানেও একই ফলাফল পাওয়া গেছে।
উপসংহার:
কেন A ব্লাড গ্ৰুপের কেউ অন্যদের তুলনায় বেশি আক্রান্ত হয় এবং O গ্ৰুপের কেউ কম আক্রান্ত হয়, তার জেনেটিক কারণটি জানা গেলেও কিভাবে এই জেনেটিক বৈশিষ্ট্য ভাইরাসটিকে প্রভাবিত করে অথবা ভাইরাসটি কিভাবে এমন বৈশিষ্ট্যের দেহে আক্রমণ করে, তার কারণ কিংবা প্রক্রিয়াটি এখনো জানা যায় নি। আশা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে রহস্যটি বেরিয়ে আসবে।
সূত্র:
1. NEJM : New England Journal of Medicine
2. medRxiv : The Preprint Server for Health Science
3. NHSBT : NHS Blood and Transplant UK
4. CDC : Centers for Diseases Control and Prevention
5. Encyclopaedia of Britannica
অপূর্ব চৌধুরীঃ চিকিৎসক এবং লেখক । জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড । গ্রন্থ ৭ । উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য, বৃত্ত।